কোন পত্রিকা, টেলিভিশন বা অনলাইন পোর্টালের প্রতিনিধি নেই। কোন সাংবাদিকও নেই। তাহলে সাংবাদিক সমিতি কিসের? তবে কারা কি কাজে ব্যবহার করেন এমন অদ্ভুত সমিতি? বলা হচ্ছে এটা নাকি একটা ক্লাব। যার নাম নাকি সাংবাদিক সমিতি! এর আছে অফিস, ফেসবুক পেজসহ নানা সাংগঠনিক সুযোগ-সুুবিধাও। এমনই এক সাংবাদিক সমিতির অস্তিত্ব মিলেছে দেশের অন্যতম নামী ও সাম্প্রতিক সময়ে আন্দোলনের জন্য আলোচিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যলয়ে (বুয়েট)।
একদল শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মধ্যে বিষয়টি জানার পর গত দু'দিন ধরে বুয়েট সাংবাদিক সমিতির সঙ্গে জড়িত ছাত্রসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেল উদ্বেগজনক নানা তথ্য। জানা গেল, এ সমিতির সদস্য হিসেবে আছেন হাওরে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় আটক ও মামলার আসামি (এখন জামিনে আছেন) অন্তত ছয় ছাত্র। আটকের সময় যাদের শিবির সংশ্লিষ্টতার কথা সুনামগঞ্জ জেলা জামায়াত নেতারাও গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন। এমনকি তাদের আদালতে আনা হলে সেখানে জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে তাদের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। হাওরের ঘটনায় মামলার আসামি; আবার এ সমিতির সঙ্গেও আছেন এমন ছয়জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন মো: ফাহাদুল ইসলাম, খালিদ আম্মার, তানভীর আরাফাত ফাহিম, মাইনুদ্দিন, মো: মাহমুদুল হাসান ও মো: সাইদ আদনান অপি।
বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যেই এ ধরনের সমিতি পরিচালনা নিয়ে আছে ব্যাপক মতবিরোধ। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা নিজেরা গড়ে তোলেন সমিতি। বিরোধের কারণে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক সমিতিও আছে। রয়েছে অফিস। সাধারণত কিছু বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিধি দিয়ে থাকে গণমাধ্যমগুলো। তাদের কাজ হচ্ছে যার যার প্রতিষ্ঠানের খবর অফিসে পাঠানো। যেমন জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিরা নিজ নিজ অফিসের জন্য কাজ করেন। সাংবাদিক সমিতি বললে এমনটাই সবাই বুঝে থাকেন।
তুলনামূলকভাবে ছোট ও পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাকায় এখানে গণমাধ্যমগুলো প্রতিনিধি দেয়ায় আগ্রহ দেখায় না। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিই বুয়েটের নিউজ সংগ্রহ করে থাকেন। কিন্তু এখানেও যে একটা অদ্ভুত সাংবাদিক সমিতি আছে তা এবার আন্দোলনের সময় প্রকাশ হয়ে পড়েছে কেবল গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে।
সোমবার (১ এপ্রিল) বেলা তিনটার দিকে সমিতির পাশেই কথা হচ্ছিল কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। সমিতির কাজ কি? কিভাবে চলছে? এমন প্রশ্নে মনে হলো উপস্থিত পাঁচ শিক্ষার্থীই একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বললাম ভয়ের কিছু নেই। কারো নাম লিখব না।
এবার এক শিক্ষার্থী বললেন, ‘এমনিতেই আন্দোলন নিয়ে ভয়ে ভয়ে আছি। আমরা আন্দোলনে থাকতে চাইনি। তাও গেছি ভয়ে। এখানে যে পরিস্থিতি তাতে না গেলেও বিপদ তাই আন্দোলনে ছিলাম। আমি এই সমিতিতে আছি তবে এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে বিতর্ক আছে।’ কিন্তু কেন? উত্তরে বললেন, ‘আমাদের অধ্যাদেশে বিভিন্ন ক্লাবের কথা বলা আছে। সেখানে কোন ক্লাবের কি কাজ তাও বলা আছে। কিন্তু সাংবাদিক সমিতি নামে কোন ক্লাব করার সুযোগই আসলে নেই। তাছাড়া সাংবাদিকই নেই। তাহলে সাংবাদিক সমিতি কিভাবে থাকে।’
কথা বলে জানা গেল, বুয়েটে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’র ব্যানারে দফায় দফায় আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ছাত্ররা সংগঠিত হয়ে এ ধরনের সমিতি গঠনের জন্য বেশি সক্রিয় হয়। এটি আবার ছাত্র কল্যাণ অফিস দেখভাল করার কথা।
তবে আববার হত্যার পর থেকে ছাত্র কল্যাণ অফিস অনুমোদিত ‘সমিতি’ হলেও এটি ব্যবহার হচ্ছে মূলত আন্দোলনে থাকা একটি বিশেষ গোষ্ঠীর নিজেদের স্বার্থে। নাম সাংবাদিক সমিতি হওয়া নিয়ে যেমন বিতর্ক আছে তেমনি এটি হওয়ার কথা ছিল শিক্ষার্থীদের কারিকুলাম ও কো-কারিকুলাম সংক্রান্ত তথ্য শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য। একটি ফেসবুক পেজ থাকবে, যেখানে শিক্ষার্থীদের কারিকুলাম ও কো-কারিকুলাম সংক্রান্ত তথ্য জানানোর কথা। একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আববার হত্যার পর থেকে সেই কমিটির যেন মূল কাজই হচ্ছে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানো। এবার আন্দোলন শুরুর আগ থেকেই যেন উস্কানিমূলক তৎপরতায় সক্রিয় কথিত এ সাংবাদিক সমিতি।
নিহত আবরার ফাহাদের ভাই আবরার ফাইয়াজ নিজেই ফেসবুকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে উস্কানি শুরু করেন এবার। ছাত্রলীগের সভাপতির রাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে শিক্ষার্থীদের উস্কে দিতে তিনি লিখেন, ‘বুয়েটকে ছাত্রলীগের কমিটি দেয়ার ভেন্যু হিসেবে ব্যবহার করালো’ তিনি আরো লিখেন, ‘রাত তিনটায় ছাত্রলীগের ৫০ জনের অধিক বহিরাগত নেতাকর্মী গার্ডদের সাথে জোরাজুরি করে প্রবেশ করলো।’ অথচ তার বক্তব্যের কোন ভিত্তি পাওয়া যায়নি গত কয়েক দিনেও। এমনকি শিক্ষার্থীরা সিসি ক্যামেরার ভিডিও থেকেও এমন তথ্যের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়।
তবে আবরারের ভাইয়ের এ গুজব ঠিকই প্রচার করা হয় সাংবাতিক সমিতির পেজ থেকে। এদিকে লাগাতার গুজব ছড়িয়ে বুয়েটকে অস্থিতিশীল করার ঘটনায় বুয়েটিয়ানদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বুয়েটের সাবেক ছাত্র রনক আহসান ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে বুয়েট ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ আবরার ফাইয়াজ!! মিথ্যা ও ঘৃণা ছড়িয়ে বুয়েট উত্তপ্ত করায় তার মতো সফলতা আর কেউ দেখাতে পারেনি। বুয়েটকে ভেন্যু হিসেবে ব্যবহার করে ছাত্রলীগের কমিটি দেয়া হচ্ছে- এই প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে বুয়েট অস্থির করার মাস্টারমাইন্ড এই আবরার ফাইয়াজ। এই তথ্য সন্ত্রাসীকে বুয়েট থেকে বহিষ্কার ও আইসিটি আইনের আওতায় এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
তবে বুয়েট সাংবাদিক সমিতি যে কেবল ফাইয়াজের গুজবই প্রচার করেছে তা নয়। এটি আন্দোলনকারিরা ব্যবহার করছেন উস্কানিমূলক নানা তথ্য ছড়ানোর কাজে। যেখানে পড়ালেখা ও কো-কারিকুলাম নিয়ে কোন কথা নেই বললেই চলে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, বুয়েট অনুমোদিত ক্লাব বা সমিতি একটি গোষ্ঠী আন্দোলনের কাজে কিভাবে ব্যবহার করতে পারে?
এদিকে তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরে সাংবাদিক সমিতির কর্মকাণ্ড নিয়ে ফেসবুকে দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছেন বুয়েটের সাবেক ছাত্র ও আওয়ামী লীগের ওয়েব টিমের সমন্বয়ক তন্ময় আহমেদ। তিনি লিখেছেন, বুয়েটের সাংবাদিক সমিতি! এরা কোন প্রতিষ্ঠিত বা রেজিষ্ট্রেশনপ্রাপ্ত কোন মিডিয়ার কোন প্রতিনিধি না। ২৮ তারিখ রাতে সেহরির সময় তারা গুজব করে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের উস্কানি দেয়। তারা দাবি করে বুয়েটে এসে ছাত্রলীগের নেতারা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়েছে গভীর রাতে, যেন সুবিশাল এক প্ল্যান বাস্তবায়নে নেমেছিল ছাত্রলীগ আর বুয়েটের কিছু ছাত্র। গুজবের সোর্স হিসেবে কাজ করার জন্যই শিবিরের ছেলেরা সাংবাদিক সমিতি দখল করে, রাব্বিকে বহিষ্কার করে। মজার বিষয় সাংবাদিক সমিতির ইসিতে থাকা ৪/৫ জন টাঙ্গুয়ার হাওরে গ্রেফতার হওয়া শিবিরের বিভিন্ন স্তরের কর্মী। তবে কি বুঝার বাকি থাকে এই আন্দোলনের নামে ক্যাম্পাসের একাডেমিক কার্যক্রম ব্যবহত করায় শিবির খুব সুচারুভাবে কাজ করেছে? বুয়েট অথোরিটি এদের কিছু করবে না, যা করার দেশের গোয়েন্দা বাহিনী আর পুলিশের করা উচিত। এদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বেড়িয়ে আসবে।’
ভোরের পাতা/আরএস