এইডস রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়লেও দেশে নেই কোনো পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। একমাত্র ভরসা জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালই। ভাইরাস সৃষ্ট রোগ এইডস বা অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম। রোগটি মানব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। ফলে যেকোনো রোগই রোগীকে সহজে কাবু করে ফেলে। ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজার ৫১৩ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০২২ সাল পর্যন্ত এইডসে মারা গেছেন ১ হাজার ৮২০ জন। এ বছর আরও শতাধিক রোগীর মৃত্যু হয়েছে এইডসে। ২০২২ সালে দেশে এইডসে মৃত্যু হয়েছিল ২৩২ জনের। এমন পরিস্থিতিতে সচেতনতার লক্ষ্যে গত ১ ডিসেম্বর সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব এইডস দিবস’। দিবসটির এবারের প্রতিপ্রাদ্য ‘কমিউনিটির আমন্ত্রণ, এইডস হবে নিয়ন্ত্রণ’। চিকিৎসকদের মতে, আক্রান্ত রোগীর শরীর থেকে এইডস নির্মূল করা যায় না। তবে নিয়মিত ওষুধ ও চিকিৎসায় রোগীরা দীর্ঘদিন এইডস থাকা অবস্থাতেও বাঁচতে পারেন।
দেশে প্রাবাসী, সমকামী ও শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে এইডস আক্রান্তের হার বেশি। রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তৃতীয় তলায় এইডস রোগীদের জন্য ২৫ শয্যার দুটি ওয়ার্ড করা হয়েছে। যেখানে গুরুতর রোগীরা চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। ৩ তলার ১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৫ বছর বয়সী সাইম (ছদ্মনাম)। তার মা ও সে পাশাপাশি বিছানায় চিকিৎসা নিচ্ছে। সাইম জানায়, বাবার প্রথম এইডস ধরা পড়ে। তিনি ছিলেন ওয়ার্ড মাস্টার। আমার ৬ বছর বয়সে বাবার এইডস ধরা পড়ে। এরপর আমার মা এবং আমারও এইডস ধরা পড়ে। বাবা এইডস শনাক্তের সপ্তাহের মাঝেই মারা যান। ৯ বছর ধরে চিকিৎসা নিয়ে আমি চলছি। তবে গত একবছর ধরে হাত-পা অবশ হয়ে গেছে। এখন আবার চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে এলাম। ২১ বছর বয়সী কুলসুম (ছদ্মনাম)। গোপালগঞ্জ থেকে এসেছেন। তারও মা-বাবা দুজনই এইডস আক্রান্ত। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গেই থাকে তারা।
এইডস আক্রান্ত অন্য আরেকজনকে বিয়ে করেছেন কুলসুম। বর্তমানে তিনি গর্ভধারণ করেছেন। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি বলেন, ২০০৬ সালে বাবার প্রথম এইডস ধরা পড়ে। এরপর আমার মা এবং আমার টেস্ট করানো হয়। তখন দুজনেরই এইডস ধরা পড়ে। আমার বাবা দুবাই থাকতেন। সেখান থেকেই হয়েছে এ রোগ। আক্রান্ত হওয়ার পর আরও ৮ বছর বেঁচে ছিলেন বাবা। এরমধ্যে আমাদের চিকিৎসা চলছিল। আমার আরও একটি বোন হয়েছে। তবে তার ক্ষেত্রে এইডস নেগেটিভ এসেছে। এজন্যই পরিবারের অন্য সদস্যরা মেনে নিয়েছেন যে এ রোগ থাকলেও এইডস মুক্ত বাচ্চা জন্ম দেওয়া সম্ভব। তিনি জানান, সরকারই ওষুধ দেয়। তবে অসুস্থ হলে নানান টেস্ট করতে হয়। এতে অনেক টাকা খরচ হয় প্রতিবার। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নই, কষ্ট হয়ে যায়। জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তথ্যে জানা যায়, এ পর্যন্ত হাসপাতালটিতে এইডস শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ২৭ জনের। এরমধ্যে মারা গেছেন ১২০ জন। আর নিয়মিত এইডস রোগীদের জন্য চিকিৎসা এআরটি নিচ্ছেন ৭৮১ জন। ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত নতুন করে হাসপাতালটিতে এইডস টেস্ট করা হয়েছে এক হাজার ৫৪২ জনের। এদের মধ্যে এইডস শনাক্ত হয়েছে ১৫৪ জনের। এটি ২০২২ সালের তুলনায় ৪৯ জন বেশি। ২০২২ সালে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১০৫ জন। ২০২৩ সালের এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৩৩ জন এইডস রোগী।
জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তথ্য মতে, চলতি বছরে শনাক্ত রোগীদের মধ্যে বিদেশ ফেরত ১০২ জন বা ৬৬ শতাংশ রোগী। ২২ শতাংশ সমকামী। ২০ জন বা ১৩ শতাংশের যক্ষা পজিটিভ। ৬ শতাংশ মাদকসেবী ও ৬ শতাংশ শিশু। এসব শিশু রোগীর সবাই গর্ভাবস্থায় মা থেকে আক্রান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ ২০২২ সালের তথ্যমতে, দেশে অনুমিত এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ১৪ হাজার ৫১৩। এরমধ্যে ৩৩ শতাংশ এখনো শনাক্তের বাইরে। যারা শনাক্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় আছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, দেশে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কম হলেও মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। এর কারণ এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই ঘৃণার চোখে দেখে বলে আক্রান্ত ব্যক্তি রোগের কথা গোপন রাখে। ফলে সহজে রোগ ছড়ায়। এছাড়া দেশে এখন পর্যন্ত এসব রোগীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ কোনো হাসপাতাল হয়নি। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সুব্যবস্থাও রাখা হয়নি। এতে রোগীরা রোগ গোপন করে চিকিৎসা নিচ্ছে। অনেককে সাধারণ অসুখেও মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে।
এইডস রোগীদের একমাত্র ভরসা জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল: দেশে একমাত্র জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালেই এইডস রোগীরা ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে পারেন। বাংলাদেশের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এইডস শনাক্ত করার জন্য সারাদেশে ২৭টি কেন্দ্র রয়েছে। চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয় ১১টি কেন্দ্র থেকে। যা শুধু প্রাথমিক চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ডা. আরিফুল বাশার বলেন, দেশে একমাত্র সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে এইচআইভি রোগীগুলো জটিল পরিস্থিতি নিয়ে ভর্তি হতে পারে। এছাড়া আর কোনো হাসপাতাল নেই। এ হাসপাতালেরও রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। যেমন এইডস রোগীরা সাধারণত খুব সহজেই অন্য রোগে আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে যারা কিডনি, হৃদরোগসহ অন্যান্য জটিল রোগে ভুগছেন তাদের জন্য কার্ডিয়াক সেবাসহ অন্যান্য সেবা প্রয়োজন। তবে এ হাসপাতালে সেসব ব্যবস্থা নেই। ডা. আরিফুল বাশার বলেন, অন্যান্য দেশে সাধারণ রোগীদের সঙ্গেই এইডস রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মানুষের এইডস-ভীতি অনেক বেশি। তাই অন্যান্য হাসপাতালে এসব রোগীকে সাধারণ রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত হাসপাতালটিতে এক হাজার ৫৪২ জনের এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়। এদের মধ্যে এইডস শনাক্ত হয়েছে ১৫৪ জনের। অর্থাৎ নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত রোগী ৯.৯৮ শতাংশ। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের।
রোগী বাড়ছে কিন্তু পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নেই: সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ডা. বিকাশ কুমার সরকার বলেন, আমাদের এখানেই যে এইচআইভি পজিটিভ মাদার ভর্তি, তার সিজারের জন্যই কয়দিন পর অপারেশন থিয়েটার লাগতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে সে ব্যবস্থা নেই। এরা যখন অন্য হাসপাতালে যায় তখন দেখা যায় তারা রোগীটিকে নিতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরাও আগ্রহ দেখায় না। তাদের দেখতে চায় না। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে অনেকে আসে যাদের আইসিইউ প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের এখনো আইসিইউ চালু হয়নি। এইচআইভি পজিটিভ রোগীদের ব্রেনের ইনফেকশন ও যক্ষা খুবই কমন। কিন্তু তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা আমাদের নেই। সিটি স্ক্যান বা এমআরআই-এর ব্যবস্থাও নেই।
তরুণ সমকামী রোগীর সংখ্যা বেশি: জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসকের বক্তব্যে জানা যায়, তরুণ সমকামীদের মধ্যে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে দায়িত্বরত ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার (গাইনি অ্যান্ড অবস) ডা. হাসিবা মুনতাহা বলেন, যেসব বাচ্চা এইচআইভি পজিটিভ তারা জন্মগতভাবে এ রোগ পেয়েছে। আর তরুণদের মধ্যে একটি গ্রুপ সমকামী। এদের অনেকেরই ছোটবেলায় যৌন নির্যাতনের ইতিহাস থাকে। এরা যখন আমাদের কাছে আসে তখন তারা নিজেরাই হ্যাবিচুয়াল সমকামী। বাংলাদেশে ট্রানজেন্ডার ও সেক্স ওয়ার্কারদের নিয়ে যেভাবে কাজ হয়েছে সমকামী নিয়ে সেভাবে কাজ হয়নি। এ জায়গায় আমাদের এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে ডা. হাসিবা মুনতাহা বলেন, এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে পরিচিত হচ্ছে, পার্টনার খুঁজছে। এতে একেবারে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করছে। অনেকে সংক্রমিত হচ্ছে।