৭ জানুয়ারী রবিবারের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে কে হবে জয়ী, এ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। কারন এবারই প্রথম সরকারি দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবং একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে শুরু হয়েছে তুমুল নির্বাচনী লড়াই। যেটি শেষ হতে যাচ্ছে রবিবার ভোট যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এ যুদ্ধে অনেককেই ছাড়তে হতে পারে দীর্ঘদিন ধরে রাখা নিজ আসন বা ক্ষমতা।
ভোরের পাতা নির্বাচনী বিশ্লেষন বলছে, অবাধ-নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ২৯৯ সংসদীয় আসনের ১০০টিরও বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হতে পারে এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে । আর এ বিশ্লেষন অনেক ক্ষমতাসীন এমপি, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কপাল পুড়তে পারে বলেও আভাস দিচ্ছে।
এ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের ৪১ নেতা। দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তারা। তাদের মধ্যে অন্তত ১৪ জন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ছেন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এই নেতাদের ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীরা। কোনো কোনো আসনে অন্য দলের হেভিওয়েট প্রার্থী থাকার কারণেও জয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না নৌকার প্রার্থীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপিসহ বেশ কিছু দল অংশ না নিলেও এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে চায় আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সুন্দর নির্বাচন আয়োজনে বদ্ধপরিকর।
গত দুই নির্বাচনের মতো ফরিদপুর-৪ আসনে আবারও মুখোমুখি হয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ এবং যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। গত দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্লাহ স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সনের কাছে হেরেছেন।
নানাবিধ কারণে নিজ এলাকায় আলোচিত মাদারীপুর-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। এবার তার বিরুদ্ধে লড়ছেন কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম। এই আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে নৌকা ও ঈগল প্রতীকের প্রার্থীর মধ্যে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ কুষ্টিয়া-৩ আসনে নির্বাচন করছেন। তবে তাকে এবার চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলীর ছেলে পারভেজ আনোয়ার তনু। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আলী কুষ্টিয়া পৌরসভার পাঁচবারের নির্বাচিত মেয়র।
দলের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মণিকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে চাঁদপুর-৩ আসনে। এই আসনে মোট ৭ জন প্রার্থী থাকলেও দীপু মনির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ সামছুল হক ভূঁইয়া।
ফরিদপুর-১ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমানকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলতে পারেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ্ মোহাম্মদ আবু জাফর। তিনিও এই আসনের সাবেক এমপি।
চাঁদপুর-২ আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তার সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য এম ইসফাক আহসানের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে।
দলের আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলামকেও ঢাকা-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হাবিবুর রহমানের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। এখানেই কামরুলকে, বিরোধীদের ভোট নির্বাচনী হিসাবনিকাশ পাল্টে দিতে পারেন।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন মৌলভীবাজার-২ আসনে। এখানে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য এম এম শাহীন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তিনি। ফলে এই আসনে শাহীন সব সময়ই শক্ত প্রার্থী।
আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস নৌকার প্রার্থী হয়েছেন মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে। তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদ ত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব। এরই মধ্যে দুজনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন আহতও হয়েছেন।
নেত্রকোনা-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল মনোনয়ন পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন এ আসনের সাবেক দুই সংসদ সদস্য ইফতিখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু ও মঞ্জুর কাদের কোরাইশী। ফলে এই কেন্দ্রীয় নেতাকে নির্বাচনে কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে।
ঢাকা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য সানজিদা খানমকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। লাঙ্গল প্রতীকের বর্তমান এমপি বাবলার সঙ্গে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে সানজিদার।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের ৪৪ সদস্যের মধ্যে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করা রাজিউদ্দিন আহম্মেদ রাজু, নুরুল ইসলাম নাহিদ ও সালমান ফজলুর রহমান তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে পারেন।
নরসিংদী-৫ আসনে সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী। নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত বর্ষীয়ান রাজনীতিক রাজুকে এবার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে বলে ধারণা করছেন ওই এলাকার মানুষ।
দোহার ও নবাবগঞ্জ নিয়ে গঠিত ঢাকা-১ আসনে ফের ভোটযুদ্ধে মুখোমুখি আওয়ামী লীগের সালমান ফজলুর রহমান ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলাম। এই আসনে সেয়ানে সেয়ানে লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সিলেট-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ। এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। রাজনীতির নানা হিসাবনিকাশে এবার নুরুল ইসলাম নাহিদকে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হচ্ছে বলে ধারণা করছেন এলাকাবাসী।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নোয়াখালী-৫ আসনে নৌকার প্রার্থী হয়ে পার হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, নোওয়াখালী-৩ বেগমগঞ্জ থেকে কিরনের নৌকার দৌড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মিনহাজ আহমেদ জাবেদের ট্রাকের গতি অনেক বেশি থাকায়, জয়ের মালা এবার কপালে নাও জুটতে পারে দুই বারের সাংসদ কিরনের। মানিকগঞ্জ-২ আসনের জনপ্রিয় গায়িকা মমতাজের নৌকার দৌড় এবার বেশ ধীর গতি, ত্রিমুখী প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়া মমতাজের জন্য কঠিন অগ্নি পরীক্ষা। আর ঈগল নিয়ে মানিকগঞ্জ-১ আসন ছোঁমেরে নিচ্ছেন, সাবেক যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ। দল-মত নির্বিশেষে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করছেন ঈগল প্রতিকের এসএম জাহিদ।
এদিকে নৌকা পেয়েও কঠিন লড়াইয়ে ইনু-মেনন-মঞ্জুরা। ১৪ দলের শরিকদের ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনের চারটিতেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের অবস্থান বেশ শক্তিশালী। স্থানীয় আওয়ামী লীগকে পাশে পাচ্ছেন না রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও ফজলে হোসেন বাদশা।
শরিকদের যে ছয়টি আসন ছাড়া হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা জোটের প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ করতে যাচ্ছেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিকেই।