জনস্বাস্থ্যের জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেই লক্ষ্যে দেশের ৫২ জেলায় পানির গুণগত মান পরীক্ষার জন্য স্থাপন করা হয়েছে পানি পরীক্ষাগার। স্থানীয় সরকার বিভাগ ১৭৮ কোটি ৫৬ লাখ ১৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘পানির গুণগতমান পরীক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’ নামে প্রকল্পের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নের দারপ্রান্তে। প্রকল্পের আওতায় নতুন পরীক্ষাগারে পানি পরীক্ষা কার্যক্রম শক্তিশালী ও গতিশীল হবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজের সক্ষমতাও বাড়বে। ফলে সারাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তাছাড়া পানি পরীক্ষার সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে জনসাধারণ নিরাপদ পানি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে এবং পানিবাহিত নানাবিধ রোগ হতে মুক্ত থাকতে পারবে। তাতে জনগণের নাগরিক সুবিধা বাড়বে। স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
জানা গেছে, এই প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে দেশে পানির গুণগত মান পরীক্ষার জন্য ১২টি পরীক্ষাগার ছিল। কিন্তু সারাদেশের সব জেলার পানি পরীক্ষার জন্য ওই পরীক্ষাগারগুলো যথেষ্ট নয়। বরং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিটি জেলার বিভিন্ন উৎসের পানির গুণগত মান পরীক্ষা করা জরুরি। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পানির গুণগত মান পরীক্ষায় বাকি ৫২টি জেলায় পানি পরীক্ষাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। বর্তমানে ময়মনসিংহ, রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনা, ঝিনাইদহ, রংপুর, বগুড়া, সিলেট, টঙ্গী, বরিশাল, নোয়াখালী ও ঢাকাসহ মোট ১২টি পানি পরীক্ষাগার রয়েছে। সব পানি পরীক্ষাগার থেকে অনেক জেলার দূরত্ব বেশি হওয়ায় পানি পরীক্ষার জন্য নিয়মিত নমুনা সংগ্রহ ও পরিবহনে জটিলতা দেখা দেয়। ফলে অনেক পানি পরীক্ষার সঠিক ফল পাওয়া যায় না। তাছাড়া চলমান বিভিন্ন প্রকল্পে স্থাপিত নতুন উৎসের পানি পরীক্ষার জন্য ১২টি পানি পরীক্ষাগারের কার্যক্রম ক্রমেই বাড়ছে। তাই প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার সুপারিশ অনুযায়ী দেশের অবশিষ্ট ৫২টি জেলায় নতুন ৫২টি পানি পরীক্ষাগার স্থাপনের জন্য এই প্রকল্পটির প্রস্তাব করা হয়। যা একনেক সভায় অনুমোদন পায়। কারণ সব কাজেই নিরাপদ পানি ব্যবহার করা জনস্বাস্থ্য রক্ষার অন্যতম উপায়। রাসায়নিক দ্রব্য ও জীবাণুর উপস্থিতির কারণে দূষিত পানি পান করা ও গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার করার ফলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। সার্বিকভাবে দেশে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার আওতা বাড়ার হার সন্তোষজনক হলেও সরবরাহ করা পানির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে প্রায়ই ব্যবহারকারীরা অনিশ্চিয়তায় ভোগেন। বর্তমানে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি বাংলাদেশের বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই পানির মান পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র আরো জানায়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর আশির দশকে প্রথম পানি পরীক্ষাগার স্থাপন করে। বর্তমানে ওই অধিদফতরের অধীন ১১টি আঞ্চলিক পানি পরীক্ষাগার এবং ঢাকায় একটি কেন্দ্রীয় পানি পরীক্ষাগারসহ মোট ১২টি পরীক্ষাগার রয়েছে। কোনো স্থানের ভূ-গর্ভস্থ পানির মান সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধান করা ও পানির উৎসগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত হওয়ার জন্য এসব পরীক্ষাগারে পানি পরীক্ষা করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও পানির নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করার মাধ্যমে ওই পানির গুণগত মান সম্পর্কে জানা যায়। যা দেশের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা আরো মানসম্পন্ন করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের অধীন পরিচালিত পরীক্ষাগারগুলোতে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী যন্ত্রপাতি দিয়ে পানির বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার সুবিধা রয়েছে। ওসব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, এমনকি এদের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার কাজেও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প থেকে কিছু কিছু তহবিল সংগ্রহ করে ১২টি পরীক্ষাগারে পানি পরীক্ষার রাসায়নিক দ্রব্য সংগ্রহ কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তহবিল ও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে পানি পরিবীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের নতুন কাজ হাতে নেয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়া প্রয়োজনবোধে নতুন নতুন প্যারামিটার পরীক্ষা করে পানির গুণগতমান যাচাই করা প্রয়োজন হতে পারে।
এদিকে দেশে নতুন যেসব জেলায় পানি পরীক্ষাগার স্থাপন করা হয়েছে তারমধ্যে ৮টি বিভাগের ৫২টি জেলার মধ্যে ঢাকা বিভাগের জেলাগুলো হচ্ছে- নরসিংদী, শরিয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর। চট্টগ্রাম বিভাগের জেলার মধ্যে রয়েছে- ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও খাগড়াছড়ি। রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলো হলো- সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ। তাছাড়া খুলনা বিভাগে যশোর, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা ও বাগেরহাট। ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রকোণা জেলা। বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা ও বরগুনা; সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ এবং রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও ও কুড়িগ্রাম জেলা এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছে।
এ প্রকল্প সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্প প্রস্তাব পাওয়ার পর ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দেয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠন করা হয়।
প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গিস পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে ভোরের পাতাকে বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সারাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য পানি পরীক্ষাগার নেই এমন ৫২টি জেলা সদরে ৫২টি নতুন পানি পরীক্ষাগার স্থাপন করা হবে। পানি পরীক্ষার সুবিধা তৈরির মাধ্যমে জনসাধারণ নিরাপদ পানি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে এবং পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ হতে মুক্ত থাকতে পারবে। এতে জনগণের নাগরিক সুবিধা বাড়বে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান দৈনিক ভোরের পাতাকে বলেন, এদেশের পানির মান এখন খুবই ভাল। আগে আরো খারাপ ছিল। মানুষের নানা ধরনের রোগ ব্যাধি হতো। দেশে এখন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে পানি বাজারজাত হয়। পানির মান যেন আরো ভাল হয় সেজন্যই এই প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সবার জন্য সুপেয় পানির বিষয়টি অনেক এগিয়ে যাবে। বিশেষ করে এই প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষ পাবে নিরাপদ সুপেয় পানি যা মানুষকে সুস্থ্য জীবন-যাপনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের পানির গুনগতমান পরীক্ষার জন্য যে সকল ল্যাবরেটরী রয়েছে তার মধ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পরীক্ষাগার সমূহ অন্যতম। পানির গুনগতমান পরীক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত ল্যাবরেটরী সমূহের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে পানি পরীক্ষা করা হবে। এতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ নিরাপদ এবং পরীক্ষিত বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারবে। ফলে জনসাধারণ নানা ধরনের রোগ ব্যাধি থেকে রক্ষা পাবে। পানির গুনগতমান পরীক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে, নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতাধীন পানি পরীক্ষাগারের সামগ্রিক সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ।
অত্র প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৫২টি জেলায় নতুন ল্যাবরেটরী তৈরী করা হয়েছে। সকল ল্যাবরেটরী সমূহে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, কম্পিউটার, ফটোকপিয়ার এবং ল্যাবরেটরীর ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করা সম্পন্ন হয়েছে। কিছু কিছু জেলায় পানি পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে, এতে সাধারণ জনগণ পানি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে বিশুদ্ধ পানি পান করছে। প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ খুব দ্রুতই সমাপ্ত হবে। সকল পানি পরীক্ষাগারের কার্যক্রম চালু করার জন্য নতুন ল্যাবরেটরীর প্রয়োজনীয় জনবল সরবরাহ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশনকে কিছু জনবলের চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে। জনবল সরবরাহ ও সকল কাজ সমাপ্ত হলে জনসাধারণের স্বাস্থ্য খাতে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের অধিনে আহবানকৃত দরপত্রে কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট তৈরি করে নি¤œমানের মালামাল সরবরাহ করার অপপ্রয়াস চালায়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি যথাযথভাবে দরপত্র মূল্যায়ন করলে বাধ পড়ে যায় তারা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে।