ঢাকায় এইডস রোগী বেশি শনাক্ত হচ্ছে। একসময় শিরায় মাদক গ্রহণকারী, যৌনকর্মী, সমকামী এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইডস বেশি শনাক্ত হতো। এখন সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ রোগ শনাক্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইচআইভি এইডসের ২০২৩ সালের সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে এক বছরে এক হাজার ১০০ এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর আগে কোনো বছর এতো রোগী দেখা যায়নি। এ নিয়ে এইডসে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো প্রায় ১১ হাজার। এর আগে ২০২০ সালে রোগী শনাক্ত হয়েছিলো ৯৪৭ জন। এবার ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর চেয়ে সাধারণ মানুষ এইচআইভিতে বেশি সংক্রমিত হয়েছে। প্রতি বছরের মতো রোগী শনাক্তের শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শনাক্ত হওয়া রোগী চিকিৎসা না নেয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এইডস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। এ সমস্যা মোকাবিলায় পরীক্ষা ও চিকিৎসা সেবার পরিধি বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস প্রতিরোধ কর্মসূচির তথ্য বলছে, বছরে নতুন শনাক্তদের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অভিবাসী অথবা তাদের পরিবারের। মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি দেশে প্রবেশের আগেই এইচআইভি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে আক্রান্ত হয়ে দেশে ফেরত আসার পর তাদের শনাক্তে বিমানবন্দরে ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক প্রশাসন অধ্যাপক শামিউল ইসলাম বলেন, সিরাজগঞ্জে এইচআইভি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ার কারণ সেখানে কর্মসূচি না থাকা।
স্যালুন থেকেও হতে পারে এইডস: স্যালুন থেকে এইডস রোগ ছড়াতে পারে এ বিষয়ে ধারণা নেই গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার স্যালুনকর্মীদের। অথচ বিশষজ্ঞরা বলছেন, মানবদেহে এইডস ছড়ানোর অন্যতম একটি মাধ্যম স্যালুন। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনো সচেতনতা নেই। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়নি। ফলে হাজারো মানুষ ঝুঁকি নিয়ে সেবা নিচ্ছেন। স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানবদেহে অনেক কারণে এইডস ছড়ায়। এর মধ্যে অনিরাপদ যৌন মিলন, আক্রান্ত রোগীর রক্ত গ্রহণ কিংবা এইডস জীবাণুবাহী কিছু দ্বারা শরীর কেটে যাওয়া অন্যতম। স্যালুনকর্মীদের মাধ্যমে কেটে গিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে এ রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে। অথচ স্যালুনকর্মীরা এর ভয়াবহতা সম্পর্কে না জেনেই কাজ করছেন বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শাহিনুল ইসলাম ম-ল। এ কর্মকর্তার ভাষ্য, স্যালুনকর্মীদের সচেতন করতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। ২০ বছর ধরে স্যালুনে কাজ করলেও এইডসের বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাননি বলে জানান উপজেলা পরিষদ এলাকার স্যালুনকর্মী শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, উপার্জনের জন্য এ কাজ করছেন। তাদের মাধ্যমে রোগটি ছড়াতে পারে, এটি তাঁর জানা নেই। এ নিয়ে কেউ কখনও বোঝাতে আসেননি। স্যালুনে চুল কাটা শেষে এবং শেভের পর ফিটকিরি, ক্রিম বা লোসন লাগিয়ে দেন কর্মীরা। এতে স্যালুন থেকে এইডস রোগ ছড়ানো কিংবা অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে দাবি আরেক স্যালুনকর্মী সাদা মিয়ার। তবে তাঁরও এইডস বিষয়ে তেমন ধারণা নেই। জানারও চেষ্টা করেননি। স্যালুনের ক্ষুর, কাঁচি, ব্লেডসহ অন্য অস্ত্রপাতি সব সময় পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন বলে জানান চিকিৎসা কর্মকর্তা সুরঞ্জন কুমার সরকার। তিনি বলেন, এসব সামগ্রী গরম পানিতে চুবিয়ে রাখতে হয়। ব্যবহারের পর সুন্দরভাবে না ধুলে অন্যের শরীরে জীবাণু প্রবেশ করে। কে এইডসের জীবাণু বহন করছে, তা বোঝার দক্ষতা নেই কর্মীদের। হাট-বাজারে যত্রতত্র বসে অনেকে চুল-দাড়ি কাটার কাজ করেন। স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের কাছে যান। তবে তাদের এ বিষয়ে ধারণা নেই বলে দাবি সাদুল্লাপুর বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান সাবুর।
সাদুল্লাপুরে প্রায় ৬০০ স্যালুনকর্মী রয়েছেন বলে জানান, উপজেলা স্যালুন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মফিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, স্যালুনে কাজ করায় তাদের অবহেলা করা হয়। প্রশিক্ষণ দেবে কে? কর্মসংস্থানের জন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে স্যালুনকর্মীদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই বলে জানান যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াহাব সরকার। তাদের সচেতন ও কর্মদক্ষ করতে প্রশিক্ষণের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন তিনি। স্যালুনকর্মীদের প্রশিক্ষণে স্বাস্থ্য বিভাগের এগিয়ে আসা জরুরি বলে মনে করেন ইউএনও কাওছার হাবিব। ওসি মাহবুব আলম বলেন, এইডস প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি স্যালুনকর্মীদের সচেতনতার উদ্যোগ নিতে হবে।
উদাসীনতায় এইডস সংক্রমণের ঝুঁকি: চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে অ্যান্টি রেক্ট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টারে শিশুসহ ৭১ জনের নমুনায় এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস শনাক্ত হয়েছে। একই সময়ে এই জীবাণু বহনকারী শিশুসহ ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই অবস্থা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও। গত এক বছরের রেকর্ড পরিমাণ এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শনাক্ত হওয়া রোগী চিকিৎসা না নেওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এইডস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। সমস্যা মোকাবিলায় পরীক্ষা ও চিকিৎসা সেবার পরিধি বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্র মতে, একসময় শিরায় মাদক গ্রহণকারী, যৌনকর্মী, সমকামী এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইডস বেশি শনাক্ত হতো। এখন সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ রোগ শনাক্ত হচ্ছে।
সারাদেশে ১৩ কেন্দ্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও এইডস রোগী ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয় রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে। এই হাসপাতালে জ্বর, মাথাব্যথা, ফুসকুফ বা গলা ব্যথা ও অন্যান্য জটিল রোগের লক্ষণ নিয়ে আসা ১০ শতাংশ ব্যক্তির এইচআইভি এইডস শনাক্ত হয়েছে। এ কেন্দ্রে শনাক্ত হওয়া ৬৬ শতাংশই বিদেশ থেকে আসা। তাদের সবাই পূর্ণাঙ্গ সুস্থতার প্রতিবেদন নিয়ে বিদেশ গিয়েছিলেন। তবে আসার ক্ষেত্রে বিমানবন্দরে পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় অনেকটা বাধাহীনভাবেই তারা দেশে ঢুকছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস প্রতিরোধ কর্মসূচির তথ্য বলছে, বছরে নতুন শনাক্তদের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অভিবাসী অথবা তাদের পরিবারের। মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি দেশে প্রবেশের আগেই এইচআইভি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে আক্রান্ত হয়ে দেশে ফেরত আসার পর তাদের শনাক্তে বিমানবন্দরে ব্যবস্থা নেই। ২০২২ সালের নবেম্বর থেকে ২০২৩ সালের নবেম্বর পর্যন্ত সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে আসা ১ হাজার ৫৪২ সন্দেহভাজন ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশের এইডস শনাক্ত হয়েছে। ২০২২ সালে এ হার ছিল ৬ শতাংশ। শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির ৬৬ শতাংশই বিদেশ ফেরত। ২১ শতাংশ সমকামী। এইডস শনাক্ত হওয়া ১২ শতাংশ যক্ষ্মার রোগী। এদের ৬ শতাংশ রোহিঙ্গা। ৫ শতাংশ ব্যক্তির মা-বাবা থেকে এইচআইভি হয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসকরা বলছেন, এইচআইভি পজিটিভ ৯৮ শতাংশ মা সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারেন।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে এইডস রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আরিফুল বাশার বলেন, এ হাসপাতালে জটিল রোগীর সেবা দেওয়া হয়। তবে সংকট হলো, এসব রোগীর চিকিৎসায় যে ধরনের ল্যাব সুবিধা থাকা জরুরি, তা নেই। অনেক সময় এইডস আক্রান্ত রোগীর অস্ত্রোপচার ও হার্টের রিং পরানো প্রয়োজন হলেও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো চিকিৎসা দিতে চায় না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২৩ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে এক বছরে ১ হাজার ১০০ এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর আগে কোনো বছর এত রোগী দেখা যায়নি। এ নিয়ে এইডসে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ১১ হাজার। এর আগে ২০২০ সালে রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৯৪৭ জন। এবার ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর চেয়ে সাধারণ মানুষ এইচআইভিতে বেশি সংক্রমিত হয়েছে। প্রতিবছরের মতো রোগী শনাক্তের শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের নবেম্বর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ১০০ জন এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আনুমানিক সাড়ে ১৪ হাজার রোগী রয়েছে। এসব রোগীর ৩৭ শতাংশ এখনও শনাক্তের বাইরে। আর চিকিৎসার বাইরে রয়েছে ২৩ শতাংশ রোগী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, রোগী শনাক্তের দিক থেকে ঢাকার পরে রয়েছে রাজশাহী বিভাগ। এর পরে চট্টগ্রাম বিভাগ। তবে সম্প্রতি সিরাজগঞ্জে অস্বাভাবিক হারে এইডস রোগী শনাক্ত হচ্ছে। গত এক বছরে সেখানে ১৪৪ এইডস রোগী মিলেছে। যাদের মধ্যে ৯৮ শতাংশই সুঁই-সিরিঞ্জের মাদকসেবী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এইচআইভি সংক্রমণের এখনো কোনো প্রতিকার নেই। তবে কার্যকর এইচআইভি প্রতিরোধ, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে রোগাক্রান্তদের স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াও একাধিক কারণে এইচআইভি পজিটিভ হতে পারে। এইডসের জন্য দায়ী ‘হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস’ (এইচআইভি) নামের রেট্রোভাইরাসটি। মানুষের রক্ত ও অন্যান্য দেহ রসেই একমাত্র বেঁচে থাকে এই ভাইরাস। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এমনকি সর্দি-কাশিকেও আটকাতে পারে না শরীর।