পাগলা পুলের দুলাই নদীর ওপর মধ্যযুগের নান্দনিক স্থাপনা
আরিফুর রহমান
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৮:৩৯ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
১৮২৪ সালের জুলাই মানের এক সন্ধ্যায় রাবার্ট মিটফোর্ডের অসম্ভব সার লোকায় চেপে পাগলা পুলের খুব কাছে গিয়েছিলেন বিমল হেবার। এটিকে তখন টিউডর গোথিকের আমলে নির্মিত বলেই মনে হয়েছিল তার। সেতুটিকে এশিয়াটিক স্থাপত্য শৈলীর বলা যাবে কিনা তা নিয়ে তিনি দ্বিধায় ছিলেন। ওই সময়ই রবার্ট মিটফোর্ডের নৌকার বলে বসলেন-এটি নির্মাণ করেছেন একজন যয়ারী। সেই ফরাসী যে জঁ ব্যাপ্টিস্ট ট্যাভার্নিয়ের (১৬০৫-১৬৮৯) সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। কারণ, তার বয়ানেই পাগলা পুল সবচেয়ে বেশি করে ধরা দিয়েছে।
১৬৭৬ সালে প্রকাশিত এক গ্রন্থে পাগলা পুলের বিশদ বর্ণনা দিতে গিয়ে ট্যাভার্নিয়ের লিখেছেন, ‘১৬৬৬ সালের ১৩ জানুয়ারি দুপুরে ঢাকা থেকে দুই কোশ দূরে লক্ষ্যা নদীর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। নদীটি এসেছে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা যেখানে মিলিত হয়েছে তার ঠিক বিপরীতেই ছিল একটি দুর্গ। এর সব পাশেই বেশ কিছু কামান বসানো ছিল। আধা কোশের মতো নিচের দিকে গেলেই আরেকটি নদী-পাগালু। এই নদীর ওপরই মসৃণ ইটের তৈরি একটি সেতু। মীর জুমলা এটি নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন।’ ট্যাভার্নিয়েরের বয়ানে উঠে আসা এই সেতুই ঐতিহাসিক পাগলাপুল। মধ্যযুগে নির্মিত পাগলা পুল সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল সম্ভবত ঢাকার কালেক্টর চার্লস ডি’ওইলিকে। জে.পি. লাস্টির ভাষায়, সেতুটি রীতিমতো মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাকে। চার্লস ডি’ওইলির অংকনেরও গুরুত্বপূর্ণ উপজীব্য হয়ে উঠেছিল সেতুটি। পাগলা পলের মোট দুটি চিত্র পেনসিলে এঁকেছিলেন তিনি। তবে ‘পাগলা গুল, ফ্রম দ্য রিভার’ শিরোনামের চিত্রটিই বেশি পরিচিত জর্জ ফ্রান্সিস হোয়াইটের পেনসিল চিত্র, চার্লস শুনা নিকোলাসের পেনসিল ও কালির ওপর ওয়াটারকালারের সাথে সহজেই তুলনা করা যায় ডি’ওইলির এই চিত্রকর্মকে।
পাগলা নিয়ে চার্লস ডি’ওইলির এই আগ্রহের বিষয়ে বিশপ হেবার ছাড়াও আরও একজন অবগত ছিলেন। তিনি হলেন গড়তে চার্লস মাক্তি। ১৮২৯ সালের ১০ মার্চ গডফ্রে বলছেন, ‘নৌকায় চেপে আমরা যখন বুড়িগঙ্গা দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন পাঁচ মাইলজুড়ে চোখে পড়ে আধা-ধ্বংসপ্রাপ্ত, আধা-বসতোপযোগী চমৎকার সব অবকাঠামো। এগুলোই ঢাকাকে গড়েছে। খুব প্রাচীন কিছু নিয়ে ঢাকার গর্ব করার সুযোগ সেভাবে না থাকলেও অসংখ্য বিস্তৃত ও চিত্তাকর্ষক ধ্বংসাবশেষ মুঘল আমলের অবদানের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।’
গডফ্রে উল্লেখিত অসংখ্য ধ্বংসাবশেষের অন্যতম মীর জুমলা নির্মিত এই পাগলা পুল। শিল্প-ইতিহাসবিদদের কাছে মীর জুমলা পরিচিত একটি নাম। ১৬৬০ সালের ৯ মে থেকে ১৬৬৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাংলার সুবেদারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই পাগলা পুলও এই সময়ের মধ্যেই নির্মিত। তবে সেতুটি নির্মাণের সময়কাল হিসেবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে ১৬৬০ সাল। আসাম অভিযানের সময় শীতলক্ষ্যা-বুড়িগঙ্গা নদীর সংযোগস্থল দুলাই নদীর উপর সেতুটি নির্মাণ করেন মীর জুমলা। তবে পাগলা নামে এক ফকির এটি নির্মাণ করেন বলেও কিংবদন্তি আছে। ১৬৬৬ সালে ট্যাভার্নিয়ের যে পাগলা পুল প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেটি বেশ ভালো অবস্থায় ছিল। তবে ১৮২৪ সালে বিশপ হেবারের দেখা পাগলা পুল মোটামুটি অবস্থায় ছিল। ১৮৯৫ সালের দিকে সেতুটি ছিল খুবই ভগ্নদশায়। তবে বুরুজগুলো তখনও দ-ায়মান ছিল। ডব্লিউ.ডব্লিউ হান্টার পাগলা পুলের এই ভগ্নদশার কথা উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে সেতুটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়লে এর ৫০ ফুট উত্তরে আরেকটি সেতু নির্মাণ করা হয়।
অবস্থান ও নির্মাণ শৈলী :পাগরা পুলের অবস্থান ঢাকা থেকে ১৫-২০ কি.মি. দূরে ঢাকা- নারায়ণগঞ্জ সড়কে। বিশপ হেবারের বয়ানে, সেতুটির খিলান ছিল টিউডর গোথিক ধাচের এবং এটি স্থানীয় লোকজনের হাতে নির্মিত নয়। তার এ মত পরে বাতিল করে দেন প-িতরা। চারকেন্দ্রিক ও ঢালু তিনটি উন্মুক্ত খিলানের ওপর পাগলা পুল নির্মিত হয়েছিল। মাঝের খিলানটি ছিল পাশের দুই খিলানের চেয়ে বড়। সেতুর দুই পাশে আরও দুটি বদ্ধ খিলান ছিল। খিলানের উপরের দুই পাশে বদ্ধ স্থান গোলাপের আদলে নকশা করা ছিল। খিলানের ভিত্তিস্থান অর্ধবৃত্তাকার জাহাজের সামনের অংশের অগ্রভাগের মতো। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি, তা হলো প্রত্যেক কোণে একটি করে চার কোণে ছিল অষ্টভূজাকৃতির চারটি ফাঁপা টাওয়ার। টাওয়ারের সূচ্যাগ্র অংশ কয়েকটি খিলান সম্বলিত উন্মুক্ত প্ল্যাটফরমের উপর দ-ায়মান এবং সেতুর দুই পাশের রেলিং বরাবর স্থানে স্থানে কিছু পিলার ছিল, যেগুলোর মাথায় বসানো ছিল গোলাকার ক্ষুদ্র গম্বুজ। সেতুর উপরের সড়ক ছিল খাড়া এবং গোলাকৃতির ইট দিয়ে তৈরি। পুরো সেতুটি নির্মিত হয়েছিল ইট দিয়ে এবং বৃত্তের ব্যাস ছিল পাঁচ ফুট। এস.এম তাইফুর ১৯৮৫ সালে পাগলা পুলের একটি ছবি প্রকাশ করেছিলেন। তবে ভুলবশত তিনি এটিকে পাঠান ফোর্ট বলে উল্লেখ করেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও আদি অনেক বৈশিষ্ট্য এখনো পাগলা পুলে বিদ্যমান বলে উল্লেখ করেছেন ইতিহাসবিদ এ.এইচ দানি। স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের নিরিখে সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে সংরক্ষণ করছে।