রোজায় খাবার সংকটে ভুগছেন বৃদ্ধাশ্রমের ২৭ বৃদ্ধা মা
আমার জীবন খুব কষ্টের। আমি বাসাবাড়ি ও রাস্তার কাজ করে ছেলে-মেয়েকে মানুষ করেছি। আমার ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাই আছে। আমি বৃদ্ধা হয়ে গেছি, কাজ করতে পারি না। আমাকে কেউ দেখাশোনা করে না। এজন্য গত ৫ বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রমে থাকি। বৃদ্ধাশ্রমের জীবনও অনেক কষ্টের। টাকাপয়সার অভাবে ইফতারের জিনিসপত্র কিনতে পারে না। অনেক সময় খাবারও কিনতে পারে না। ঘরের টিন ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি চলে আসে। আমাদের কাপড়, ওষুধ, ইফতারের কষ্ট। সবকিছুরই কষ্ট। আমরা চলতে পারছি না। ভাত দিয়ে ইফতার করতে হচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই্ বলছিলেন বৃদ্ধা আমেনা বেগম। তিনি বলেন, আমার ছেলের বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল এলাকায়।
ষাটোর্ধ্ব বয়সী সাজেদা খাতুন বলেন, ছেলে-মেয়ে আছে। তাদেরকে কষ্ট করে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। এখন তারা, যার যার মতো। যার যার কর্ম সে সে করছে। তারা তাদের ছেলেপিলে নিয়ে করে খাচ্ছে। আমি এখন বুড়োকালে বৃদ্ধাশ্রমে থাকি। আমাদের জীবনটা অনেক কষ্টের জীবন। ছেলে-মেয়ে থেকেও নেই। আগেকার জীবনের কথা বলতে গেলে কষ্ট বেড়ে যায়। সেসব কথা বলতে চাই না।
ষাটোর্ধ্ব বয়সী বৃদ্ধা সাজেদা খাতুন ও আমেনা বেগম থাকেন কুষ্টিয়া শহরের পূর্ব মজমপুর এলাকার উদয় মা ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে। অভাবি, অসহায়-দুস্থ ও স্বামী-সন্তানহারা বৃদ্ধ মায়েদের জন্য ১৯৯৯ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে সেখানে আমেনা বেগমের মতো জীবনের পড়ন্ত বেলায় অসহায় বৃদ্ধা ২৭ জন মা থাকেন। এসব অসহায় মায়েদের খাবার, চিকিৎসাসেবা, ওষুধ, পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করে পুনর্বাসন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। তবে আর্থিক অভাবের কারণে প্রয়োজনীয় খাবার, পোশাকসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার যথাযথ ব্যবস্থা করতে পারে না তারা।
সরেজমিনে গত বুধবার ইফতারের ১৫ মিনিট আগে উদয় মা ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বয়স্ক মায়েরা কেউ অজু করছেন, কেউবা বসে দোয়া-দরুদ পড়ছেন। কেউ ঘুমাচ্ছেন, কেউবা নামাজ পড়ছেন। কেউবা চুপচাপ ইফতার করার জন্য বসে আছেন। সবার চোখেমুখে কষ্টের ছাপ। রোজাদার বৃদ্ধা অসহায় মায়েদের জন্য থালায় ভাত তুলে দেওয়া হচ্ছে। মসজিদের মাইকে ইফতারের ঘোষণার সাথে সাথে চিনির শরবত দিয়ে ইফতার শুরু করেন। এরপর ভাত খাওয়া শুরু করেন তারা। অর্থের অভাবে ইফতার সামগ্রী কিনতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এজন্য ভাত দিয়ে একবারে রাতের খাবার ও ইফতার সম্পন্ন করেন বলে জানিয়েছেন ভাগ্যতাড়িত অসহায় মায়েরা ও কর্তৃপক্ষ।
নসিরন খাতুন বলেন, আমার দুইটা মেয়ে হয়েছিলো। তাদের ছোট রেখে আমার স্বামী মারা গেছে। আমি অফিসারদের বাসায় কাজ করতাম। কাথা সেলাই করতাম। এভাবে অনেক কষ্টে মেয়ে দুটিকে বড় করেছি। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার তো ছেলে সন্তান নাই। এজন্য ২০ বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রমে থাকি। বৃদ্ধাশ্রমে টাকার অভাবে ইফতার কিনতে পারে না। এজন্য আমরা ভাত খেয়ে ইফতার করি। টাকার অভাবে ইফতার কিনতে পারছি না। এছাড়াও টাকার অভাবে থাকা, খাওয়া, কাপড়চোপড় ও চিকিৎসার কষ্টে আছি। আমাদের সবাই সহযোগিতা করেন।
৭০ বছর বয়সী আয়েশা খাতুন বলেন, আমি নিঃসন্তান। আমার ছেলে-মেয়ে নাই। ঘর-বাড়ি নাই, থাকার জায়গা নাই। আমার ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন আছে। তারা আমার দেখাশোনা করে না। ১০ বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছি। মরণের আগ পর্যন্ত এখানেই থেকে যাব। অর্থের অভাবে আমাদের খাওয়ার কষ্ট হয়। টাকার অভাবে ইফতার কিনতে পারে না। আমরা ভাত দিয়ে ইফতার করি। আপনারা আমাদের সাহায্য করুন।
আনজিরা খাতুন বলেন, আমার ছেলে-মেয়ে আছে, তারা দেখাশোনা করে না। আমি ৫ বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রমে আছি। আমি অনেক আগে থেকে অসুস্থ। হার্টের অসুখ, টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারি না।
উদয় মা ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আফরোজা ইসলাম বলেন, প্রায় ২২ বছর ধরে অসহায় নারীদের নিয়ে কাজ করি। আমাদের কাছে অনেক অসহায় নির্যাতিত মা রয়েছে। যাদের সংসারে ঠাঁই নেই। সন্তান জন্ম দিয়েছে, বড় করেছে। এখন সেই সংসারে মায়ের জায়গা নেই। পরনের কাপড় ও পেটের খাবারের জন্য তারা আমাদের এখানে আছে। মানুষের মা মরে একবার। আর আমাদের মা মরে বারবার। অনেক মা এখানে মারা গেছেন। মানুষের সহযোগিতায় বৃদ্ধাশ্রম চলে। রমজানে তাদের জন্য ইফতার সামগ্রী কিনতে পারি না। আজ ভাত খেয়ে ইফতার করেছে। অর্থের অভাবে মায়েদের চিকিৎসা করাতে পারি না। ঠিকমতো খাওয়াতে পারি না। থাকার কষ্ট রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইফতেখার হোসেন মিঠু বলেন, প্রায় দুই যুগ আগে আমার মায়ের মৃত্যু হয়। মায়ের মৃত্যুর পরে মায়ের জয়গাটা পূরণ করার জন্য কয়েকজন বৃদ্ধা মাকে নিয়ে উদয় মা ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করি। আমরা অনেক কষ্ট করে এই প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছি। রিজিকের ব্যবস্থা আল্লাহ করে দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। রমজানে বৃদ্ধাশ্রমের মায়েরা রোজা রাখেন। অর্থের অভাবে তাদের ইফতার সামগ্রী ও সেহরিতে প্রয়োজনীয় খাবার ঠিকমতো কিনতে পারি না। ভাড়া বাসায় মায়েরা থাকে। বৃষ্টি হলে টিনের ফুটো দিয়ে ঘরের মধ্যে পানি চলে আসে। বিছানাপত্র ভিজে যায়। অর্থের অভাবে মায়েদের অনেক কষ্ট হয়। সরকার ও বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতার আবেদন জানাচ্ছি।