ড. মিল্টন বিশ্বাস
৫৩তম বিজয় দিবসে মানুষের মনে বয়ে চলা আনন্দময় সুবাতাসে আগুন সন্ত্রাসীদের উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে। সন্ত্রাসীরা ছদ্মবেশে স্মৃতিসৌধে উপস্থিত হবে হয়তো এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনাধারক সরকারপ্রধান জননেত্রীর বিরুদ্ধে স্লোগানও দেবে। কিন্তু তাদের অপতৎপরতা সম্পর্কে আমাদের সাবধান হওয়ার সময় এসেছে। বিজয় দিবসকে উৎসবমুখর করার জন্য আগুন সন্ত্রাসীদের স্বরূপ উন্মোচন করাও জরুরি। ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদন শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে আগুন দিয়ে সাধারণ নাগরিক হত্যার ঘটনা বর্বরোচিত ও মর্মান্তিক।’ আগের দিন সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট পরিদর্শনের অভিজ্ঞতাও সে সময় তুলে ধরেছিলেন পিয়েরে মায়াদন। ‘একজন মানুষ কীভাবে এই বর্বরোচিত কাজ করতে পারে’ প্রশ্ন রেখেছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে বিএনপি পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে। তাদের হাত থেকে শিশু এবং অসুস্থ নারীরাও রেহাই পায়নি সে দিনগুলোতে। ২০১৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বাংলাদেশের বিশ্বস্ত অর্থনৈতিক সহযোগী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন পিয়েরে মায়াদন। ভালো সম্পর্কের সেই অবস্থা এখনো বজায় আছে। কিন্তু তখন থেকেই বিএনপির যে অসুস্থ রাজনৈতিক ধারার সূচনা হয়, তা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ২০২৩ সালে এসে।
বিএনপি আন্দোলনের নামে ‘সন্ত্রাস করছে’। বিএনপি অবরোধের নামে নৃশংস হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসন্ত্রাসের ‘মহোৎসবে’ মেতে উঠেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি শুধু সন্ত্রাস চালিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি, তারা মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের মাধ্যমে তথ্য-সন্ত্রাস অব্যাহত রেখেছে। যার মধ্য দিয়ে তাদের চিরাচরিত মিথ্যাচার-অপপ্রচার ও গুজবের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে।’ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাস বিএনপির রাজনীতির মূল অস্ত্র। এখন তারা তথাকথিত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের আড়ালে পুনরায় সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। বিএনপির ‘বেপরোয়া সন্ত্রাসী বাহিনী’ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর ওপরও হামলা চালিয়েছে। তারা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর এবং অসংখ্য যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করেছে। তাদের নারকীয় হামলায় লালমনিরহাটে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম শাহাদাত বরণ করেছেন। তাদের অগ্নিসন্ত্রাসে একজন নিরীহ পরিবহন শ্রমিক নাইম অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। এছাড়া সারাদেশে আওয়ামী লীগের শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।
অবরোধকারীদের আগুনসন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। যাদের বেশির ভাগই নি¤œবিত্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাসে আগুন দিতে গিয়ে হাতেনাতে আটক হয়েছে বেশ কয়েকজন। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অগ্রযাত্রাকে পিছিয়ে দেয়ার জন্যই হরতাল-অবরোধের নামে ঘটানো হচ্ছে বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা। যেখানে আগুন সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে-পরে যারা সন্ত্রাস সংঘটনে ইন্ধন দিয়েছে, সক্রিয়ভাবে নাশকতায় জড়িত থেকেছে এবং সহিংসতাকে রাজনীতির অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত করেছিল, তারা এবং তাদের সমর্থকরা সেই সময়ের মতো বর্তমানেও একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করছে।
পুনরায় ফিরে দেখতে হবে অতীতের ইতিহাস। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সম্পন্ন হওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল সন্ত্রাসের মুখে অসাধারণ সংগ্রাম ও বিজয়। বিএনপি-জামায়াতের সহিংস মারমুখী অবস্থানের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার ঘটনা আমাদের দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। সন্ত্রাস ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষের সেই নির্বাচন দেশবাসীকে স্বস্তি দিয়েছিল। কিন্তু জামায়াত-বিএনপির অপতৎপরতা, হঠকারিতা থেমে থাকেনি।
সুস্থধারার রাজনীতি অবশ্যই হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত। থাকবে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস এবং আপামর জনসাধারণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে দলের নীতিনির্ধারণে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জনগণ ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর দৃঢ় আস্থা প্রদর্শন করেছে। আর বিএনপি-জামায়াতকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলেছে। কারণ বর্তমান প্রজন্মের কাছে শেখ হাসিনা এক আশ্চর্য সাহসী রাজনীতিকের নাম; যার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় ভবিষ্যতের বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া শেখ হাসিনাবিহীন যুদ্ধাপরাধের বিচার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এ জন্য তরুণ প্রজন্ম প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি-জামায়াতকে। আবার নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার বীভৎস চিত্র গণমানুষকে আতঙ্কিত করে তোলায় তারা আওয়ামী লীগের ধারাবাহিকতা প্রত্যাশা করে। এদিক থেকে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে। বিএনপির অবরোধের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ২০২৩-এর শেষও হবে নাশকতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সহিংসতা আর জ্বালাও-পোড়াও করে তারা থামাতে পারবে না নির্বাচন। বরং শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে তাদের বাঁচা-মরার আন্দোলনও দমে যাবে।
অন্যদিকে গত কয়েক বছর ধরে বিএনপি কয়েক দফা আন্দোলনের হুংকার দিয়েও মাঠ গরম করতে পারেনি। বরং জামায়াতের প্রধান মিত্র তারা হরহামেশাই বলতে বাধ্য হয়েছে, ‘জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নির্বাচনী রাজনীতি’র হলেও তা এখন কাজে লাগছে না।শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, কূটনীতিক দিক থেকেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে সব বিরূপ পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে এসেছেন। গত আমলে তার মন্ত্রিসভায় যুক্ত হন অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান রাজনীতিকরা। কিছু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও উন্নয়ন সহযোগী ও অংশীদার বানিয়ে ফেলেছেন রাশিয়া ও জাপানকে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধুত্বের বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়েছে। পূর্বমুখী কূটনীতির অংশ হিসেবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। নিজের সরকারের উন্নয়নের মডেল অন্যান্য দেশের কাছে উপস্থাপন করে প্রশংসিত হয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে জনগণ নেই। কারণ আন্দোলন করার মতো কোনো সংকট দেশে তৈরি হয়নি। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। তাই জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের ডাক দিয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। জনগণ তো দূরের কথা বিএনপির কর্মীরাই প্রস্তুত নয়; আর কর্মী তো দূরের কথা তাদের দলের নেতারা প্রস্তুত নন। আর আন্দোলন কখনো অঙ্ক কষে হয় না। যাদের নিয়ে কুচকাওয়াজ করে বিএনপি আন্দোলন করবে, সেই জামায়াত নির্বাচন করতে পারছে না। তাদের অবস্থা এখন নাজুক। এই জামায়াত-হেফাজতরা বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করেছে। অতীতে নির্বাচনের আগে-পরে সারাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ, হামলা, নির্যাতনের ঘটনাকে হেফাজতে ইসলাম আন্তর্জাতিক চক্রের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে দাবি করেছিল।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে বিএনপি যে রাজনীতি করছে এবং অবরোধ, হরতাল ও নাশকতাকে বেছে নিয়েছে, তা আজ বিদেশিদের কাছে তুলে ধরা দরকার। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীদের মানবাধিকারের বয়ান দিয়ে রক্ষা করা যাবে না। বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা হিরো আলমের ওপর হামলা হলে উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠেন কিন্তু পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে বিএনপি যখন পিটিয়ে হত্যা করে তখন নিশ্চুপ থাকেন। এ জন্য তাদের মানবাধিকারের বয়ান বা ভাষ্য নিরপেক্ষ নয়।
মনে রাখতে হবে, একসময় গাড়ি-বাড়িতে আগুন, পেট্রোল বোমা, পুলিশকে মারধর ও হত্যা করা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত করেছিল বিএনপি-জামায়াত। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে হত্যা ও পঙ্গু করা হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে। সহিংসতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করে ফায়দা লুটতে চেয়েছে বিএনপি-জামায়াত। টানা হরতাল-অবরোধে শিক্ষা, ব্যবসা আর বিদেশে দেশের ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতিসাধিত হয়েছে।
গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হয়েছে তাতে কোনো ভুল বা অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে না। এমনকি বিভিন্ন ফোরামে উপস্থাপিত তথ্যাদি বা সরকারের উন্নয়ন না হওয়ার ব্যাপারে কোনো কথা বলেছেন না কেউ। এজন্য সরকারের উন্নয়নের ব্যাপারে কোনো চ্যালেঞ্জ না করে নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার জন্য উদ্ভট আর মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। শেষ পর্যন্ত তারা সরকারের উন্নয়নকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর সব দিক দিয়ে তাদের পরাজয় ঘটেছে বলেই দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিএনপি এটা স্বীকার না করলে সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চা কখনো সম্ভব নয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন করা দলটির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত। বিএনপি নামক দলটির আগুন সন্ত্রাসীদের অন্তর্ধান ঘটুক এবং ৫৩তম বিজয় দিবস মহিমান্বিত হয়ে উঠুক- এই প্রত্যাশা সবার।
ড. মিল্টন বিশ্বাস: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।