সংরক্ষনের অভাবে অযতœ অবহেলায় দিনদিন অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে পাড়েরহাটের ঐতিহ্যবাহী বাজপাইর জমিদার বাড়ি। ব্রিটিশ শাসনামলে পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী উপজেলার পাড়েরহাট মৎস্য বন্দরে গড়ে ওঠে এ জমিদার বাড়িটি। তৎকালীন এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন সূর্য্য প্রসন্ন বাজপাই। তাকে লোকজন ভালোবেসে পাড়ের বাবু নামেও ডাকতেন। তিনিই এখানে গড়ে তোলেন কাচারিবাড়ি, নিজের সভাকক্ষ ও শয়ন কক্ষ,নাগ মন্দির ও দুটি পুকুর।
জমিদার সূর্য্য প্রসন্ন বাজপাইর মায়ের নামে পাশেই প্রতিষ্ঠা করেন রাজলক্ষী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। যেটি বর্তমানে রাজলক্ষী এন্ড কলেজ নামে পরিচিত। জমিদারের উত্তরসূরিরা বর্তমানে ভারতের এলাহাবাদে আছেন। দেশ ভাগের পর তারা ভারতে পাড়ি জমান। এরপর তাদের উত্তরসূরীরা এই বাড়িতে আর ফিরে আসেননি। জমিদার সূর্য প্রসন্ন বাজপাই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপাইর চাচা ছিলেন। জমিদার বাড়িটি বর্তমানে সরকারের খাস খতিয়ানের অন্তর্ভূক্ত হলেও স্থানীয়দের দ্বারা কিছু জমি বেহাত রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় তিন একর জমির ওপর নির্মিত জমিদার বাড়িটির প্রাসাদের দেয়াল, ইট ও ছাউনি টালি দিয়ে তৈরি। বাড়িটির সভাকক্ষের ভবনের পিলার গুলো ইটের এবং ছাদ টালি দিয়ে তৈরী। তবে ছাউনির উপরের এ টালি গুলো এখন আর দৃশ্যমান নেই। আস্তে আস্তে সব গুলোই ভেঙ্গে পড়েছে। তার শয়নকক্ষ ও মন্দিরের ভবন দুটি এখন লতা-পাতায় ছেয়ে রয়েছে। জমিদার বাড়িটির সামনে দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত দিয়ে চলে গেছে একটি রাস্তা। সামনেই একটি পুকুর। তার পাশেই উত্তর-পূর্ব প্রান্তে পাড়েরহাট পোস্ট অফিস। দক্ষিণ প্রান্তে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জমিদার বাড়িটির ভিতরেই দক্ষিন প্রান্তে রয়েছে একটি সরকারি ভূমি অফিস। জমিদার প্রথা বিলোপের পর সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে বাড়িটি বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। একটা সময় রাজা-প্রজা, পাইক-পেয়াদায় মুখরিত বাড়িতে এখন শুধুই নীরবতা।
মৎস্য ব্যবসায়ীরা এখানে মাছ বিক্রি করতে এলে জমিদার বাড়িটিতে চোখ বুলিয়ে যান। অন্য এলাকা থেকে আসা অনেকেই স্থানীয় লোকজনের কাছে জানতে চান এ বাড়ির ইতিহাস। আশপাশের এলাকা ছাড়াও দুরদুরান্ত থেকে বিভিন্ন বয়সী ছেলে মেয়েরা দেখতে আসেন বাড়িটি। কৌতুহলের বসে জানতে চান এর ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে। তারা মনে করেন, রাজবাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণ হলে ভালো একটি পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে। এতে দর্শনার্থীরা যেমন ঘুরে দেখতে পারবে। তেমনই রাজা বা জমিদারদের সঠিক ইতিহাসও জানার সুযোগ পাবে।
বাজপাইর জমিদার বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে পাড়েরহাটের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো: শাহ আলম জানান, জমিদার সূর্য্য প্রসন্ন বাজপাই একজন শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ১৯৫৫ সালে দেশ ত্যাগ করেন তিনি। এ জমিদার বাড়িটির বয়স দেড়’শ বছরের বেশি। ৩ একর জায়গার মধ্যে বাজপাইর এ জমিদার বাড়িটির অবস্থান। এছাড়া জমিদার বাড়ির পাশেই আরো ১ একর ৮০ শতক জমি ছিল তার। ছাত্রাবাস করার জন্য ৩০ শতক জমি দেন তিনি। সেখানে এখন গণকবর স্থান নির্মাণ করা হয়েছে। জমিদার বাড়ির পাশেই তার মা রাজলক্ষী দেবীর নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। জমিদার সূর্য্য প্রসন্ন বাজপাইর কোন সন্তান ছিলনা। লালাবাবু নামে তার একজন পালক পুত্র ছিলো। সূর্য্য প্রসন্ন বাজপাইর মৃত্যুর পর তিনিই তার জমিদারি দেখা শুনা করতেন। কলকাতায় তাদের বাড়ি ছিল। মুল বাড়ি ভারতের এলাহাবাদে। সেখানে তার অসংখ্য আতœীয়-স্বজন রয়েছে। এখানে একটা মন্দির ছিল। ঐ মন্দিরে প্রায় জলসা বসত। নাটক আর গান বাজনা হত সারারাত। জমিদার বাড়িতে একটি কাচারি বাড়ি ছিল। সেখানে তিনি বিারকার্য সারতেন। বিকেল বেলা প্রায়ই কাচারিবাড়ি বৈঠকখানায় বসতেন তিনি। এসময় স্থানীয় বয়স্ক ব্যক্তিদের সাথে গল্প গুজব করে সময় কাটাতেন তিনি। তখনকার সময় রাস্তাঘাট পাকা না থাকায় যাতায়াতের জন্য কাচারিবাড়ি বৈঠকখানা সোজা খালের ঘাটে নৌকা ছিল তার জন্য। ঐ নৌকায় করে তিনি পিরোজপুর শহরে গমন সহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। তার শয়নকক্ষের পিছনে দুটি পুকুর রয়েছে। এর একটি পুকুরে গোসল করতেন তিনি। সেখানে একটি ঘাটলা রয়েছে ভাঙ্গাচোরা অবস্থায়। তবে জমিদার সূর্য্য প্রসন্ন কবে কত বছর বয়সে মারা গেছেন তা কেউ সঠিক বলতে পারছেন না।
স্থানীয় বাসিন্দা উত্তম কুমার বলেন, জমিদারের এই চিহ্ন মুছে যাওয়ার পথে। এটাকে সংস্কার করে পর্যটনকেন্দ্র করা হোক। পর্যটনকেন্দ্র হলে এলাকাবাসীসহ দেশ উপকৃত হবে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মিলন কুমার দাস বলেন, আগে এখানে অনেক কিছু ছিল। সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। আমার ঘরবাড়ি না থাকায় এখানে বহু বছর ছিলাম। যখন থাকার মতো পরিস্থিতি আর ছিল না তখন নেমে এসেছি।
পাড়েরহাট ইউপি চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান শাওন বলেন, ২০০২ সালে এটা সংস্কার হওয়ার কথা ছিল। বারবার এসে মাটি পরীক্ষা করা হয়েছে। সংস্কার না হওয়ায় ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে জমিদার বাড়িটির নানা স্থাপনা। পাড়েরহাটের রাজবাড়িটা আমাদের একটা ঐতিহ্য। বাড়িটি সংস্কার করে সংরক্ষনের জন্য আমরা ডিসি মহদয়কে বলেছি। সরকার যদি বাড়িটির দায়িত্ব না নেন তাহলে এটা একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে।
স্থানীয় কলেজ ছাত্র মো: আবির বলেন, জমিদার বাড়িটি আমাদের পাড়েরহাটের একটা ঐতিহ্য। নতুন প্রজন্ম যারা আছে তারা এ সম্পর্কে বয়স্কদের কাছ থেকে জেনেছেন। এটা সংরক্ষণ করা গেলে ট্যুরিস্ট স্পট হতো। এলাকার ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে আরও ভালো জানা যেত।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, বাজপাইর জমিদার বাড়িটি এ এলাকার একটি ঐহিত্য। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাড়িটি সংরক্ষনের জন্য প্রতœতত্ত অধিদপ্তরকে অবহিত করা হয়েছে।
পিরোজপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান জানান, পাড়েরহাটের জমিদার বাড়িটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। এখানে ভ্রমণপিপাসু মানুষ ভ্রমণ করে থাকেন। মূলত জমিদার বাড়িটি অনেক পুরাতন। আমি এটি পরিদর্শন করেছি। অনেক জায়গা নিয়ে এই জমিদার বাড়িটি রয়েছে। জমি আছে, পুকুর আছে, দুটি পুরাতন ভবন রয়েছে। আমরা এটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তবে এটির জন্য আরও বড় উদ্যোগ প্রয়োজন। এ জন্য প্রতœতত্ত্ব বিভাগের মাধ্যমে বাড়িটি সংরক্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে।