প্রয়োজনীয় জনবল ও চিকিৎসক সংকটে কাঙ্খিত সেবা থেকে বি ত হচ্ছে ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতালের রোগীরা। নেই আইসিইউ, ডায়ালাইসিস ইউনিট, প্রবীণ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী জন্যও নেই আলাদা লাইনের কোন ব্যবস্থা। ফলে টিকেট কেটে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেক বৃদ্ধ ও শারীরিক প্রতিবন্ধীরা। রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালটিতে রয়েছে শয্যা সংকট, পাশাপাশি মিলছে না পর্যাপ্ত ঔষধ, অপরিচ্ছন্ন থাকছে মেঝেসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের শৌচাগার।
হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের পাশে ৩ দশমিক ৪৯ একর জমির ওপর ৫০ শয্যা হাসপাতালটির যাত্রা শুরু হয়। পরে তা উন্নীত হয় ১শ শয্যার হাসপাতালে। ২০২০ সালে এটিকে বাড়িয়ে ২৫০ শযর্্যায় উন্নীতি করে ৭ তলা ভবনের নির্মাণকাজ শেষে তা বুঝিয়ে দেওয়া হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু জনবল নিয়োগ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ না করায় এখন পর্যন্ত চালু হয়নি হাসপাতালটির কিডনী রোগীদের ডায়ালাইসিস ইউনিট ও সংকটাপন্ন রোগীদের আইসিইউ ইউনিট।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে ৮শ ১২শ রোগী বহির্বিভাগে সেবা নিয়ে থাকেন। প্রতিদিন গড়ে ভর্তি থাকেন ৫শ থেকে সাড়ে ৫শ রোগী। জনবল সংকটের কারণে এ বিপুল সংখ্যক রোগীর সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক-নার্সরা। ২৫০ শর্য্যার জনবল কাঠামো অনুযায়ী হাসপাতালে ৫৯ জন চিকিৎসক থাকার কথা। কিন্তু এখানে মাত্র ৩০ জন কর্মরত আছেন। হাসপাতালটিতে গুরুপ্তপূর্ণ চারটি এনেসথেসিস্ট পদই শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া সিনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি) ও সিনিয়র কনসালট্যান (চর্ম ও যৌন) পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া সহকারী পরিচালক, জুনিয়র কনসালট্যান্ট ও ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারসহ ২৯টি পদই শূন্য রয়েছে। এ ছাড়াও তৃতীয় শ্রেণীর ৬৫টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছে ২২জন ৪৪টি শূন্য, চতুুর্থ শ্রেণীর ২৫জনের বিপরীতে কর্মরত ১৭ জন, ৮টি পদই শূণ্য।
প্রায় দিনই দেখা যায় হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসকদের চেম্বারের সামনে রোগীদের দীর্ঘ সারি। রোগীদের চাপে পা ফেলার জায়গাটিও থাকছে না কোথাও। হাসপাতালের দুটি টিকিট কাউন্টার থেকে শুরু করে বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগসহ সব জায়গায় রোগী ও তাঁদের স্বজনদের ভিড়।
বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা সদর উপজেলার হরিহরপুর গ্রামের বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন বলেন, দুই ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়েছেন। এই ওষুধগুলো নাকি বাইরে থেকে কিনতে হবে। তাহলে সরকারি হাসপাতালে এসে লাভ কি?
চিকিৎসা নিতে আসা ৬৫ বছরের বৃদ্ধা আশরাফি বেওয়া দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে একপর্যায়ে বসে পড়েন হাসপাতালের মেঝেতে। তিনি বলেন, সকাল ৯টায় টিকেট কেটে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এখনও ডাক্তার দেখাতে পারিনি। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকায় পা ফুলে গেছে। তাই মেঝেতে বসে পড়েছি। আমার মত ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে অনেকে মেঝেতে বসে থাকছে। বৃদ্ধদের জন্য পৃথক লাইন করার দাবি জানান তিনি।
লাইনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা নিতে আসা শারমিন হাসান নামে শারীরিক প্রতিবন্ধী এক নারী বলেন, জন্ম থেকে পা-জোড়া চিকন ও বাঁকা। ২ঘন্টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। খুব কষ্ট হচ্ছে। কখন যে ডাক্তার দেখাবো তা জানি না। গরীব মানুষ হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই।পাশে লায়লা বেগম নামে আরেকজন বলেন,বাপু আর দাঁড়ায় থাকিবা পারিনা। কোমড়ে ব্যাথা,হাঁটুর ব্যাথা। এ বলে কেঁদে ফেলেন তিনি।
অসুস্থ্য মাকে নিয়ে এসেছেন শাহপাড়া মহল্লার বাসিন্দা মো: বাবু তিনি বলেন, মায়ের শ্বাস কষ্টসহ বিভিন্ন রোগ। দেড় ঘন্টা লাইনে আছি ডাক্তার দেখাতে পারিনি। মাকে অন্য জায়গায় বসতে দিয়ে আমি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছি। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখানে কোন সিস্টেম ভাল নাই। অসুস্থ্য ও বৃদ্ধদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা নাই। কোন ডাক্তার কখন,কোন সময় বসবে থাকবে এরকম কোন চার্টারও নাই। রোগীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে।
সুগা মুরমু নামে আরেক প্রবীন ব্যক্তি বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে তিনটি বড় ধাপ পার হতে হয়। প্রথমে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে টিকেট নেন। এরপর আবার মেডিকেল অফিসারকে দেখাতে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হল, তিনি যখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার্ড করেন সেখানেও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার দেখাতে সক্ষম হন।
হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে শুয়ে থাকা আশরাফুল ইসলাম নামে এক রোগী বলেন, তিন দিন ধরে মেঝেতে শুয়েই কাটিয়ে দিয়েছি। বেডের (শয্যা) জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। এখন আশা ছেড়ে দিয়েছি। এ ছাড়া বেশির ভাগ ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. রকিবুল আলম চয়ন বলেন, ২৫০ শয্যার হাসপাতালটির জন্য ২৫০ শয্যা ওষুধ, খাবার ও বেড বরাদ্দ থাকে। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি থাকছে ৫শ'র উপরে। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন ৮শ ১২শ এ বিপুল সংখ্যক রোগীদের খাবার ও ওষুধ সঙ্কট তো থাকবেই।
২৫০শয্যা জেনারেল হাসপাতাটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. ফিরোজ জামান জুয়েল জনবল স্বল্পতার কথা স্বীকার করে বলেন, ২৫০ শয্যার জনবলের চাহিদা চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দেওয়া হয়েছে। স্বল্প জনবল দিয়ে অধিক মানুষকে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চিকিৎসা নিতে আসা প্রবীন ও প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে বিশেষ পরিকল্পনা নেয়া হবে।