পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম, ২৫ বছর ধরে যার ঠিকানা কারাগার। বলছিলাম রাজধানীর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম সুইডেন আসলামের কথা। এখন আছেন কাশিমপুর কারাগারের হাই সিকিউরিটি সেলে। একসময় আসলামের পরিবারের বাস ছিল রাজাবাজারে। রাজধানীর ফার্মগেট পার হয়ে রাজাবাজার। সেখানে একটি বাড়ি খুঁজে খুঁজে হয়রান। ওই বাড়ির একজনের নাম শুনে চিনলেও বাড়িটি নিশ্চিত করতে পারলেন না। তবে কেউ তার পরিবারের সদস্যদের না চেনায় নিরাশ হতে হলো।
ঘুরতে ঘুরতে কথা হলো মধ্যবয়সী কয়েকজনের সঙ্গে। তারা আসলামকে চেনেন এবং তার পরিবারের খবরও মোটামুটি জানেন। তারাই জানালেন, আসলামের গ্রামের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায়। অনেক আগে থেকেই তার বাবা-চাচারা রাজাবাজারে থাকতেন। বাবা রড-সিমেন্টের ব্যবসা করতেন। আসলামরা দুই ভাই, এক বোন। মা-বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। আসলাম বিয়ে করেছেন দুটি। প্রথম স্ত্রী ইতির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর চাচাতো বোন সিমিকে বিয়ে করেছিলেন। তবে তার কোনো সন্তান নেই। ছোট ভাই জাকির কলকাতায় থাকেন। কালেভদ্রে দেশে আসেন। ছোট বোন স্বামী-সন্তান নিয়ে তেজতুরীপাড়ায় বাস করেন। আসলামের এক চাচাতো ভাই থাকেন বাড্ডায়।
জানা গেল, আসলামের প্রবল আকর্ষণ ছিল অস্ত্রের প্রতি। কয়েকটি অস্ত্র ছিল তার। এগুলো ভাড়াও দিতেন তিনি। একবার তার ছোট ভাই গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন অস্ত্রসহ। ওই ব্যক্তিরাই জানালেন, রাজাবাজারেই আছে আসলামের দ্বিতীয় স্ত্রীর বাবার বাড়ি। আসলাম গ্রেপ্তার হওয়ার ২৩ বছর পর্যন্ত তার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। একসময় হাল ছেড়ে বছর দুয়েক আগে আবার বিয়ে করেছেন।
তাদের দেখানো মতে, সত্তরের দশকের পুরোনো সেই বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল খোলা কলাপসিবল গেটের ভেতর বসে আছেন বয়স্ক দারোয়ান। চেনা মুখ অথবা বাড়ির মানুষদের পরিচিত ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেন না। দারোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভেতরে ঢোকার সুযোগের অপেক্ষায় কাটতে লাগল সময়। কিন্তু তার সরার কোনো লক্ষণই নেই। তিন ঘণ্টা পর কোনো প্রয়োজনে দারোয়ান সরতেই টুক করে ভেতরে ঢুকে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে একেবারে চারতলায়। কলবেল চেপে মিনিট দশেক অপেক্ষা। সাড়া-শব্দ নেই। আরও কয়েকবার কলবেলে চাপ। এবার কারও দরজার কাছে আসার আওয়াজ পাওয়া গেল। আইহোল দিয়ে দেখে ভেতরে চলে গেল পায়ের আওয়াজ। আরও মিনিট দশেক অপেক্ষার পর নয়-দশ বছরের একটি শিশু দরজা একটু ফাঁক করে শুধু মাথা বের করে জিজ্ঞেস করল, ‘কাকে চাই?’ তার নাম জানতে চাইলে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে ফের প্রশ্ন করল, ‘আগে বলুন কাকে চাই।’ ‘সিমি আছেন?’-প্রশ্ন শুনেই দরজা লাগিয়ে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল সে। কিছুক্ষণ পর ৪০ ছুঁই ছুঁই এক ভদ্রমহিলা প্রথমে দরজা খুলে মাথা বের করে পরিচয় জানতে চাইলেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে উদ্দেশ্য জানাতে বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘সিমি এখন এখানে থাকে না। তার বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়িতে থাকে।’ দ্রুত বলেই প্রশ্ন, ‘আর কিছু জানতে চান?’ তিনি এখানে আছেন জেনে আসা-এমনটা জানিয়ে ডেকে দেওয়ার অনুরোধ করলে রেগে গেলেন ভদ্রমহিলা। বললেন, ‘দেখুন, এসব নিয়ে আমরা কথা বলতে চাই না। আপনি আসুন দয়া করে। আপনি যা জানতে এসেছেন সেগুলো এখন অতীত। কাল আমার বাচ্চার পরীক্ষা, আপনি চলে গেলে খুশি হব।’ আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দরজা বন্ধ করে দিলেন। এই ভদ্রমহিলা সুইডেন আসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী সিমির ছোট বোন। সিমি আসলামের চাচাতো বোন। আসলাম ১৯৯৭ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে দুই বছর আগপর্যন্ত ভাইবোনের সঙ্গে এই বাড়িতেই থাকতেন তিনি। আসলামের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের কারণে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে ও তার পরিবারকে। থাকছেন নিরিবিলিতে। আসলামের বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা হয়েছিল আশির দশকে। রাজাবাজারে নাজনীন স্কুলের ভেতর দিনদুপুরে শাকিল নামের এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ওই মামলা হয়।
শোনা যায়, প্রেমিকাকে উত্ত্যক্ত করার জেরে ঘটেছিল ওই হত্যাকা-। এরপর ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন ঢাকার অন্ধকারজগতে অবৈধ কয়েকটি অত্যাধুনিক অস্ত্রের মালিক। সন্ত্রাসী হলেও এলাকার উঠতি তরুণ-কিশোরদের মাঝে তার বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। জানা যায়, তাদের ব্যবহার করতেন অস্ত্র রাখা ও বহনের কাজে। রাজাবাজার ও পাশের এলাকার দুই ব্যক্তি এই প্রতিবেদককে বলেন, নব্বইয়ের দশকে তারা মাধ্যমিকে পড়তেন। কিশোর বয়সের দোষে আসলামের ‘হিরোইজ’ তাদের ভালো লাগত। তাই তার কথা শুনে অস্ত্র নিজেদের বাসায় রাখতেন এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন। পরে বুঝেছেন, তখন অন্যায় করেছেন, ভুল করেছেন। এ রকম আরও তিনজনের সঙ্গে কথা হয়।
সবাই জানান, ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকাভুক্ত আসলাম কোথাও যাওয়ার আগে সেখানে লোক পাঠাতেন। তাদের কাছ থেকে সব ঠিক থাকার সংকেত পেলেই শুধু যেতেন। এরপরও কখনো কখনো প্রতিপক্ষ গ্রুপ বা পুলিশের কবলে পড়তে হয়েছে। গুলি করতে করতে সটকে পড়েছেন। সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে ২২টি মামলা রয়েছে। যার ৯টিই হত্যা মামলা। একটি বাদে সব মামলায়ই খালাস পেয়েছেন তিনি। তেজগাঁওয়ের যুবলীগ নেতা গালিবকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে করা মামলাটি বিচারাধীন। এই মামলায় খালাস পেলে তার কারামুক্তিতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
অভিযোগ রয়েছে, কারাগারে থাকলেও থেমে নেই তার সন্ত্রাসী কর্মকা-। জেলে বসে মুঠোফোনে নিয়ন্ত্রণ করছেন তার অপরাধ সাম্রাজ্য। আসলামের প্রথম স্ত্রী ছিলেন ইতি। তিনি সুইডেনপ্রবাসী ছিলেন। বিয়ের পর আসলামও সুইডেন গিয়ে কয়েক বছর ছিলেন। সেই সূত্রে তার নামের আগে জুড়ে যায় সুইডেন শব্দটি। একসময় ইতির সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়। জানা যায়, ইতি পরে আত্মহত্যা করেন। ফেরার পথে দেখা হয় রাজাবাজারের ওই বাড়ির বৃদ্ধ দারোয়ানের সঙ্গে। সুইডেন আসলামকে চেনেন-জানতে চাইলে বললেন, ‘এই লোকটা কেডা বাবা? আমি দুই মাস হইল আইছি। মানুষজন কম চিনি।’