ড. কাজী এরতেজা হাসান
দেশে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কতটা দুর্বৃত্ত যে এরা অতিমুনাফার জন্য যা খুশি তাই করছে। মানুষকে জিম্মি করে এরা মুনাফা লুটছে। এদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে যেমন প্রতিবাদ গড়ে তোলার বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ১১টি বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তার মধ্যে এক নাম্বারে হয়েছে ‘দ্রব্যমূল্য সকলের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।’ যা সত্যিই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। আর অসাধু ব্যবসায়ীদের রুখার এখনই সময়। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে কোটি কোটি ভোক্তা অতিষ্ট এবং ভোগ্যপণ্য তাদের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে।
বর্তমানে যে মূল্যস্ফীতি বহুগুণ বেড়ে গেছে, এসব অসাধু মুনাফাখোর ব্যবসায়ী দুর্বৃত্তদের কারণে। তবে এটাও ঠিক যে মানুষের অতিনিত্যপণ্য জিনিসের মধ্যে একটি চিনি। দেশের বহু সরকারি চিনির কল অলাভজনক হওয়ায় এবং দেনারভাবে ন্যুব্জ হয়ে পড়ায় সরকার তা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে চিনির বাজার একচেটিয়াভাবে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে। সরকারি চিনিকলগুলোকে দক্ষ ম্যানেজম্যান্টের মাধ্যমে চালিত করে লাভজনক করার কথা যেমন ভাবা হয়নি এবং এগুলো বন্ধ হয়ে গেলে দেশের মানুষের কি হবে? কত দামে চিনি কিনে খেতে হবে, তা একবারও ভাবা হয়নি। বরং আমাদের মনে জয়, ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারি চিনিকলগুলোকে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করে। তা, দেনাভারে ন্যুব্জ করা হয়েছে। যদি সঠিকভাবে দুর্নীতিমুক্তভাবে এগুলো চলতো, তাহলে অবশ্য লাভজনক হত। বেসরকারি চিনিকলগুলো কিভাবে লাভ করছে? তা, কি সরকারের শিল্পমন্ত্রণালয় একবারও ভেবে দেখেছে। বরং এও বলা যায়, সরকারি চিনিকলগুলোকে লাভজন করার চিন্তাই করা হয়নি এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে চিনির ব্যবসা এক চেটিয়াভাবে করার সুযোগ দেওয়ার জন্য এটা করা হয়েছে। এতো গেল চিনির কথা। গত কয়েক মাসে কোন ভোগ্যপণ্য দাম হু হু করে বাড়েনি? বাজারে ব্যবসায়ীর ছড়িয়ে দেয় যে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই তারা কি করবে? কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যে পণ্যের দাম বাড়েনি। তারপরও সেটির দাম বাড়ানো হয়েছে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যেভাবে কারসাজি করে যাচ্ছে, তা সকল রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তা নীরব দর্শক হয়ে দেখছে। কোনও ক্ষমতা নেই তা বন্ধ করার। এমনই প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্ন উঠা কি অন্যায়? আরও বুঝা যায় যে, ব্যবাসায়ী সিন্ডিকেট সরকারদলীয় লোক বলে দুর্বৃত্তপরায়ন হয়ে উঠেছে। সরকারি দলের সিল গায়ে থাকলে সব অন্যায় মাফ। ভোগ্যপণ্যের দাম ৪০০ শতাংশ বাড়ালেও কিছু হবে না। জনগণের টাকা অন্যায়ভাবে পকেটে পুরলে সরকার কিছু বলবে না, চুপ থাকবে। এই যদি কালচার হয়। ভোগ্যপণ্যের দাম ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটে ইচ্ছেই বাড়িয়ে দেয়। তার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তা হলে তো ব্যবসায়ীরা সুযোগে সৎ ব্যবহার করবেই।
জানা গেছে, দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে সমন্বয়হীনতা ও মূল্যবৃদ্ধির চিত্র ফুটে উঠেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের একটি প্রতিবেদনে। তাদের হিসাবে চাল, ডাল, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা ও রসুনের দাম পাঁচ বছরের ব্যবধানে ১২ থেকে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। মূলত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দেওয়া নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকা থেকে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারির মূল্যের সঙ্গে ২০২৩ সালের ২০ ডিসেম্বরের মূল্য তালিকার তুলনা করে এসব তথ্য দিয়েছে সংস্থাটি।
সিপিডির ওই মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেছিলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে বৈষম্য আরো প্রকট হচ্ছে। এতে আমরা আবারও এক দেশে দুই অর্থনীতির পথে চলে যাচ্ছি। অথচ দুই অর্থনীতির বিরুদ্ধেই বঙ্গবন্ধু লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন। কিন্তু এখন সম্পদের বণ্টনব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আবারও দুই সমাজ বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে।’
প্রতিবেদনে সিপিডি বলছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে মিনিকেট চাল (প্রতি কেজি) ছিল ৫৮ টাকা। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাস তা ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শতাংশের হিসাবে দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ। পাঁচ বছরের ব্যবধানে খোলা পাম অয়েলের (প্রতি লিটার) দাম বেড়েছে ১০২ শতাংশ। ২০১৯ সালে পাম অয়েলের দাম ছিল ৬৩ টাকা। বর্তমানে তা ১২৮ টাকা। দেশীয় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২৮২ শতাংশ। ২৭ টাকার দেশি পেঁয়াজ হয়েছে ১০৫ টাকা। আমদানীকৃত পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৩৩৩ শতাংশ। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে পেঁয়াজ ছিল ৩০ টাকা। বর্তমান বাজারে তা ১৩০ টাকা। দামের দিকে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রসুনের দাম, শতাংশের হারে তা প্রায় ৪০০শতাংশ। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে দেশি রসুনের দাম ছিল ৫০ টাকা। বর্তমানে তা ২৫০ টাকা। এ ছাড়া শুকনা মরিচ প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ১২৩ শতাংশ। আদার দাম বেড়েছে ১১৮ শতাংশ। প্রকারভেদে গুঁড়া দুধের দাম বেড়েছে ৪৪ থেকে ৮১ শতাংশ। চিনির দাম বেড়েছে ১৭৭ শতাংশ। প্রকারভেদে মসুর ডালের দাম বেড়েছে গড়ে ৫৬ থেকে ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত। এর আগে ব্রিফিংয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক সুদের হার বাড়ানো হলেও উদ্যোগটা অনেক বিলম্বে নেওয়া হয়েছে, যার প্রভাবে পণ্যের দাম কমা শুরু হয়নি।’
ভোগ্যপণ্য নিয়ে যে কাণ্ডজ্ঞানীভাবে ব্যবসায়ীরা আচরণ করে আসছে এবং এখনও করে যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনও উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়েনি। যা করা হয়েছে তা নাম দেখানো। ভোক্তা অধিকার দপ্তর অভিযানের নামে যা করে তাও লোক দেখানো। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এতটাই ক্ষমতাধর যে তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করে কে? তবে আমরা বলবো, জনগণের কথা ভেবে মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর দুর্বৃত্তপরায়ন কর্মকাণ্ড মেনে নেওয়া যায় না। সিন্ডিকেট করে তারা ইচ্ছেমতো ভোগ্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়িয়ে দেবে, এটা হয় না। শেখ হাসিনা সরকার দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য অনেক কিছু করেছে। কিন্তু পণ্যের দাম লাগামছাড়া হওয়ায় মানুষ কষ্টে আছে। সরকারের উচিত এটি দেখার। কোনও দেশে ভোগ্যপণ্যের দাম এভাবে বাড়ে না। ভাবলে অবাক হতে হয় যে পণ্যের দাম ৪০০ শতাংশ বাড়িয়ে মানুষকে কতটা কষ্টে রাখা যায়, তার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত ব্যবসায়ীরা।
লেখক:
সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা, দ্য পিপলস টাইম;
সহ-সভাপতি, সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগ;
সাবেক পরিচালক, এফবিসিসিআই;
চেয়ারপারসন, ভোরের পাতা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ।