শ্রমিক ঠকানোর দায়ে দণ্ড পাওয়া শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১২ সিনেটর।
ওই চিঠিতে ইউনূসের সাজার বিষয়ে নানা আলোচনা করা হলেও শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা নিয়ে কোনো শব্দ উচ্চরণ করেননি তারা।
শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের দুই সপ্তাহের মধ্যে এই চিঠি পাঠানো হলো।
গত ২২ জানুয়ারি ইস্যু করা চিঠিতে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘হয়রানি’ করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন ওই ১২ জন সিনেটর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড. ইউনূসের কথিত হয়রানি বন্ধের দাবির সঙ্গে ওই সিনেটররা কৌশলে বাংলাদেশ ও সরকারবিরোধীদের পক্ষ নিয়েছেন। আর ইউনূসের দাবির আড়ালে তারা রাষ্ট্রবিরোধীদেরও বিচার থেকে রেহাই দেয়ার দাবি জানাচ্ছেন।
বিবৃতি দেয়া ১২ সিনেটর সরকার বিরোধীদেরকে কৌশলে ‘সরকারের সমালোচক’ তকমা দিয়েছেন এবং তাদের ওপর আইনের ব্যবহার বন্ধ করার আহবান জানিয়েছেন বলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
তারা বলছেন, সিনেটররা মুহাম্মদ ইউনূস ও বাংলাদেশ বিরোধীদের পক্ষে অবস্থান নিলেও নোবেলজয়ীর শ্রম আইন লঙ্ঘনের বিষয় এবং শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা নিয়ে কোনো কথা না বলাটা রহস্যজনক।
আর বাংলাদেশ সরকারকে চাপে রাখার জন্য অনেকদিন ধরেই মার্কিনিরা যে কৌশল নিয়েছে, সেই মিশনেরই অংশ হিসেবে ১২ মার্কিন সিনেটর এই বিবৃতি দিয়েছেন বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।
চিঠিতে মার্কিন সিনেটররা লিখেছেন, কমপক্ষে এক দশক ধরে বাংলাদেশে অন্তত ১৫০টি অপ্রমাণিত বিষয়ে মামলা করা হয়েছে ইউনূসের বিরুদ্ধে। এটি আসলে সরকারের সমালোচকদের টার্গেট করে হয়রানি করার অংশ। এরই মধ্যে এসব মামলায় প্রক্রিয়াগত ভুল চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো প্রতিষ্ঠান।
চিঠিতে তারা লিখেছেন, এরকম একটি মামলার বিচারে ইউনূসকে সম্প্রতি শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য ৬ মাসের জেল দেয়া হয়েছে, যার বিরুদ্ধে তিনি আপিল করছেন। এরকম মামলায় প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের বহু নাগরিক প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি।
ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান হয়রানি বন্ধ এবং একইসঙ্গে সরকারের সমালোচকদের টার্গেট করে বিচার ব্যবস্থার যে লঙ্ঘন করা হচ্ছে সেই ধারা বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে চিঠিতে।
১২ সিনেটর আরো লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এখন ইউনূসের হয়রানি বন্ধ করে দেশের সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিলে এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে সম্প্রতি আদালতে ছয় মাসের দণ্ড পেয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শ্রমিকদের করা এ মামলায় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে। তবে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারিক অপব্যবহার দেখতে পাচ্ছেন ১২ মার্কিন সিনেটর।
ছুটি নগদায়ন এবং শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের বিভিন্ন বকেয়া পাওনার দাবিতে ২০১৬ সালে মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করেন গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ১৪ কর্মী। পরে বকেয়া পাওনা চেয়ে তার বিরুদ্ধে ৯৩টি মামলা করে তারই প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীরা।
সব মিলিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ীর বিরুদ্ধে ঢাকার শ্রম আদালতে ১০৭টি মামলা দায়ের করে শ্রমিকরা।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকেসহ চারজনের ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় আদালত। ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের পরিদর্শক আরিফুজ্জামান বাদী হয়ে ওই মামলা করেন।
মামলায় শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
এখানে শ্রম আইন ২০০৬ এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক বা কর্মচারীদের শিক্ষানবিশকাল পার হলেও তাদের নিয়োগ স্থায়ী না হওয়া এবং প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক বা কর্মচারীদের মজুরিসহ বাৎসরিক ছুটি না দেয়া এবং ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ না দেয়ার অভিযোগ আনা হয়।
পাশাপাশি গ্রামীণ টেলিকমে শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন না এবং লভ্যাংশের ৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন না দেয়ার আদালতে প্রমাণ হয়েছিল।