২৫ বছর আগে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী খুনের ঘটনায় ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আবদুল আজিজ, ট্রাম্প ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম ও আদনান সিদ্দিকীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তাঁরা তিনজনই পলাতক। বাকি ছয় আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৯ মে) ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক অরুণাভ চক্রবর্তী এই রায় ঘোষণা করেন।
আইনজীবী ও আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মামলার অভিযুক্ত ৯ আসামির মধ্যে পাঁচজন পলাতক। তাঁরা হলেন, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আবদুল আজিজ, ট্রাম্প ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ওরফে বস লিটন ও আদনান সিদ্দিকী। এ ছাড়া আসামি আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, তারিক সাঈদ মামুন ও ফারুক আব্বাসী জামিনে আছেন। আর কারাগারে আছেন সানজিদুল ইসলাম ইমন।
মামলার কাগজপত্র ও রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীর ট্রাম্প ক্লাবের সামনে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে উঠে আসে আলোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই, ট্রাম্প ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম ও আশীষ রায় চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধের জেরে ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করা হয়।
খুন হওয়ার পরের বছর আশীষ রায় চৌধুরীসহ নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এর দুই বছর পর ২০০১ সালে বিচার শুরুর আদেশ হয়। ওই আদেশ চ্যালঞ্জ করে এক আসামি উচ্চ আদালতে গেলে আটকে যায় বিচার কার্যক্রম। পরে উচ্চ আদালতের আদেশে আবার বিচার কার্যক্রম ২০২২ সালে শুরু হয় বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি।
এদিকে ১৭ বছর আগে ঢাকা মহানগরের পিপির দপ্তর থেকে সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার তদন্তের নথিপত্র (কেস ডকেট) নিয়ে যান পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক ফরিদ উদ্দিন। আদালতের নির্দেশের পরও তিনি তা আদালতে উপস্থাপন করতে পারেননি বলে জানান এপিপি সাদিয়া আফরিন।
মামলার এজাহার ও পুলিশের কাছে দেওয়া সাক্ষীদের জবানবন্দির তথ্য বলছে, ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাইয়ের একটি ঘটনা থেকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই, আজিজের আত্মীয় বান্টি ইসলাম, বান্টির বন্ধু আশীষ রায় চৌধুরীর সঙ্গে সোহেলের বিরোধের শুরু। এর জেরেই ট্রাম্প ক্লাবের সামনে ভাড়াটে লোক দিয়ে হত্যা করা হয় সোহেল চৌধুরীকে। জবানবন্দিতে সোহেল চৌধুরীকে হত্যার বিবরণ দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা।
সাক্ষীরা বলেছেন, ওই দিন রাতে বনানীর ট্রাম্প ক্লাবে গান বন্ধ করতে বলেছিলেন সোহেল ও তাঁর বন্ধুরা। গান বন্ধ করা নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেলের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সোহেল চৌধুরী আজিজের ওপর খেপে যান। তখন সোহেলের বন্ধু কালা নাসির আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে গুলি করতে যান। এ সময় ক্লাবের বাথরুমে ঢুকে আত্মরক্ষা করেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এই ট্রাম্প ক্লাবের মালিকানা ছিল বান্টি ও আশীষের। বিরোধের শুরু এখান থেকেই।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, ট্রাম্প ক্লাবের কার্যক্রম চলত বনানীর আবেদিন টাওয়ারের সপ্তম তলায়। ক্লাবের পশ্চিম পাশে ছিল একটি জামে মসজিদ। জবানবন্দিতে একাধিক সাক্ষী বলেছেন, ওই ক্লাবে নাচ-গানসহ অসামাজিক কার্যক্রম চলত। ক্লাবের অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে স্থানীয় মুসল্লিদের পক্ষে অবস্থান নেন সোহেল চৌধুরী।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, সোহেল চৌধুরী মসজিদ কমিটির লোকজন নিয়ে ক্লাব বন্ধ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এ নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর ঝামেলা হয়। ট্রাম্প ক্লাবের কাজ ব্যাহত হলে সোহেল চৌধুরীকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন আসামিরা।
২৪ জুলাইয়ের পার্টিতে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর ঝামেলার পর থেকে তাঁর ওপর ট্রাম্প ক্লাবে ঢোকায় অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আসে। সেটি ক্লাবের কর্মচারীরাও পুলিশকে তখন জানিয়েছিলেন।
সোহেল চৌধুরীর মা নূরজাহান বেগম আদালতকে বলেছিলেন, বনানীর ট্রাম্প ক্লাবে অসামাজিক কার্যকলাপ হতো। ক্লাবের পাশের মসজিদ কমিটি ও মুসল্লিরা এর প্রতিবাদ করেছিলেন।
আজিজ ও সোহেলের বিরোধ: আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও সোহেল চৌধুরীর মধ্যে যে গন্ডগোল হয়েছিল, সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মির্জা মাহাফুজ আদালত ও পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে তিনি পুলিশকে বলেছিলেন, ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই রাত ১০টার দিকে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাবে যান তিনি। তখন ক্লাবে আসেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। আজিজ মোহাম্মদ তাঁর স্ত্রীকে গান গাইতে বলেন। অন্যদিকে সোহেল চৌধুরী ও তাঁর কয়েক বন্ধু গান থামাতে বলেন। একপর্যায়ে সোহেল চৌধুরী ও তাঁর দলের লোকজন মাহাফুজের টেবিলের সামনে আসেন। তখন তাঁরা আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের পাশে বসা এক নারীকে উঠে আসতে বলেন। ওই নারী না উঠলে সোহেল চৌধুরী আরও ক্ষিপ্ত হয়ে মারতে যান।
মামলার আরেক সাক্ষী গোলাম মোহাম্মদ। তিনি সোহেলের বন্ধু। সাক্ষী হিসেবে তিনি তখন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে বিচারককে বলেছিলেন, খুন হওয়ার আগে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর ঝগড়া হয়। বিষয়টি তাঁর সামনে ঘটেছে। এ ছাড়া ট্রাম্প ক্লাবের বান্টি ইসলামের সঙ্গে সোহেলের দুই থেকে তিনবার ঝগড়া হয়। পরে তা মিটেও যায়। তবে আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতলের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। আশীষ চৌধুরীই সোহেল চৌধুরীকে ক্লাব থেকে বের করে দেন। ভবিষ্যতে সোহেলকে ক্লাবে না আসার জন্য হুমকিও দেন।
খুনের ১৫ দিন আগে সোহেলকে টেলিফোনে হুমকি: সোহেল চৌধুরী হত্যা নিয়ে তাঁর মা নূরজাহান বেগম আদালতকে বলেন, তাঁদের বাসার উল্টো দিকে ট্রাম্প ক্লাব। হত্যাকাণ্ডের দিন রাত দুইটায় সোহেল বাসায় ফেরেন। ক্লাবের সামনে জামে মসজিদ। পরে সোহেল আবার ক্লাবে গেলে সন্ত্রাসীরা তাঁকে দুটি গুলি করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সোহেল চৌধুরীর মা আদালতকে আরও বলেছিলেন, সোহেল খুন হওয়ার ১৫ থেকে ২০ দিন আগে টেলিফোনে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলামের লোকজন হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, সোহেলের মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে।
যেভাবে খুন: সোহেল চৌধুরীকে কীভাবে গুলি করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে অভিযোগপত্রে বলা হয়, সেদিন সোহেল চৌধুরী ক্লাবে ঢুকতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁকে ক্লাবে ঢোকার অনুমতি না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে রাত তিনটার দিকে সোহেল চৌধুরী আবার ক্লাবের সামনে আসেন। তখন পেশাদার খুনিদের দিয়ে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মামলার সাক্ষী আবুল কালাম পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, সেদিন সোহেলসহ সাত থেকে আটজন লোক ক্লাবের সামনে গেলে হঠাৎ গুলি করা হয়। তাঁর পেটে গুলি লাগে। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। সন্ত্রাসীদের গুলিতে আরও গুলিবিদ্ধ হন নীরব ও দাইয়ান। আর সোহেল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। গুলি করার পর ইমন, মামুন, লিটন, ফারুক গাড়িতে করে পালিয়ে যান। সোহেলের সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাই, বান্টি ইসলাম ও আশীষ রায় চৌধুরীর আগের ঝগড়ার জেরে তাঁকে ঠান্ডা মাথায় ভাড়াটে খুনি দিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।