পশ্চিমা পর্যবেক্ষকেরা বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে লিপ সার্ভিস দিলেও তারা নিজ দেশের সমালোচনা করেন না। উপরন্তু বাংলাদেশের আগুন সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে উগ্র জঙ্গীবাদীদের আস্কারা দিয়ে নিজেদের পক্ষভূক্ত প্রমাণ করেছে। অন্য দেশগুলোতে আক্রমণ করার বিশেষ অস্ত্র হিসেবে তারা মানবাধিকার ইস্যুকে ব্যবহার করে আসছে। বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে সম্প্রীতি বাংলাদেশ কর্তৃক রোববার অনুষ্ঠিত সভায় বক্তারা এসব বলেন।
সম্প্রদায়গত সংঘাত, বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার ব্যাপারে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখেনি বলে মন্তব্য করেন বক্তারা। সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহবায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। যাতে বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও ৪৮ টি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সংহতি জানিয়ে নিজেদের অভিমত তুলে ধরে।
সম্প্রীতির কার্যনির্বাহী সদস্য সাইফ আহমেদের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ২৫ মার্চ বাঙালি জাতি নির্বিচারে গণহত্যা দেখেছে। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের ওপর হামলা-হত্যা, অপহরণ ও গুম দেখেছে। উগ্রবাদের জন্ম দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিদের হেনস্থা করা হলেও তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠকেরা নিশ্চুপ থেকেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিপদগ্রস্ত করতে নাশকতার পথ বেছে নিয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী গোষ্ঠীগুলো। গুদামে আগুন, কলকারখানা পুড়িয়ে দেয়া, পাট ও তুলাভর্তি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছির চিহ্নিত গোষ্ঠী। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধুবিরোধী মিথ্যা গুজব রটিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ তৈরী করে দিয়েছিল।
সমাবেশের প্রধান অতিথি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে মানবাধিকার রক্ষার উদ্ধারকর্তা দাবি করে সেই যুক্তরাষ্ট্রেই আর্থিক দুর্নীতি, বর্ণবৈষম্য, অস্ত্র এবং পুলিশি সহিংসতার শিকার হন মানুষ। সম্পদ কুক্ষিগত করার ঘটনাও সেখানে অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিত্যকার বন্দুক সহিংতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরও বলেন, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেকের বেশি স্টেটে শৈথিল্য অবলম্বন করা হয়। বন্দুকের মালিকানা, অস্ত্রবাজি ও হত্যাকাণ্ডের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে অবস্থান করছে। ২০২২ সালে এসব ঘটনায় ৮০ হাজারের মতো মানুষ নিহত হয়েছেন। এমনকি চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০টির বেশি ম্যাস শুটিং হয়েছে। অস্ত্রবাজি দেশটিতে মহামারি আকার ধারণ করলেও তারাই বারংবার বাংলাদেশকে ছবক দিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রীতির আহ্বায়ক নাট্যজন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চিত্র তুলে ধরে অনুযোগের সুরে বলেন, একাত্তরে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে মানবাধিকার লংঘন করা হয়েছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আজ তাদেরই প্রেতাত্মা গাড়ি-বাস পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে মানবাধিকার লংঘন করছে। এদের মদদ দিচ্ছে বিদেশের বিশেষ গোষ্ঠী। এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলসহ সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, সম্প্রীতি বাংলাদেশের যুগ্ম আহবায়ক ডা. উত্তম বড়ুয়া, খ্রিষ্টীয় ঈষতত্বের শিক্ষক মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চের প্রধান পুরোহিত রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী, চারুশিল্পী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী, বন্ধবন্ধু গবেষক আফিজুর রহমান, গৌরব ৭১ এর সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীন, ব্রিগেড ৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচ্চু জালাল।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, ৮৬ শতাংশ আমেরিকান ভোটার মনে করেন মার্কিন গণতন্ত্র মারাত্মক হুমকিতে। তাদের নিজেস্ব স্টাইলের গণতন্ত্রের প্রতি সাধারণ জনগণের মোহভঙ্গ হয়েছে। তাদের গণতন্ত্র পতনের ঝুঁকিতে থাকলেও বাংলাদেশ নিয়ে সারাক্ষণ তাদের বিষোদগার বিশ্বনেতারা ভালোভাবে নিচ্ছেন না।
অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, বিশ্বমানবতা আজ বিপন্ন। যারা মানবাধিকার লংঘন করে নিরীহ মানুষ হত্যা করছে, তারাই আবার মানবাধিকারের জ্ঞান দিচ্ছে।
ঢাবির সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দারের অভিমত, আমেরিকান ধাঁচের গণতন্ত্র দিনে দিনে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্রমবর্ধমান ব্যয় ১৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছিল। ঐ সময় বিলিয়নিয়ারদের কাছ থেকে অনুদান নেওয়াটা বেড়েছিল। মধ্যবর্তী নির্বাচনের মোট ব্যয়ের ১৫ শতাংশ যেভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিল তা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। ২০২০সালে তাদের নির্বাচনে প্রশ্নবিদ্ধ অর্থের পরিমাণ ছিল ১১ শতাংশ। এই ‘ডার্ক মানি’ অনুদান মার্কিন নির্বাচনকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। সুতরাং তারা নানা অপকৌশল অবলম্বন করে বাংলাদেশের নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। এমনকি তারা ঘুরিয়েপেঁচিয়ে সবসময় মানবাধিকারকেই ইস্যু বানিয়ে থাকে।
সম্প্রীতি বাংলাদেশের যুগ্ম আহবায়ক ডা. উত্তম বড়ুয়া বলেন, ৬৯ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বাড়ছে এবং জাতিগত সংখ্যালঘুরা সেখানে চরমভাবে বৈষম্যের শিকার। বাফেলো সুপারমার্কেটে ১০ জন আফ্রিকান-আমেরিকানের বর্ণবাদী গণহত্যা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল। দেশটির ৮১ শতাংশ এশিয়ান আমেরিকান মনে করেন, এশিয়ার মানুষদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় পুলিশের হাতে আফ্রিকান আমেরিকানের নিহত হওয়ার আশঙ্কা ২ দশমিক ৭৮ গুণ বেশি। ভারতীয় এবং অন্যান্য আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের গৃহীত গণহত্যা এবং সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের ফলে সৃষ্ট ভোগান্তি এখনো অব্যাহত। বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচ্চু জালাল বলেন, মার্কিন শক্তির অপব্যবহার এবং একতরফা নিষেধাজ্ঞা বিশ্বে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ২১ শতকের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস বিরোধিতার নামে ৮৫টি দেশে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। কমপক্ষে ৯ লাখ ২৯ হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৩৮ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চের প্রধান পুরোহিত রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী বলেন, নারীদের গর্ভপাত ইস্যু ও শিশুদের বসবাসের পরিবেশ সেখানে বেশ উদ্বেগজনক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে ১৮ বছরের কম বয়সি ৫৮০০টিরও বেশি শিশুকে গুলি করে আহত বা হত্যা করা হয়েছে এবং স্কুলে গুলি চালানোর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০২টিতে। এ সংখ্যা ছিল ১৯৭০ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ।
সর্বোপরি নির্বাচনের আগে সবাইকে সচেতন ও সজাগ থাকার আহ্বান জানানো হয় সম্প্রীতি বাংলাদেশের এ সমাবেশে থেকে। নানান ধরণের গুজব ও আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় জানান নেতারা।