প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ডা. মো. এমদাদুল হক তালুকদারের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা পড়লেও, আবার তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে ১০ কোটি টাকার মিশনে নেমেছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। তার এসব দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও আবেদন করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়-ছাত্রজীবনে তিনি কোন দিনও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। কথিত আছে প্রধানমন্ত্রীর হত্যা প্রচেষ্টায় জড়িত মুফতি হান্নানের পাশের গ্রামে তার বাড়ী।প্রকৃতপক্ষে তিনি বর্তমান সরকারের সুবিধা নিলেও তার ব্যক্তিগত অবস্থান পরিষ্কার নয়। তার মামা শ্বশুর ড.ফজলে রাব্বি চৌধুরী, তিনি জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ছিলেন। ডা. মো. এমদাদুল হক তালুকদার সাবেক প্রকল্প পরিচালক, সক্ষমতা জোরদারকরন প্রকল্প। তার প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পর্কে ধারনা এতই কম যে তার তিন বছর কর্মকালিন প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৫%। তবে এই ৫% এর মধ্যে মূল কাজ না করে শুধু কেনা কাটাই করেছেন। অথচ এই কাজগুলো করার কথা ছিল প্রকল্পের অবকাঠামো কাজ শেষ করার পর। তিনি অনুমোদিত এপিপি অনুযায়ী ৩০ কোটি টাকার মালামাল ক্রয়ের জন্য দরপত্র আহবান করেছিলেন।
(ক) ভবিষ্যাতে নির্মিত হবে ভবনের জন্য আসবাব পত্র ক্রয় বাবদ- ৪ কোটি টাকা। (খ) ৫৬ টি জেলায় ট্রেনিং রুম, মাটি ভরাট, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ-২৫ কোটি টাকা (গ) বিভিন্ন দপ্তরে ফ্রিজ সরবরাহ করার জন্য- ৩ কোটি ৪০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। (ঘ) বিভিন্ন দপ্তরে আসবাবপত্র সরবরাহের জন্য ৪ কোটি ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। (ঙ) ২৬ জেলায় কোল্ডরুম স্থাপন বাবদ- ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। (চ) বিভিন্ন দপ্তরে ডেক্সটপ কম্পিউটার সরবরাহ ১ কোটি ৫৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। (ছ) এসি, ফটোকপিয়ার, ল্যাপটপ, বইপত্র ৫০ লাখ টাকা। (জ) ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে নির্মাণসহ অন্যান্য ৫৫,০০,০০০,০০/- এবং অন্যান্য মোট ৪০,০০,০০,০০০০/- খরচ করেছেন। প্রকল্প পরিচালক ব্যক্তিগত লাভবান হওয়ার জন্য ৩৩.০১.০০০০.৮৩৬.০৭.০২৫.২২-৩১৭ স্মারকে ৫/১২/২২ তারিখে জিডি -৯ নং প্যাকেজে, ৪ কোটি টাকার আসবাবপত্র ক্রয়ে দরপত্র আহবান করে, যার আইডি নং- ৭৬২২২০। ডটস ফার্ণিচার নামক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য টেন্ডার ডাটা সিটে ফার্ণিচার মার্ট লাইসেন্স চাওয়া হয়। বাংলাদেশে ২০ হাজার আসবাবপ্রত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আছে যাদের এই ধরনের লাইন্সে নেই। এমনকি প্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠান হাতিল, আখতার, অটোবি, পারটেক্স, নাভানা, আরএফএল, নাদিয়ার মত প্রতিষ্ঠান ফার্ণিচার মার্ট লাইসেন্স নেই।
১ কোটি ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে ডটস ফার্ণিচার নামক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে একটি অভিযোগের বিষয়ে ০০.০১.০০০০.৫০৩.২৬.০৯৩.২৩-৯৭০৪ স্মারকে ১২/০৩/২০২৩ তারিখে পত্র প্রদান করা হয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয়কে। এই বিষয়ে এখনও কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি সূত্রে জানা গেছে।
২৬ জেলায় কোল্ডরুম স্থাপন: ২৬ জেলায় কোল্ডরুম স্থাপন এর জন্য ১০/২/২১ তারিখে দরপত্র আহবান করা হয়। দরপত্র আহবানের আগে ভোলা, মানিকগঞ্জ, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলা অফিসের জন্য ৪টি কোল্ডরুম স্থাপন কোন দরপত্র আহবান ছাড়াই বিশেষ ঠিকাদারকে দ্বারা কাজ করানো হয়। পিডি নির্ধারিত ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার জন্য কোল্ডরুম স্থাপনে জেনারেটর/ বয়লার স্থাপনের বিশেষ শর্ত প্রদান করা হয়। উক্ত দরপত্রে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ঠিকাদার বাংলাদেশ সাইন্স হাউজ প্রতিটি কোল্ডরুমের জন্য ১০ লাখ ৫০ হাজার দর প্রদান করেন। কিন্তু পিডির নির্দেশে সর্বোচ্চ দরদাতা মেসার্স জেনটেক ইন্টারন্যাশনারকে ১৪ লাখ ৬ হাজার ২শ ৫৭ টাকা করে কার্যাদেশ প্রদান করেন। এখানে প্রতিটি কোল্ডরুম এর জন্য ৩ লাখ ৫৬ হাজার ২শ’ ৫৭ টাকা হিসাবে ২৬টি কোল্ড রুমের জন্য ৯২ লাখ৬২ হাজার ৭শ’ ২ টাকা আর্থিক লাভবান হয়ে জেনটেক ইন্টারন্যাশনারকে কার্যাদেশ প্রদান করেন।
৩৮ জেলায় কোল্ডরুম স্থাপন: একইভাবে পরবর্তীতে অবশিষ্ট ৩৮ জেলায় কোল্ডরুম স্থাপনের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছিল ১৮/৮/২০২১ তারিখে হয়। উক্ত দরপত্রে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ঠিকাদার ‘বাংলাদেশ সাইন্স হাউজ’ প্রতিটি কোল্ডরুমের জন্য ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা দর প্রদান করেন। কিন্তু পিডির নির্দেশে সর্বোচ্চ দরদাতা মেসার্স জেনটেক ইন্টারন্যাশনারকে ১৭ লাখ ১৩ হাজার টাকা করে কার্যাদেশ প্রদান করেন। সেখানে প্রতিটি কোল্ডরুম এর জন্য ৫ কোটি ৬৩ লাখ ৫০ টাকা হিসাবে ৩৮টি কোল্ড রুমের জন্য ২ কোটি ১৩ লাখ ৯৫ হাজার ৯শ’ টাকা আর্থিক লাভবান হয়েছে পিডি। এখানে টাকাই পিডি এবং ঠিকাদার ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। তদন্ত করলে সকল সত্য বের হয়ে আসবে।
রেফ্রিজারেটর ক্রয়: প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি উপজেলায় ডীপ ফ্রীজ সরবরাহ করা হয়েছে। পুর্ব হতে প্রতি উপজেলায় ২টি করে সচল ফ্রিজ বিদ্যমান আছ্ে প্রকল্প পরিচালক আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়ার জন্য ডিপিপির দোহাই দিয়ে ৫৬৮টি ফ্রিজ ক্রয় করে সরবরাহ দিয়েছে। এপিপি অনুযায়ী ৩,৪০,৮০,০০০/- টাকার ফ্রিজ কেনার জন্য ১৪/৮/২০২১ তারিখে টেন্ডার করা হয় এবং ২৯/১১/২১ তারিখে ওয়ালটনকে নোয়া প্রদান করা হয়। ডিপিপিতে ১৫ সিএফটি ফ্রিজক্রয়ের সংস্থান আছে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক সকল নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে তার পছন্দের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য সংশোধন করে ১৫ সিএফটি কথাটি উঠিয়ে দেন। ফলে প্রকল্প পরিচালক ৮০ লাখ টাকা আর্থিক লাভবান হয়ে ওয়ালটনকে কার্যাদেশ প্রদান করেন। তদন্ত করলে সকল সত্য বের হয়ে আসবে অবকাঠামো নির্মাণ:সম্প্রতি স্মারক নং৩৩.০১.০০০০.৮৩৬.০৭.০২৬.২২-৮১-এ ১২/০২/২০২৩ তারিখে (২৩+১২) মতে ৩৫টি নির্মাণ প্যাকেজে দরপত্র আহবান করা হয়েছে। প্রতিটি প্যাকেজের নির্মাণ কাজের ‘বিওকিউ’ কষ্ট এস্টিমেটের দ্বিগুণ করে ‘বিওকিউ’ তৈরী করা হয়েছে। গণপুর্তের একজন জেলা পর্যায়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা ৩৫টি নির্মাণ প্যাকেজে বিওকিউ সহ সরোজমিনে তদন্ত করলে দূর্নীতির আসল চিত্র জনা যাবে।
নির্মাণ কাজের যেখানে বাউন্ডারী ওয়ালের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছে ৪,০০,০০,০০০ (চার কোটি) টাকা। কিন্তু উক্ত প্যাকেজে ৪ কোটি টাকার মধ্যে তিন কোটি টাকা মাটি ভরাট এর কাজ। এখানে প্রায় ২ কোটি টাকা পিডি ও ঠিকাদার ভাগাভাগি করে নেবেন। এমনি ভাবে প্রকল্প পরিচালক ১৮ কোটি টাকার কাজের মধ্যে ১২% হারে ঠিকাদার থেকে ২ কোটি টাকার অধিক উৎকোচ গ্রহন করেছেন অভিযোগ উঠেছে।
এলডিডিপি প্রকল্পে লুটপাট: মহাপরিচালক ডা. মো. এমদাদুল হক তালুকদার এলডিডিপি প্রকল্প ৫১০০ কোটি টাকার প্রকল্প এর আওতায় ১০০০ কোট টাকার অনুদানের ক্ষেত্রে ১০% হারে ১০০ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। কোন টেন্ডারই তার ১০% না আসলে কাজ হয় না। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ১৪ টি প্রকল্পের নির্ধারিত হারে মাসে টাকা না দিলে প্রকল্পের কোন কাজ করতে দেন না। বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার মেডিসিন, ভ্যাকসিন, প্রোটিন কনসেন্ট্রট যাহা কোন প্রকার মান যাচাই ছাড়াই ১০-২০% আর্থিক সহযোগিতায় এনওসি প্রদান করা হয়। জনবল নিয়োগে ব্যপক অনিয়ম এর মাধ্যমে, রাজস্ব ও আউট সোর্সিং মিলে ৪৫০ লোক নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। রাজস্ব জনপ্রতি ১৫- ২০ লাখ টাকা ঘুষ (১২ কোটি টাকা) এবং আউট সোর্সিং জনপ্রতি ২-৩ লাখ টাকা ঘুষ ( সাড়ে আট কোটি টাকা) নিয়ে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ডা. মাহবুব (ডিডি প্রশাসন) টাকা কালেকশনের মুল দায়িত্ব পালন করেন ডা মলয় কুমার সুর। মহাপরিচালক ডা. এমদাদ এনওসি প্রদান করা থেকে প্রতিমাসে ৫ কোটি টাকা আদায় করে থাকেন। টাকা প্রদানে বিলম্ব হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বদলী করে দেওয়া হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে কর্মচারী-কর্মকর্তা বদলীতে সর্বনি¤œ ২ লাখ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা প্রদান না করলে কাঙ্খিত জায়গায় বদলি পাওয়া যায় না। এখনে কালেকটারের দায়িত্ব পালন করে কর্মচারী মো. হাফিজুর রহমান। বর্তমান মহাপরিচালক ডা. এমদাদুল হক তালুকদার মহাঘুষখোর হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী সুষ্ট তদন্তের মাধ্যমে ১০০-৫০ কোটি টাকার অবৈধ অর্থ ও সম্পদের উৎস বের করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ জানিয়েছেন ।
জানা গেছে, তার চাকুরীর মেয়াদ ২০২৪ সালে চলতি বছরে ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে। ফলে তিনি আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে ১০ কোটি টাকার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছেন। উল্লেখ্য যে, দুদকে তার বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় আজঅব্দি গ্রেড-১ পদে পদন্নোতি হয়নি।
এই বিষয়ে অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা ভোরের পাতাকে বলেন, এই ডিজির জন্যই আজ এই অবস্থা। তার কথা ছাড়া কিছুই হয় না। যা মন চায় তাই করে। তার কথার বাহিরে কেউ গেলে নেমে আসে বদলির আতঙ্ক। আমরা আজ তার (ডিজি) মহোদয়ের কাছে অসহায় হয়ে গেছি।
এসব বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য তার অফিসে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন তিনি মন্ত্রনালয়ে অধিদপ্তরের কাজে গেছেন। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।