পাবনার ৫টি আসনের মধ্যে সবার নজর পাবনা-৩ (চাটমোহর-ভাঙ্গুড়া-ফরিদপুর) আসনে। কারণ একমাত্র এই আসনেই হবে নৌকা আর ট্রাক প্রতিকের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। অন্য আসনগুলোতে অনেকটাই নির্ভার নৌকার প্রার্থীরা। তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস নেই। কিন্তু পাবনা-৩ এর নৌকার প্রার্থী ট্রাক প্রতিক নিয়ে আছেন বেশ অস্বস্তিতে।
ইতিমধ্যে ট্রাক প্রতিকের অফিসে কয়েক দফা হামলা, ভাঙচুর, প্রকাশ্যে হুমকি ধামকি ও উস্কানীমুলক বক্তব্য, সমর্থকদের মারধর, নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। এসব নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনাও চলছে।
এই আসনে নৌকা নিয়ে লড়ছেন তিনবারের সাংসদ ও পঞ্চমবারের মতো দলীয় মনোনয়ন পাওয়া জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি আলহাজ্ব মকবুল হোসেন। মকবুল হোসেনের বয়স হয়ে গেছ এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ্য তিনি। এটাই জীবনের শেষ নির্বাচন বলে জানিয়েছেন তিনি।
আর তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন ট্রাক প্রতিক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য ও চাটমোহর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ মাস্টার। সাংসদ প্রাথী হিসেবে এটাই তার প্রথম নির্বাচন।
দু'জনের মধ্যে মকবুল হোসেনের বাড়ি ভাঙ্গুড়া উপজেলায় এবং আব্দুল হামিদ মাস্টারের বাড়ি চাটমোহর উপজেলায়। দুইজনেরই রয়েছে আলাদা ভোট ব্যাংক।
নিরুত্তাপ ভোটকে উৎসবমুখর, অংশগ্রহনমুলক ও গ্রহণযোগ্য করতে ভোট ঘিরে নানা পরিকল্পনা করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ভোটারকে ভোট কেন্দ্রে টানতে পরিকল্পনার অংশ হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থী। অর্থাৎ নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় নেতারাই অংশ নিতে পারছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগের। যার বাস্তব চিত্র দেখা যাচ্ছে পাবনা-৩ আসনে।
এ নিয়ে চলছে চুলচেরা নানা বিশ্লেষণ। সবারই ধারণা ছিল বয়সের কারণে এবার হয়তো মনোনয়ন পাবেন না মকবুল হোসেন এমপি। যেকারণে এ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন ১৮ জন আওয়ামীলীগ নেতা। কিন্তু সব জল্পনা কল্পনাকে পাশ কাটিয়ে টানা তিনবারের এমপি মকবুলকেই আবার মনোনয়ন দিয়েছে দল।
তাকে নিয়ে পাবনা-৩ আসনের চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলায় স্থানীয় আওয়ামীলীগে গ্রুপিং রয়েছে। একটি গ্রুপের সাথে সম্পর্ক রেখেছেন মকবুল হোসেন। অন্য গ্রুপ রয়েছে উপেক্ষিত। এসব নিয়ে অনেক নেতাকর্মীর চাপা ক্ষোভ রয়েছে বর্তমান সাংসদ মকবুলের উপর। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে নির্বাচনে। এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল হামিদ মাস্টার। কারণ বঞ্ছিত, উপেক্ষিত আওয়ামীলীগের একটি বড় অংশ মাঠে নেমেছে তার পক্ষে। ফলে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা এখন দুই ভাগ হয়ে দুই প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন।
পাবনা-৩ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৭ জন। এর মধ্যে চাটমোহর উপজেলায় ২ লাখ ৪৪ হাজার ১৬৫ জন, ভাঙ্গুড়া উপজেলায় ১ লাখ ১ হাজার জন এবং ফরিদপুর উপজেলায় ১ লাখ ১০ হাজার ৪৫২ জন ভোটার রয়েছে। অর্থাৎ ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর দুই উপজেলা মিলিয়ে যে মোট ভোট তার চেয়ে ৩৩ হাজার ভোট বেশি চাটমোহর উপজেলায়।
জেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও বিএমএ পাবনা জেলা শাখার সভাপতি ডা. গোলজার হোসেন বলেন, গত ১৫ বছর টানা তিনবার মকবুল হোসেন এমপি থাকাকালে আশানুরূপ উন্নয়ন হয়নি। তার নিজ এলাকা ভাঙ্গুড়া ছাড়া বাকি দুই উপজেলা চাটমোহর ও ফরিদপুরে উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে। তাছাড়া মকবুল হোসেন বয়সের ভারে ন্যুজ। নতুন লোক আসা দরকার।'
দীর্ঘ বছর ধরে চাটমোহর থেকে কোন এমপি পায়নি এখানকার দলীয় নেতাকর্মী সহ সাধারণ মানুষ। তাছাড়া ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলার মোট ভোটারের চাইতে চাটমোহর এক উপজেলায় ভোট বেশি। তাই আঞ্চলিকতার টানে এগিয়ে আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল হামিদ। এমনটাই মত চাটমোহর পৌর সদরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী হেলালুর রহমান জুয়েলের।
অন্যদিকে ফরিদপুর উপজেলার ভোটাররাও জয় পরাজয়ে একটা ফ্যাক্টর হতে পারে। তাই চাটমোহর ও ফরিদপুর উপজেলার ভোটারদের মন যিনি বেশি জয় করতে পারবেন তিনি সহজে জয় বের করে আনতে পারবেন বলে ধারণা করছেন ভোট বিশ্লেষকরা। তবে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি ও নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে থাকায় ট্রাক প্রতিক নিয়ে তাই অস্বস্তি নৌকার শিবিরে।
অপরদিকে, টানা তিনবার এমপি থাকায় মকবুল হোসেনের আলাদা ভোট ব্যাংক আছে তিন উপজেলায়। সেক্ষেত্রে তিনিও পিছিয়ে নেই। তার সাথে রয়েছে অনেক নেতাকর্মী। মকবুল হোসেনের সমর্থকদের মতে, তিনি এমপি থাকাকালে বেশকিছু উন্নয়নমূলক কার্যক্রম করেছেন। তার কাছে গিয়ে কেউ নিরাশ হয়নি। তাই তিনি এবারও নির্বাচিত হবেন বলে মনে করেন তারা। আবার তার পক্ষে প্রতিদিনই জেলা আওয়ামীলীগের কিছু নেতা নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে তার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। সবমিলিয়ে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে একটি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস মিলেছে পাবনা-৩ আসনে।
এ বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল হামিদ মাস্টার বলেন, 'বর্তমান এমপি তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। উন্নয়ন বঞ্ছিত মানুষ আমাকে চাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি। ভোটাররা একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায়। আর সুষ্ঠু ভোট হলে আমি বিপুল ভোটে জয়ী হবো। কিন্তু প্রতিদিনই আমার নেতাকর্মী সমর্থকদের নানাভাবে হুমকি ধামকি দিচ্ছে নৌকার লোকজন। শহর থেকে নেতারা এসে উস্কানীমূলক ও মানহানিমুলক বক্তব্য দিচ্ছেন। নৌকার লোকজন আমার নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করছে, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে। তাই নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে অনুরোধ করবো যেন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়। তা না হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।'
বর্তমান সাংসদ ও নৌকার প্রার্থী মকবুল হোসেন বলেন, 'আমরা যতজনই প্রার্থী হয়েছি সবাই মিলে একটি সুন্দর নির্বাচন দেঘশকে উপহার দেবো। দলীয় নেতাকর্মী সবাইকে নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা মেনে চলতে অনুরোধ করছি। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামুলক হবে বলে আশা করি।বিগত সময়গুলোতে পাবনা-৩ আসনে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছি। নির্বাচিত হলে অমার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করবো। এটাই আমার জীবনের শেষ নির্বাচন। আমার নেতাকর্মী কাউকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে না। স্বতন্ত্র প্রার্থী কেন অভিযোগ করছেন, সেটা তার বিষয়।'
পাবনা-৩ আসনে এবার প্রার্থী ৭ জন। তারা হলেন, আলহাজ্ব মকবুল হোসেন (আওয়ামীলীগ), আব্দুল হামিদ মাস্টার (স্বতন্ত্র), মীর নাদিম মোহাম্মদ ডাবলু (জাতীয় পার্টি), মাহবুবুর রহমান জয় চৌধুরী (বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টি-বিএসপি), বেলাল মোল্লা (ন্যাশনাল পিপলস পার্টি), আবুল বাশার শেখ (জাসদ) ও আজিজুল হক (বাংলাদেশ কংগ্রেস)।
এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৭৭১ জন। পুরুষ ভোটার ২ লাখ ২৮ হাজার ৬৪৯ জন, নারী ভোটার ২ লাখ ২৮ হাজার ১১৮ জন, হিজরা ৪ জন।