আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেবিলে ঢাকা-১৮ (উত্তরা) আসনের সংসদ সদস্য মো. হাবিব হাসানের বিরুদ্ধে অপকর্মের ফিরিস্তির ফাইল জমা হয়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে বলেও দলের হাইকামন্ডের একাধিক নিশ্চিত করেছে। এমপি হাবিব হাসানের বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, হত্যা মামলার হুকুমের আসামি, অবৈধ সম্পদ অর্জন, শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে জালিয়াতি, সন্তানের নামে কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি, পিতার স্বাধীনতা বিরোধী অবস্থান ও পরিবারের লোকজনের বিরোধী দলের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা, নিজ দলের নেতাকর্মীদের নামে মামলা-হামলাসহ নানা অভিযোগ নিয়ে ভোরের পাতার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাবিব হাসান ২০১৫ সালের কাউন্সিলর নির্বাচনের সময় হলফনামায় নিজেকে ৯ম শ্রেণি পাশ উল্লেখ করলেও পরে ২০২০ সালের এমপি উপ নির্বাচনের সময় নিজেকে এসএসসি পাশ ঘোষণা করেন। অথচ তিনি এসএসসি পাশের যে সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন, সেটি ১৯৮১ সালের।
দুদকের অভিযোগ সূত্র বলছে, হাবিব হাসান ২০২০ সালে এমপি নির্বাচনের সময় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তিতে উল্লেখ করেছেন, অকৃষি নাল জমি আছে ১৫০ শতাংশ। যা তিন বিঘারও কম। কিন্তু তুরাগ থানার বাউনিয়া এলাকায় বিমানের রানওয়ের পাশ থেকে শুরু করে উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত প্রায় ১১০ বিঘা সম্পত্তিতে নিজের নামে হাবিব সিটি ও বাবার নামে লতিফ সিটি ঘোষণা করেছেন।
উল্লেখ্য, এই বিস্তীর্ণ এলাকা ঘিরে উঁচু ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ১৭ নম্বর সেক্টরের পাশের অংশে গেইটের উপর লতিফ সিটি নামক সাইনবোর্ড টাঙ্গানো রয়েছে। এই সিটির দেয়ালের ভেতরে এক একর জমি আটকে রাখার অভিযোগ করেছেন সেলিনা রহমান ও তার ছেলে সৌরভ রহমান।
ভুক্তভোগীরা এমপির আপন ভাই নাদিম মাহমুদের বিরুদ্ধে সিনিয়র সহকারী জজ ২য় আদালতে মমলা করেছেন। ভুক্তভোগীদের পক্ষে কথা বলেছেন তাদের আইনজীবী সুশান্ত কুমার। তিনি বলেন, এমপির ভাই নাদিম মাহমুদ এমপির ক্ষমতায় তাদের জমি দখলের পায়তারা করছিলেন। তখন তারা আদালতে মামলা করেন। আদালতে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দেন। কিন্তু এমপির ভাই আদালতের সেই আদেশ অমান্য করে জমি দখল করে নেয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগও করা হয়েছে বলে জানান সুশান্ত কুমার।
হরিরামপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। আতাউর রহমান বলেন, নিজের চিকিৎসা করাতে সিদ্ধান্ত নেন জমি বিক্রির। আর তখনই লালশার শিকার হন এমপির। আতাউর অভিযোগ করেন, এমপি তাকে অফিসে নিয়ে আটকে রেখে তিন কোটি টাকার জমি এক কোটি টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রি করে নেন। এমপির নির্বাচনে টাকা খরচ হয়েছে, তাই সেই টাকা উঠাতে তিনি এমন করছেন বলেও অভিযোগ করেন আতাউর রহমান। এমপির বিরুদ্ধে জমি দখলের এমন আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে।
সংসদ সদস্য হাবিব হাসান শুধু দখলদারিত্বেই থেমে থাকেননি। অভিযোগ রয়েছে, স্বার্থ হাসিলে নিজ দলের নেতাকর্মীদের মামলা-হামলায় জড়ানোর। প্রয়াত এমপি সাহারা খাতুনের অনুসারীরা হাবিব হাসানের বিরাগভাজন হয়েছেন। একই দলের হওয়া সত্ত্বেও ভিন্ন নেতার অনুসারী হওয়ায় দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ ইতোমধ্যে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে।
তুরাগ থানা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, তিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই হাবিব হাসানের সঙ্গে থেকে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু বাউনিয়া এলাকায় জমি দখল ও চাঁদাবাজির জন্য এমপির লোকজনের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান সোহেল। আর সেই অপরাধেই এমপি তাকে দুরে ঠেলে দিতে শুরু করেন।
সোহেল অভিযোগ করেন, এক পর্যায়ে এলাকার তুচ্ছ ঘটনাকাকে কেন্দ্র করেও সোহেলকে আসামি করে মামলা নিতে থানাকে বল প্রয়োগ করেন এমপি হাবিব হাসান। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আজকে আওয়ামী লীগ করেও আামার বিরুদ্ধে মামলা করায় আওয়ামী লীগেরই এমপি। তারও আবার ৮৫ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক বাবাকেও মারামারির মামলায় আসামি করা হয়।
উত্তরা ৩নং সেক্টরের ২৭ নং প্লটে লতিফ এম্পোরিয়াম মার্কেটেও দুটি দোকান দখলের অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী নিলুফা ইয়াসমিন নিলু। তিনি জানান, হাবিব হাসান আমাকে আকাশ থেকে পাতালে ফেলে দিয়েছেন। আমার সন্তানদের এতিম করেছেন। আমি এবং আমার স্বামী প্রবাসে চাকরি করে টাকা জমিয়ে মার্কেটের ৪ ও ৯ নাম্বার দোকান ক্রয় করি। এই হাবিব হাসান হঠাৎ করেই ৩০ লাখ টাকার মালামালসহ আমাদের দোকান দখল করে নেয়। এই শোকে আমার স্বামী স্ট্রোক করে মারা যান। আমি এতিম সন্তানদের নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। আমি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে হাবিব হাসানের বিচার চাই।
সূত্র জানায়, হাবিব হাসানের বাবা ১৯৭১ সালে লতিফ পাক হানাদার বাহিনীর ছায়াদানকারী সংগঠন শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। জিয়ার আমলে গ্রাম সরকারের দায়িত্বও পালন করেন তার বাবা। এছাড়া হাবিবের ছোট ভাই মরহুম মো. কফিল ঢাকা উত্তর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তাদের আপন চাচাত ভাই কুদরত এ এলাহি লিটন দীর্ঘদিন ধরে উত্তরা থানা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও হাবিবের চার নম্বর ভাই রিয়াজ ১/১১ এর আগের দিন বিএনপির সাবেক মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূইয়ার হাতে ফুলের তোরা দিয়ে বিএনপিতে যোগদান করেন। যা ওই দিন দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।
শুধু তাই নয়, হাবিবের একটি লাঠিয়াল বাহিনী ছিল। ওই বাহিনী ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট হাবিবের নির্দেশে জমি দখল করতে গিয়ে হরিরামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক সালাউদ্দিনকে খুন করে। পরবর্তীতে এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলার হুকুমের আসামি ছিলেন হাবিব হাসান। পরবর্তীতে ৫০ লাখ টাকার বিনিময় ও সরদার সুরুজ্জামান ও অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের সহায়তায় তার সহযোগীদের ফাঁসিয়ে নিজের নাম মামলা থেকে বাদ দেয়ার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে ওই মামলার আসাসিদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেন আদালত।
এদিকে, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের গত কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন এমপি হাবিব হাসানের ছেলে আবির হাসান তানিম। উচ্চ শিক্ষা নিতে গিয়েছিলেন কানাডায়। ট্রিনিটি ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন ২০১৮ সালে। তানিম কানাডায় পড়াশোনা করলেও দেশের রাজনীতিতে সক্রিয়।
অনুসন্ধান বলছে, ২০২০ সালে কীনস্কট রোডের ১৭ নাম্বার বাড়িটি কেনেন আবির হাসান তানিম। কাগজ কলমে বাড়িটির মালিকানায় আবির হাসান তানিমের নামের সঙ্গে তার স্ত্রী শার্মিলা সিজানার নামও রয়েছে। বাড়িটি কেনা হয় ১৫ লাখ ৫০ হাজার কানাডিয়ান ডলারে। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি।
টরন্টোর কীনস্কট রোডের বাড়ির বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন কানাডায় প্রবাসী সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল ইমরান। তিনি জানান, বাড়িটি আবির হাসান তানিম ও শার্মিলা সিজানার নামে কেনা হয়েছে। তিনি আরও জানান, বাড়িটির দাম পনের লাখ পঞ্চান্ন হাজার কানাডিয়ান ডলার। যা বর্তমানে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা। বাড়িটির রেজিস্ট্রেশন ও অন্যান্য ফি-সহ প্রায় ১৫ কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথাও জানিয়েছেন ইমরান। ইমরান আরও জানান, বাড়িটি বর্তমানে একটি আফগানী পরিবারের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে এমপি হাবিব হাসানের মুঠোফোনে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। এমনকি বিষয়বস্তু উল্লেখ করে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি সেটির প্রতিউত্তর করেননি।
(চলবে..)