২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধ্বস বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনার একটি। এতে ১ হাজার ১৩৮ জন পোশাক শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হয়। আহত হন আরও দুই সহস্্রধিক পোশাক শ্রমিক। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় পুরো বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। ভয়াবহ সেই বিপর্যয়ের রেশ রয়ে গেছে আজও। আজ সেই দুর্ঘটনার ১১ বছর পূর্ণ হলেও বিভীষিকাময় সেই স্মৃতি আজও তাড়া করে ফিরছে দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণকারীদের। তাদেরই একজন দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর রেবেকা বেগম। আজও তিনি বোবা কান্নায় খুঁজে ফেরেন তার হারানো স্বজনদের। যদিও জানেন, তারা সবাই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু মন যে মানে না কোন সান্তনা। রেবেকা সেই দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন তার মা, দুুই দাদি, দুই চাচাতো ভাই ও বোনকে। একই সঙ্গে হারিয়েছেন নিজের দুইটি পা।
ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসে দু’পা হারানো দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার পঙ্গু পোশাক শ্রমিক রেবেকা খাতুন। মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল কথা আমাদের প্রতিনিধির সাথে, রানা প্লাজায় দূর্ঘটায় দু’পা হারিয়ে পুঙ্গত্ব বরণকারী পোশাক শ্রমিক রেবেকা খাতুন এবং একই ঘটনায় নিখোঁজ হওয়া ৩ নং কাজিহাল ইউনিয়নের ডাঙ্গা গ্রামের গুলশান আক্তার শাবানার পরিবারের সাথে। আজ ২৪ এপ্রিল ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১১ বছরপূর্ণ হলো। সেদিনের ভয়াবহ দূর্ঘটানায় দু’পা হারিয়ে পঙ্গুত্ববরণকারী পোশাক শ্রমিক রেবেকা সেই ভয়াল দুঃসহ স্মৃতি বহণ করছে এখোনো, আজও বিভিন্ন সমস্যায় জর্জিত।
কাটা পায়ের ভিতরের হাড় বৃুদ্ধি পেয়েছে। প্রচুর ব্যাথা হয়। কিডনি নষ্টের ভয়ে ব্যাথার ঔষধ কম খাই। এরই মধ্যে দু’পায়ে ৮বার অপারেশন করা হয়েছে। ডাক্তার আবারো অপেরাশন করতে বলেছে। ছেলে-মেয়ে ছোট, স্কুলে যায়। তাদের ফোনে লেখা-পড়ার খোজ রাখা।হাতের উপর ভর করে চলা-ফেরা ,রান্না করা অনেক কষ্ট হয়।ক®েটর কথা সবাইকে বোঝাতে পারবো না।
‘হয়তো কিছু টাকা পেয়েছি, কেউ একটা বাড়ি করে দিয়েছে, একাই চলাফেরা করতে না পারার কারনে সেই বাড়ীতে থাকতে পারি না।আমার স্বামীর ভাই ভাবিদের সাথেই থাকি।তাদের সহযোগিতা নিতে হয়। কিন্তু কেউ কী আমার পা দুটো এনে দিতে পারবে? যা দিয়ে আমি আগের মতো স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে বেড়াব। আমার স্বামী, সন্তাানদের জরুরি প্রয়োজনে তাদের কাছে যেতে পারব, না আমার জরুরি কাজে বাহিরে যেতে পারবো। আমার স্বামী তখনো কাজ করত, এখন তাকে আমাকে নিয়ে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। আমাদের সংসারে সচ্ছলতা ছিল। একটি দুর্ঘটনায় আজ আমাদের সংসার তছনছ হয়ে গেল। আমরা ওই গার্মেন্টস মালিকের শাস্তি চাই। শুনছি এ উপলক্ষ্যে আইনি সহায়তা ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর পালনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ব্লাষ্ট।’উচ্চ আদালত বিচার কাজ সমাপ্ত করার জন্য ৬ মাস সময় বেধে দেওয়ার পরও এখনো বিচার না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন রেবেকা।
রেবেকা বেগম দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার ২ নং আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাই চেয়ারম্যান পাড়া গ্রামের রাজমিস্ত্রি মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী।
এদিকে একই ঘটনায় নিখোঁজ হন উপজেলার ৩ নং কাজিহাল ইউনিয়নের ডাঙ্গা গ্রামের আতাউর রহমানের স্ত্রী পোশাকশ্রমিক গুলশান আক্তার শাবানা। জানতে চাইলে স্বামী আতাউর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিনের মতোই শাবানা ওই দিন রানা প্লাজায় কাজ করতে যায়। ঘটনার পর আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে নিখোঁজ তালিকায় শাবানার নাম ছিল। নিখোঁজ তালিকার সূত্র ধরে সেই সময় ১৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেলেও পাইনি স্ত্রীকে কিংবা তার মরদেহ।’
রেবেকার স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি আজো রেবেকাকে তাড়া করে বেড়ায়। মাঝেমধ্যেই রেবেকা বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে। সেই দুর্ঘটনাই আমাদের সুন্দর সংসার তছনছ করে দিয়েছে।’এদিকে এরই মধ্যে তার পঙ্গুত্ব জীবন জুড়ে আসে প্রথম সন্তান ছিদরাতুন মুনতাহা নামে একটি কন্যা সন্তান, বর্তমানে তার বয়স ১০ বছর চলছে। স্থানীয় বারাই গোল্ডেন হোফ কিল্টার গার্ডেন স্কুলে ৪র্থ শ্রেনিতে পড়ে। পরে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়,তার নাম মাদানী আন-নুর তার বয়স চার বছর। পঙ্গুত্বের কারণে সন্তানদের পুরো সময় দিতে পারেন না, ইচ্ছে করে অন্য মায়েদের মতো নিজের সন্তানদের করতে পারে না আদর যতœ। কিংবা স্বামীর প্রয়োজনে কাজে আসতে পারেন না তিনি।
রেবেকার স্বামী আরো বলেন,ক্ষতিপুরণ বাবদ ১৫ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময় চিকিৎসা জনিত ভুল তথ্যের কারণে ক্ষতি পুরণের ৫ লাখ টাকা কম পেয়েছি। ১৫ লাখ টাকার স্থলে পেয়েছি ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। ক্ষতিপুরনের সেই ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের লোভ্যাংশ হিসেবে প্রতিমাসে যা পাই,তা দিয়েই বর্তমানে আমাদের সংসার চলছে।