নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে অনেকটা লাগামহীনভাবেই চলছে সিএনজিচালিত ‘প্রাইভেট’ অটোরিকশার বাণিজ্যিক চলাচল। দুই বছর আগে হাইকোর্টের এক রায়ে রাজধানীতে ধূসর বা রূপালি রঙের এসব অটোরিকশার বাণিজ্যিক চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু সেই রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঢাকার মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ এসব তিন চাকার বাহন।
অটোরিকশাগুলোর মালিক-চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘মাসোহারা’ দিয়ে এসব অবৈধ গাড়ি চলছে রাজধানীতে। ঢাকার পরিবহন জগতে পুলিশকে দেয়া এই মাসোহারা ‘মান্তি’ বা ‘মান্থলি’ হিসেবে পরিচিত। বিআরটিএ এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরে যাত্রী পরিবহনের জন্য নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা সাড়ে ১৫ হাজার। কিন্তু চালক-মালিকদের হিসাবে, এর বাইরেও প্রায় ২০ হাজারের মতো অটোরিকশা রাজধানীতে অবৈধভাবে চলছে। যার মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত হিসেবে নিবন্ধিত ও ঢাকার বাইরে নিবন্ধিত অটোরিকশা। এসব অবৈধ অটোরিকশার দাপটে হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে বাণিজ্যিক হিসেবে নিবন্ধিত (সবুজ) অটোরিকশাগুলোকে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় টু-স্ট্রোক বেবিট্যাক্সি নিষিদ্ধ করার পর ২০০১ সালে ফোর স্ট্রোক থ্রি হুইলার অটোরিকশার (সিএনজিচালিত) বাণিজ্যিক চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। এরপর ১৩ হাজার অটোরিকশা (ঢাকা মেট্রো-থ) নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিআরটিএ আরও ৩,৯৫৭টি ফোর স্টোক অটোরিকশা ব্যক্তিমালিকানায় (ছাই রঙ) চলাচলের জন্য নিবন্ধন দেয়। যদিও সিএনজি/পেট্রলচালিত ফোর স্ট্রোক থ্রি হুইলার্স সার্ভিস নীতিমালা-২০০৭ অনুযায়ী ঢাকা মহানগর এলাকায় ফোর স্ট্রোক থ্রি হুইলার (ঢাকা-দ) ব্যক্তিমালিকানায় চলাচলের সুযোগ নেই। পরে ব্যক্তিমালিকানায় নিবন্ধন পাওয়া অটোরিকশার মালিকরা বাণিজ্যিক নিবন্ধনের দাবি জানায়। সরকারের সাড়া না পেয়ে
২০১৬ সালে প্রাইভেট সিএনজি অটোরিকশা ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২৭ জুলাই রুলসহ আদেশ দেয় হাইকোর্ট, তাতে ওই অটোরিকশা রাস্তায় চলার অনুমতি দেয়ার নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি অনুমতি না দেয়া অবধি ব্যক্তিগত অটোরিকশা ঢাকায় বাণিজ্যিক উদ্দেশে চলাচলে বাধা না দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। পাঁচ বছর পর সেই রুল খারিজ করে আদালত রায় দিলে ব্যক্তিগত অটোরিকশার বাণিজ্যিক চলাচলের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। রুল খারিজ হওয়ায় ধূসর বা রুপালি রঙের প্রাইভেট সিএনজি (ঢাকা মেট্রো-দ) চলাচলে আর অনুমতি নেই বলে জানান আইনজীবীরা।
মালিক-চালকদের অভিযোগ, একশ্রেণির অসাধু পুলিশকে নিয়মিত ‘মাসোহারা’ দিয়ে চলছে অবৈধ অটোরিকশা, আর হয়রানির শিকার হচ্ছে বৈধ গাড়িগুলো। অটোরিকশার মালিক-চালকরা বলছেন, ছাই রঙের অটোরিকশার পাশাপাশি ঢাকা জেলা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে নিবন্ধিত অটোরিকশাও বিনাবাধায় রাজধানীতে চলছে। চালক ও মালিকরা বলছেন, অবৈধ বাহনগুলো চালানোর জন্য প্রতি মাসে গাড়িপ্রতি চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা পুলিশের সার্জেন্ট ও টিআইদের (ট্রাফিক ইন্সপেক্টর) দেয়া হয়। বিনিময়ে পুলিশ তাদের কয়েকজন কর্মকর্তার নম্বর ও ওই মাসের ‘কোড’ দিয়ে দেয়। এরপর কোথাও পুলিশ গাড়ি আটকালে মোবাইলে সেই কর্মকর্তাকে ফোন করে কোড বললেই তিনি সেটি ছাড়িয়ে নেন। ছাই রঙের একটি অটোরিকশা চালান মো. রাসেল। রুট পারমিট ছাড়া এসব অটোরিকশা চলাচলে পুলিশ মামলা দেয় কিনা-এমন প্রশ্নে রাসেল বলেন, ‘মাসে মাসে সাড়ে চার হাজার কইরা টেকা দিই। সব গাড়ি পুলিশে ধরলেও এই গাড়ি ধরব না। কারণ কন্টাক (চুক্তি) মোতাবেক কোনো পুলিশ এই গাড়ি থেকে টাকা নিলে সেইটা যেই স্যারের কাছে মান্তি করছি হ্যার টাকা থেকে কাটা যাইব।’ আওলাদ জানান, তিনি চার বছর ধরে ছাই রঙের অটোরিকশা চালান। কোভিড মহামারির আগে ব্যক্তিগত হিসেবে নিবন্ধিত এসব ছাই রঙের গাড়ি প্রতিমাসে ছয় হাজার টাকা করে ‘মান্তি’ দিতে হতো। এখন সেই মান্তি কমে চার হাজারে এসেছে। যখন মান্তি বেশি ছিল তখন এই গাড়িগুলো সাড়ে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকায় হাত বদল হতো। এখন পুলিশি ঝামেলা কম থাকায় এই গাড়ি ১০ লাখের নিচে পাওয়া যায় না। গাড়ির জমাও এখন বেড়েছে। আগে ৫০০ টাকাও জমা নিতেন মালিকরা। এখন সারা দিন চালালে জমা হাজার টাকা। আর দুই বেলা গাড়ি চললে প্রতিবেলার জন্য ৬০০ টাকা করে জমা দিতে হয় বলে জানান রাসেল। তার দাবি, এখন ঢাকায় যেসব ছাই রঙের অটোরিকশা চলে, তার বেশিরভাগের মালিক সরকারি কর্মকর্তা। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি হাজী বরকতুল্লাহ বুলু ভোরের পাতাকে বলেন, ‘একেবারে গায়ের জোরে সব আইন-কানুন অমান্য করে এই গাড়িগুলো চালাচ্ছে পুলিশ। এখন কেবল ছাই রঙের (ঢাকা মেট্রো-দ) গাড়িগুলো না, ঢাকা জেলা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর নম্বরের গাড়িও মান্তি দিয়া দেদার চলছে।’ বরকতুল্লাহর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী বহনের অনুমতিপ্রাপ্ত সবুজ নম্বর প্লেটের অটোরিকশা আছে ১৫ হাজার ৬০০। অন্যদিকে ঢাকা মেট্রো নম্বরের ব্যক্তিগত নিবন্ধিত অটোরিকশা রয়েছে ৩ হাজার ৯৫৭টি। ঢাকা জেলায় চলাচলের জন্য নিবন্ধিত। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এমনকি মুন্সীগঞ্জে নিবন্ধিত গাড়িও এখন ঢাকা শহরে চালাচ্ছেন একশ্রেণীর মালিক। সব মিলিয়ে এদের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি হবে। তিনি বলেন, ‘এবার হিসাব করেন, ২০ হাজার গাড়ি গড়ে ৪ হাজার করে টাকা দিলে মাস শেষে কত টাকা মান্তি ওঠে।’
ঢাকা মহানগরে বাণিজ্যিক হিসেবে নিবন্ধন পাওয়া সবুজ অটোরিকশার একাধিক চালক বলেন, ‘সিগন্যালে একটু উল্টো-পাল্টা করলেই পুলিশ তাদের আটকায়। তবে ছাই রঙের অটোরিকশার সব মাফ।’ সবুজ অটোরিকশার চালক শেখ ফারুক বলেন, ‘আমাগো গাড়ির দামও বেশি, ডেইলি জমাও বেশি, আবার পুলিশের প্যারাও (হয়রানি) বেশি। মিটারে চালাইলে তো পুষবই না। আর ওরা (অবৈধরা) যেই ভাড়ায় যাইতে পারব, আমরা সেই টাকায় যাইতে পারি না। আমরা সিগন্যালে এদিক-ওদিক করলেই মামলা, কুনো কথা নাই। আর হেই গাড়িগুলানরে পুলিশ কিছুই কয় না। হ্যাগোরে কওয়ারও তো কিছু নাই, হ্যারা তো অবৈধই। বেশিরভাগের কাগজই নাই, মামলা দিব কিসের উপরে? হেগুলার একমাত্র উপায় ডাম্পিংয়ে পাডানো। তয় পুলিশই তো টেকা খায়, তারা কী আর হেইডা করব? শুধু টেকার জোরে এই গাড়িগুলান হ্যারা চালাইয়া খাইতেছে।’ কমালাপুরের অটোরিকশা ব্যবসায়ী দিদার মিয়া বলেন, ‘এদের (অবৈধ) দাপটে অহন আমরাই কোণঠাসা। হ্যারা এইহানে অবৈধ। কিন্তু হ্যারা রাস্তার চলে রাজার লাহান আর আমরা বৈধ অইয়াও পদে পদে হয়রানির শিকার হই। পুরা খেলাডাই হইল টেকার। আগে ঢাকার বাইরের কিছু গাড়ি রাইতের বেলায় ঢাকা ঢুইকা চুপচাপ কিছু ভাড়া মাইরা বাইর হইয়া যাইত। এহন এগুলা সারা দিনই চলে। ঢাকা শহরের গ্যারেজেই এগুলারে রাখে মালিকরা।’ খিলগাওয়ের গ্যারেজ মালিক রাকিব রহমান বলেন, ‘সবুজ নম্বর প্লেটের একটি গাড়ির দাম এখন ১৭-১৮ লাখ টাকা। এর অর্ধেকে একটা ছাই রঙের গাড়ি পাওয়া যায়। তারও অর্ধেকে ঢাকার বাইরের নম্বরের গাড়ি পাওয়া যায়। এখন পুলিশকে ম্যানেজ করার বিষয়টি সবাই জেনে যাওয়ায় অল্প পুঁজিতে বেশি লাভের আশায় অনেকেই ঢাকার বাইরের গাড়ি বা ছাই রঙের গাড়ি কিনছেন।’
এসব গাড়ির মালিকদের বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তা জানিয়ে এই গ্যারেজ মালিক বলেন, ‘এই গাড়িগুলান চলেই পুলিশের নামে। পুলিশ ছাড়া আর কেউ এগুলি ঢাকা শহরে চালাইতে পারব না।’
হাইকোর্টের রায়ের পরেও কীভাবে অবৈধ অটোরিকশা চলছে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের এক উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) বলেন, ‘যারা এই গাড়িগুলো চালায় তারাও জানে যে এগুলো অবৈধ। তারা জেনেশুনেই চালাচ্ছে। আমরা সব সময়ই তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। আর বিভিন্ন জেলা থেকে যে গাড়িগুলো ঢাকায় ঢুকছে তারা (সংশ্লিষ্ট জেলা কর্তৃপক্ষ) যদি চেক করতে পারত, তাহলে কিন্তু এই গাড়িগুলো আমাদের এখানে আর আসে না।’ তিনি বলেন, ‘আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে বাইরের অনেক জায়গায় সিএনজি স্টেশন নেই। যেমন কেরানীগঞ্জে সিএনজি স্টেশন নেই, সাইনবোর্ডের ওদিকেও নেই। যে কারণে সিএনজি নিতে তারা ঢাকায় ঢুকে বিভিন্নভাবে অবৈধ ট্রিপ ধরে। যে কারণে সমস্যা হয়। যখনি আমাদের নজরে আসে তখনি আমরা ধরি। আর ছাই রঙের অটোরিকশাগুলো যে ভাড়া মারে এগুলো আমাদের নজরে এলে কিন্তু আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে সচেষ্ট থাকি।’ চালক-মালিকদের কাছ থেকে ‘মাসোহারা’ নেয়ার অভিযোগের বিষয়ে ডিসি প্রবীর বলেন, ‘আমরা যদি দেখি যে কেউ অবৈধ কোনো ট্রানজ্যাকশনে জড়িত আছে বা কোনো অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আগেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এখনো নেয়া হবে।’