একটা সময় রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকাটি কেবল আবাসিক এলাকা হিসেবেই পরিচিত ছিল। সময়ের পরিবর্তনে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের দুই পাশে গড়ে উঠেছে অফিস, হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে এই এলাকায় বাইরের মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে। বাড়তি মানুষের চাহিদা বিবেচনায় গড় উঠতে শুরু করে একের পর এক রেস্টুরেন্ট। গত কয়েক বছরে ‘রেস্টুরেন্ট জোন’ হিসেবে খ্যাতি পেয়ে গেছে ধানমন্ডি। সাত মসজিদ রোডের পাশে এমন অনেক ভবন আছে, যেসব ভবনে ১০ থেকে ১৫টি পর্যন্ত রেস্টুরেন্ট আছে।
সাত মসজিদ রোডে চলাফেরা করেন না এমন মানুষও এই এলাকার একাধিক রেস্টুরেন্ট ভবনের নাম চোখ বুজে বলে দিতে পারবেন। তবে, ভবনগুলো কতটা নিরাপদ সেটি নিয়ে হয়ত কখনও ভাববেন না তারা। যেকোনো সময় বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের মতো আগুনে ঝলসে যেতে পারে এসব রেস্টুরেন্টে খেতে আসা মানুষের জীবন।
একটি ভবন নিরাপদ কি না, সেটি দেখতে বেশ কয়েকটি বিষয় খেয়াল করতে বলেন বিশেষজ্ঞরা। এসবের মধ্যে আছে — প্রকাশ্যে ‘সার্টিফিকেট’ প্রদর্শন করা আছে কি-না; প্রবেশদ্বার তিন মিটারের কম না হওয়া; পর্যাপ্ত সিঁড়ি ও অ্যালার্ম সিস্টেম থাকা; জরুরি বহির্গমন পথ আছে কি না; আগুন লাগলে ‘এক্সিট সাইন’ জ্বলার সিস্টেম আছে কি না; ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আছে কি না; মিশ্র ব্যবহারের ভবনে না যাওয়া; ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোল সিল করা; স্প্রিংকলার সিস্টেম আছে কি না এবং ভবনের ডিজাইন ও উদ্দেশ্য পরিবর্তন করা হয়েছে কি না।
দুপুর থেকে লোকজনের আনাগোনা শুরু হলেও সন্ধ্যা নামার পরেই ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোডে যেন আলোর ঝলকানি বেড়ে যায়। শংকর থেকে শুরু করে জিগাতলা পর্যন্ত আপনি সড়কের যে পাশেই তাকান না কেন, সুউচ্চ বিল্ডিংগুলো বাহারি আলোকসজ্জায় আপনাকে আকৃষ্ট করবে। প্রতিটি ভবনই কাঁচে ঘেরা। কোনো কোনো ভবনের গায়ে নিয়ন আলোর সাইনে দেখতে পাবেন উড়ন্ত কফির দৃশ্য অথবা বাবুর্চির কোনো সাইন বা রেস্টুরেন্টের নাম।
তরুণ-তরুণী কিংবা অল্প বয়সীদের আকৃষ্ট করতে কোনো কোনো রেস্টুরেন্টে আছে স্মোকিং জোন। ফলে উঠতি বয়সীরা তো বটেই, বাকিদেরও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু থাকে এসব রেস্টুরেন্টগুলোতে। সাধারণের পাশাপাশি বিয়ের অনুষ্ঠান, পার্টি আয়োজনের ব্যবস্থাও রয়েছে এসব রেস্টুরেন্টে।
ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোড়ের রেস্টুরেন্ট ভবনগুলোর মধ্যে অন্যতম পরিচিত কে বি (কেরামত আলী ভূইয়া) স্কয়ার। ১৩ তলা ভবনটিতে অন্তত ১২/১৩টি রেস্টুরেন্ট আছে। ভবনটির অবস্থান ধানমন্ডির ১৫ নম্বরে অবস্থিত ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বিপরীত পাশে। এই এলাকার ফুটওভার ব্রিজের একটি র্যাম্প এসে নেমেছে ভবনটির সামনে।
রোববার (৩ মার্চ) দুপুরে ভবনটি ঘুরে দেখা যায়, নিচতলা ও দুই তলা মিলিয়ে রয়েছে টুয়েলভস ও জেন্টল পার্ক নামে পোশাকের দোকান। দুই দোকানের মাঝ বরাবর আড়াই মিটার প্রশস্ত একটি করিডোর রয়েছে। করিডোরের শেষ মাথায় রয়েছে দুটি লিফট। যেখানে ৬-৮ জন মানুষ উঠতে পারে। লিফটের ডানপাশে রয়েছে সাধারণ সিঁড়ি এবং বাম পাশে রয়েছে ফায়ার এক্সিটের সিঁড়ি। সাধারণ সিঁড়ির সামনে প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে ফায়ার এক্সটিংগুইশার, ফায়ার অ্যালার্ম ও এক বালতি বালি। তবে আগুন লাগলে এত বড় ভবনের নিরাপত্তার জন্য এসব যথেষ্ট কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
ভবনের তৃতীয় তলায় রয়েছে ওজোন ও চিজ নামে রেস্টুরেন্ট; চতুর্থ তলায় রয়েছে টেকআউট নামের একটি রেস্টুরেন্ট ও বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ ক্লিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি পার্লার নামের একটি প্রতিষ্ঠান। পঞ্চম তলায় রয়েছে ম্যাডশেফ নামের একটি রেস্টুরেন্ট। ভবনের ষষ্ঠ তলায় রয়েছে বারাক পিআরপি মেডিকেল সেন্টার। গ্রিন রিভাইব হেলথ কেয়ার নামে একটি স্ক্রিন কেয়ার ক্লিনিক রয়েছে সপ্তম তলায়। অষ্টম তলায় রয়েছে মুনচেরি রেস্টুরেন্ট, নবম তলায় রয়েছে ওরাবি রেস্টুরেন্ট, ১০ম তলায় রয়েছে গুহা নামের একটি রেস্টুরেন্ট, ১১তম তলায় রয়েছে ট্রিট ক্যাফে, টেস্ট ব্লাস্ট ও দ্য ডার্ক ক্যাফে নামে তিনটি রেস্টুরেন্ট। ১২ তলায় রয়েছে জেন্টেলম্যান বিলিয়ার্ড সেন্টার এবং সর্বশেষ ১৩ তলায় একটি নতুন রেস্টুরেন্টের কাজ চলমান রয়েছে।
খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় ভবনে থাকা রেস্টুরেন্টগুলোর সিলিন্ডার রাখা হয়েছে ভবনের পেছনের খালি অংশে। সিলিন্ডার খালি হলে ভবনের পেছন দিক থেকে এসে পার্কিং র্যাম্পের পাশ দিয়ে সিলিন্ডার পরিবর্তন করতে হয়।
পুরো ভবন ঘুরে দেখা গেছে, ভবনের কোথাও কোনো প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট প্রদর্শন করা নেই। প্রতিটি ফ্লোরে সিঁড়ি ও ফায়ার এলার্ম সিস্টেম রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে আলাদা করে একটি জরুরি বহির্গমন পথ। তবে আগুন লাগলে ‘এক্সিট সাইন’ জ্বলে থাকবার যে ডিসপ্লে, সেটি ভবনের কোথাও দেখা যায়নি। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রয়েছে প্রতিটি ফ্লোরে। ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোল সিল করা রয়েছে বলে ভবন ঘুরে মনে হয়েছে। তবে, তাপ উৎপন্ন হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছিটানোর স্প্রিংকলার সিস্টেম চোখে পড়েনি।
ভবনটি সম্পর্কে কে বি স্কয়ারের ম্যানেজার আক্তারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভবনে দুটি সিঁড়ি ও দুটি লিফট আছে। জরুরি বহির্গমন পথে কোনো প্রতিষ্ঠান যেন মালামাল রাখতে না পারে, সেজন্য নির্দেশ দেওয়া আছে। ভবনে এখন ১০টি রেস্টুরেন্ট আছে। আরও ছিল, তারা চলে গেছে। রেস্টুরেন্টের সিলিন্ডার রাখা হয়েছে ভবনের বাইরে। ভবনে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের জায়গা আছে। আমি বিষয়টি নিয়মিত তদারকি করি। ভবনে কোনো অসুবিধা নেই। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ভয়াবহ আগুনে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় রাজধানীর বেইলি রোডের ৭ তলা ভবন গ্রিন কোজি কটেজ। ধারণা করা হচ্ছে, ভবনে থাকা রেস্টুরেন্টগুলোর গ্যাস সিলিন্ডারের কারণেই সেখানকার আগুন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ওই ঘটনায় আগুনে পুড়ে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে সারা দেশে মোট ২৭ হাজার ৬২৪টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কয়েকশ’ মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন।
নিরাপদ ভবন মানুষ কীভাবে চিনবে, সে প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, একটা ভবন নিরাপদ কি না, সেটি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না; রাষ্ট্র এখানে সবচেয়ে বড় অপরাধ করছে। যেহেতু রাষ্ট্র এখনও শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারছে না যে তার রাষ্ট্রের সব ভবন নিরাপদ; সেহেতু একটি ভবন যে নিরাপদ, সেটির অনুমোদন প্রকাশ্যে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা জরুরি। সার্টিফিকেট একটি উন্মুক্ত স্থানে সাধারণের জন্য প্রদর্শন করতে হবে।
তিনি বলেন, কোনো জনাকীর্ণ ভবনের প্রবেশদ্বার যদি তিন মিটারের কম হয়, তাহলে সেখানে প্রবেশ করার আগে ভাবা উচিত।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক মেজর একেএম শাকিল নওয়াজ বলেন, আগুন লাগার পর একটা মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য ভবনে মূলত দুইটা জিনিস থাকা দরকার। একটি হচ্ছে পর্যাপ্ত সিঁড়ি এবং অন্যটি হচ্ছে অ্যালার্ম সিস্টেম। আর কিছুর দরকার নেই। কোনো আবাসিক ভবন যদি ছয় তলার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আইন অনুযায়ী সেখানে চলাচলের জন্য দুটি সিঁড়ি থাকতে হবে। তবে যেগুলো বাণিজ্যিক ভবন বা কারখানা, সেখানে সিঁড়ির সংখ্যা আরও বেশি হবে।
তিনি বলেন, ভবনটি কাচঘেরা আবদ্ধ জায়গায় হলেও তার কোনও না কোনো ধরনের উন্মুক্ত ব্যবস্থাপনা (জরুরি বহির্গমন পথ) থাকতে হবে। ভবনে এই ব্যবস্থাপনা না থাকলে আমার সন্তানকে নিয়ে আমি সেখানে ঢুকব না, যাব না, অফিস করব না, খাব না। আগুন লাগলে জ্বলে ওঠে, এমন এক্সিট সাইন ও ডিরেকশন থাকতে হবে। সিনেমা হলে যেরকম এক্সিট এবং এন্ট্রি চিহ্ন থাকে, ঠিক সেরকম। কোনো ভবনে প্রবেশের আগে সেই ভবনে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আছে কি-না এবং থাকলে সেটি আদৌ কাজ করছে না, সেটি দেখে নেওয়া উচিত।
ভোরেরর পাতা/আরএস