আশির দশকের একেবারেই শেষের দিকে তখনও উপকূলীয় উপজেলা খুলনার কয়রা-পাইকগাছায় প্রায় প্রতিটা পরিবারের গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর গোলাভরা ধান থাকতো। যাদের জায়গা জমি ছিল না, তারাও ভাগে জমি চাষ করে নূন্যতম বছরের খোরাকিটা ঘরে রাখতো। পাইকগাছায় একটি ইউনিয়ন লতার ভৌগলিক আয়তন অনুসারে ১৩% বনভূমি/বৃক্ষরাজি (সবুজে সমারহ) ছিল, যেটা নেমে এসেছে প্রায় শুন্যের কোটায়। ৯০ দশকের প্রারাম্ভেই লতার মানুষের ভাগ্যে কালো মেঘের পূর্বাভাস দেখা দেয়। শুরু হয় ওয়াপদা কেটে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করানোর গুনজন। অবশেষে স্থানীয় কিছু স্বার্থন্বেষী মানুষের সহায়তায় তৎকালীন প্রবল প্রতাপশালী ওয়াজেদ সাহেব বহিরাগত কিছু জমির মালিককে ম্যানেজ করে বিঘা প্রতি নাম মাত্র হারি দিয়ে বাগদা চাষ শুরু করে। লতার প্রাণ অথ্যাৎ গয়সা এবং পোদা নদী/খাল যার আয়তন ছিল প্রায় ১২১ একর। যে খালগুলো দিয়ে ১৮/১৯ নম্বর পোল্ডারের ১৮টি গ্রামের পানি নিষ্কাশন হতো। অতিবৃষ্টি বা কোন বন্যায় যদি উক্ত এলাকা পানিতে প্লাবিত হতো তাহলে ৬ ঘন্টার ব্যবধানে এই গয়সা/পোদা খাল দিয়ে পানি নেমে যেত। সেই গয়সা কিংবা পোদার খাল এখন মৃত প্রায়। যার আয়তন এখন অর্ধেকের ও নিচে নেমে এসেছে। অনেকাংশ ভূমিদস্যুরা গিলে ফেলেছে। সবচেয়ে হতাশা এবং দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো লতার ভৌগলিক হৃদস্পন্দন এই খাল দুটি নব্বই দশকের পর থেকে বহিরাগতদের দখলে। যে খাল গুলো দিয়ে অবাধে পানি নিষ্কাশন হতো। সেই খাল এখন ১২-১৫টি খন্ডে বিভক্ত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বলার বা দেখার কেউ নেই। প্রতিবছর বর্ষার সময় এই খাল পাড়ের মানুষ জলাবদ্ধতার স্বীকার হচ্ছে। ৯০ দশকের শুরুতে লতায় লবণপানি প্রবেশ করলো। নীল নঁকশা অনুসারে বাগদা চাষ শুরু হলো আর লতার সাধারণ মানুষদের নিষ্পেষিত করে প্রতিনিয়ত সুবিধাভোগ করতে থাকলো তথাকথিত কিছু দালালচক্র। লতার আপামর জনসাধারণ শতকারা ৯০% মানুষ লবণ পানির বিরুদ্ধে এবং তৎকালীন ঘের মালিক ওয়াজেদ আলীর বিরুদ্ধে তিব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। লতার আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা সকল স্তরের মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দেয়।
দফায় দফায় উপজেলায় হাজার হাজার মানুষের স্লোগান, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিস ঘেরা, থানা ঘেরা ইত্যাদি কর্মসূচী। এই আন্দোলনের মহানায়ক ছিলেন বর্তমান মহান জাতীয় সংসদের মাননীয় সংসদ সদস্য উপকূলীয় বন্ধু মো. রশীদুজ্জামান। তারপর নিরবাচ্ছিন্ন অন্ধকার ইতিহাস। ওয়াজেদ আলী মামলা করল লতার অসহায় মানুষের নামে। লুট, মার্ডার, অগ্নি সংযোগসহ আরো অনেক কিছু মামলা করে। পুলিশ প্রশাসন মাঠে নামলো, গণহারে শুরু হলো গ্রেফতার। শ্যামল, গোপালসহ অনেককে রিমান্ডে দিল। তারপর জেল হাজতে প্রেরণ। ওই সময় কোন পুরুষ মানুষ এলাকায় থাকতে পারতো না পুলিশের ভয়ে। এই আন্দোল ছড়িয়ে পড়লো পাইকগাছা উপজেলার অন্য ইউনিয়নে। ৪নং দেলুটি ইউনিয়নে প্রকাশ্যদিবালোকে ওয়াজেদ আলীর বাহীনি মিছিলে গুলি করে করুনাময়ের মাথার খুলি উড়িয়ে দিল। তারপরও প্রশাসন ও নেতাদের কব্জা করে সেই ওয়াজেদ আলী উপজেলাব্যাপী লবণপানি বহাল রেখে তৎকালীন সরকার প্রধানের কাছ থেকে সোনার ম্যাডেল নিয়ে বাগদা চিংড়ি চাষ তিব্র থেকে তীব্রতর করলো। এদিকে ওইসব মানুষ যারা বিনা কারনে জেলে তাদের পরিবার হয়ে গিয়েছিল অচল, তাদের সংসারে ছেলে মেয়ে, স্ত্রী না খেয়ে দিনতিপাত করতো। বাধ্যহয়ে তৎকালীন ধামাচাপাদের ষড়যন্ত্রে আন্দোলন স্থমিত হতে বাধ্য হয়। ওয়াজেদ আলীর সাথে আপোষ করিয়ে দেওয়া হয়, যারা আপোষ করে দিয়েছিল তারা পেয়েছিল মোটা অংকের টাকা আর যারা আপোষে বাধ্য হলো তারা পেল শুধু জেল থেকে মুক্তি। তারপর প্রতিবার নির্বাচন আসে, লোনাপানি, লতার পোদা নদী, গয়সার খাল ইস্যু হয়। নির্বাচন হয়ে যায় নতুন নতুন মূখ ক্ষমতায় আসে আর লোনাপানি নিয়ে কেউ কথা বলে না বরং দেখা যায় ঘের মালিকদের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক করতে। সেই ওয়াজেদ সাহেব মৃত্যু হয়েছে, মিশে গিয়েছে মাটির সনে কিন্তু এখন জন্ম হয়েছে লোনা পানির পৃষ্টপোষক অন্য অনেক সাহেবের।
বিরতিহীনভাবে লোনা পানিতে বাগদা চাষ হতে থাকে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসলে লতা ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্র সমাজ লতার সকল শ্রেণীর পেশাজীবিকে নিয়ে জনমূখী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। প্রতিগ্রামে ওয়ার্ডে কমিটি করা হয়। নেওয়া হয় গণস্বাক্ষর। প্রেরণ করা হয় সরকারের বিভিন্ন দফতরসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্ঠা এবং সেনাবাহিনীর প্রধানের কাছে। প্রথমঅলো, এনটিভি, বিবিসিসহ অনেক মিডিয়ায় ইস্যু হয় লবণপানি। পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটির ব্যানারে এই আন্দোলনে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামনের সারিতে নিঃস্বার্থভাবে দাঁড়িয়ে ছিল লতার সিরাজুল ইসলাম, নিউটন রায়, নিউটন মিস্ত্রি, কুমারেশ মন্ডল এবং সনজিত সরকার তাদের মধ্য অন্যতম। এই আন্দোলন চলাকালীন সময় লতা ইউনিয়নের বামনেরাবাদ গ্রামের অসীম, তেঁতুলতলার কালিদাস, গোবিন্দসহ ১৮ জন নিরাপরাধ মানুষের নামে মার্ডার মামলা দেওয়া হয়। সুপ্রীম কোর্টের অ্যাড. লতার কৃতি সন্তান লুসার সাবেক সফল সভাপতি সব্যসাচী মন্ডলের সহযোগিতায় তাদের জামিন করাতে সক্ষম হন। ১ বছর আন্দোলনের শেষান্তে সেনবাহিনীর ১৮৮ ব্যাটেলিয়ান থেকে ইউনিয়ন পরিষদকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হলো লতা ইউনিয়নে স্লুইস গেট দিয়ে লবণপানি প্রবেশ করবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঐ চিঠি গায়েব করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আন্দোলনকারীরা ঐ চিঠি ম্যানেজ করে এবং আবার আন্দোলনে সচেষ্ট হয়।
এরপর ২০০৮ এর জাতীয় নির্বাচন এবং সরকার গঠন। নেতৃস্থানীয় পর্যায় থেকে বলা হলো দীর্ঘদিনের জঞ্জাল একদিনে পরিষ্কার করা যাবে না সময় লাগবে। সময়ের সাথে সাথে ৩৫ বছর লবণ পানির সাথে এ অ লের মানুষ সয়ে গিয়েছে। সোনারমাটি এখন বিষ মাটিতে উন্নীত হয়েছে। এখন এই সোনার মাটিতে না হয় মাছ না হয় ধান। জলাভূমি আর বিরণভূমিতে পতিত এই অ লের জনপদ। বিষাক্ত লোনা পানির কোরাল গ্রাসে প্রতিটা পরিবার ঋণে জর্জরিত। আবার এখন কিছু নতুন মুখ লোনা পানির আন্দোলন স্বল্পপরিসরে শুরু করেছে। কিন্তু এই আন্দোলনের খুব বেশি প্রয়োজনীয়তা আছে বলে অতিতে লবণ পানি বিরোধী আন্দোলনকারীরা মনে করেন না। কারন এই মাটি ও মানুষের সাথে যার নিবিড় সম্পর্ক, যার প্রতিটা ভোর শুরু হয়েছে লবণপানি বিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে, যার একটি ইশারায় উপজেলার হাজার হাজার মানুষ লবণপানি বিরোধী শ্লোগানে মুখরিত ছিল, সেই প্রিয় মানুষ উপকূলীয় বন্ধু মো. রশীদুজ্জামান এখন কয়রা-পাইকগাছা সর্বচ্চো ক্ষমতার অধিকারী, একজন আইন প্রনেতা, মহান জাতীয় সংসদ সদস্য। আন্দোলন তখনই প্রয়োজন হয় যখন সরকার সেই অ লের মানুষের অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সুতরাং এ জনপদের মানুষের সেই ভয়টা এখন একেবারেই নেই। এমপি মহোদয়ের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৫ সালে ওয়াপদা/স্লুইস গেট দিয়ে কোন লবণপানি উঠবে না।
লতা ইউনিয় পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটি সভাপতি সনজিত সরকার বলেন, প্রাণের মানুষের এই স্বপ্ন পূরণে আমরা নিঃসন্দেহে ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংগঠিত! এই মূহুর্তে লতার ইস্যুতে যে জায়গায় গুরত্ব দেওয়া অতীব জরুরী সেগুলো বিবেচনার জন্য মাননীয় এমপি মহোদয়সহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। ১. লতার গয়সা এবং পোদা নদী আগামী বছরে ইজারা না দিয়ে জনস্বার্থে উন্মুক্ত করা এবং খনন কার্য পরিচালনা পূর্বক স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনা। ২. ১৮, ১৯ ও ২০ নম্বর পোল্ডারে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। এই ৫০ হাজার মানুষ অচিরেই জলাবদ্ধতা স্বীকার হবে যদি এখন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা না হয়। এই পোল্ডারগুলোর মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে গুনখালী নদী।
উত্তরদিকে এই নদীর এতটাই খারাপ অবস্থা যে, ভাঁটার সময় হেঁটে পার হওয়া যায়। সমতলভূমি অথ্যাৎ যেখানে আমরা মাছ চাষ করি বা অচিরেই ধান চাষ করবো সেটা নদীর থেকে নিচু হয়ে যাচ্ছে। ফলে একটু বৃষ্টি হলে বা কোন ধরনের বন্যা হলে এই পানি আর নদী দিয়ে নিষ্কাষিত হবে না। তখন সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতার এবং পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। তাই এখন যদি জরুরী ভিত্তিতে লতার ত্রিমোহনী অথ্যাৎ লতা-মুনকিয়া খেয়াঘাট বরাবর গেট করে বেঁধে দেওয়া না হয় তাহলে আগামী ৮-১০ বছরের মধ্যে গুনখালী নদী মরে যাবে এবং ১৮, ১৯ এবং ২০ নম্বর পোল্ডারের মানুষ জলাবদ্ধতার স্বীকার হবে। এখানে বেঁধে দিলে খুব সহজে এই পোল্ডারগুলো যেমন লোনামুক্ত হবে ঠিক তেমনি সৃষ্টি হবে সম্ভাবনাময় স্বগৌরবে সমৃদ্ধ একটি অর্থনৈতিক অ ল।