অখন্ড ভারত তথা ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর ভারত ভাবনার ধারকেরা হয়তো আজও কটাক্ষ করে। একটা সময় তাঁরা মুসলিম অধ্যুষিত জনগোষ্ঠিকে দায় দিয়ে বলত যে, উপমহাদেশের ঐক্য নষ্ট করার জন্য মুসলিম লীগ দায়ী। আজ তাঁরা বলতে পারছে, তোমরা পাকিস্তানের নামের যে রাষ্ট্র গঠন করে পূর্ব ও পশ্চিম নামকরণে পৃথক হয়েছিলে, তা যদি উত্তম বন্দোবস্ত হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসাবে গণ্য হয়------তাহলে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে কেন বিরাজনীতিকরণের সংস্কৃতি ছুঁয়ে যেয়ে প্রায়শই সামরিক নেতৃত্বের শাসনে কথিত গণতন্ত্রের অনুশীলন পরখ করার মাধ্যমে তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে হয় ? আমাদের ভারতে তো তা হচ্ছে না ? কেন তোমাদের দেশগুলোয় জিয়াউর রহমান, জিয়াউল হক, হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ কিংবা পারভেজ মোশাররফেরা অভিনব কায়দায় দেশের শাসনভার গ্রহণ করে নীতি কথার রাজনীতি শুরু করতে উদ্যত হয় ? তাঁরা নিজেরাইতো অনৈতিক পন্থায় কথিত রাজনীতিক বনে গিয়ে নিকৃষ্ট শাসক হওয়ার অভিলাষে সিক্ত হয়েছিল। এমন অনভিপ্রেত কৃষ্টির মাশুলে বাংলাদেশ তাঁর জাতির জনককে হারালো----- জাতির শ্রেষ্ঠ চার রাজনীতিক বর্গকে কি তোমরা হারাওনি ?----- ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কথায় মন তো খারাপ হয়-ই।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ? আজ অব্দি একাত্তরের পরাজিত শক্তির একের পর এক কু-উদ্যোগে হোচট খেয়ে যাচ্ছে। সেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, একই বছরের ৩ নভেম্বর, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট-------আমার একটা প্রশ্ন এই দেশের মানুষের কাছে। তা হল, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা রাজনৈতিক দল ও আমাদের নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য যে অপশক্তি আজ অব্দি রাজনীতির ময়দানে থেকে গণতন্ত্রমনা দলের নামে সন্ত্রাস শক্তি, তাঁদেরকে জবাব দিতে ইচ্ছে করে না ? আওয়ামী লীগ তো সত্যিকারের রাজনৈতিক দল, আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিলে, রাজনৈতিক সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়-----কেন সাধারণ মানুষ স্বাধীনতাবিরুদ্ধ শক্তিকে, লন্ডনভিত্তিক ডন তারেক রহমানদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করার উদ্যোগে যেতে পারেন না ? ওরা আমাদেরকে মারুক। আমরা নিজেরা আইন হাতে তুলে নিতে পারিনা। আইনের শাসনে আস্থা রেখেই বঙ্গবন্ধু তনয়া যুদ্ধাপরাদ্ধীদের বিচার করতে পেরেছেন, পারছেন। আমরা দেশের বৃহত্তম দল তথা জনপ্রিয় দল হয়ে কী নিজস্ব কর্মীদ্বারা ওদের মত গ্রেনেড হামলা করতে পারি ? আসলে, পারি না। শত্রুপক্ষ যত মন্দই হোক, আমরা তা করতে পারি না। আমরা তা শিখি নাই। শুধু কাঁদতে শিখেছি। নীরবে চোখের জল ফেলেছি। কত রাত আমার বাবা এ এইচ এম কামারুজ্জামানের জন্য কান্না করেছি, তেমন ধারাভাষ্য দিতে ইচ্ছে করে না, তবে তা চিরন্তন বাস্তবতা। আমি আমার বাবাকে ধারণ করি, স্মরণ করি এবং তাঁকে আদর্শ মনে করেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর আছি। যেখানে, আমাদের মাথার ওপরে একটি ছায়া আছে। নাম, শেখ হাসিনা !
শোকাবহ জেল হত্যা দিবস, যখনই সামনে আসে, মনে হয় কত কথা লিখি, বলি ! ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ওরা হত্যা করল। এরপর দ্বিতীয় কলঙ্কজনক অধ্যায়ের ধারাবাহিকতায় আঁধারময় ৩ নভেম্বরের দিনটিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে চার জাতীয় নেতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। । স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ১৫ আগস্ট ভোরে। ঠিক এর আড়াই মাস পর, ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবন্দী জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে ওরা। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় বর্বরোচিত এ ধরনের হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।
১৯৭৫ সালে ৩রা নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের সময় আমি ও আমার ছোট ভাই ভারতের কোলকাতায় একটি মিশনারী স্কুলে পড়তাম। মায়ের কাছে শুনেছি যে, হত্যাকাণ্ডের দিনটিতে নানা গুজব শুনলেও মা তা বিশ্বাস করেননি। পরদিন ৪ নভেম্বর বিকেলে তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন টেলিফোন করে আমার মায়ের সাথে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন যে, জেলখানায় কিছু একটা হয়েছে ! তখন আমার মা আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এরপর ৪ নভেম্বরেও বাসা থেকে অপর জাতীয় নেতা মনসুর আলীর জন্য পাঠানো খাবার, ফেরত আসে। তখন আমাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার সন্দেহ ও শঙ্কা আরও বেড়ে যায়।এদিকে বাবার মৃতদেহ রাজশাহীতে দাফন করার ব্যাপারে প্রথমে অনুমতি দেয়া হচ্ছিল না। তবে পরে তাঁর মায়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহীতে হেলিকপ্টারে করে বাবার মৃতদেহ পাঠানো হয় ৫ নভেস্বর।
স্বাধীনতা আন্দোলনের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুজিবনগর সরকার গঠন, রণনীতি ও রণকৌশল প্রণয়ন, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও দেশবাসীর সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য জাতি এই চার নেতাকে চিরদিন স্মরণ রাখবে বলে প্রচলিত আছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল একই আদলের ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। সূত্রমতে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে ষড়যন্ত্রকারীরা জাতীয় চার নেতাকে তাদের সরকারে যোগদানের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এই জাতীয় চার নেতা সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এরপরই তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ হয় যে, সে সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিনুর রহমান। রাত দেড়টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে জেলার মি. রহমানকে তাৎক্ষনিকভাবে আসতে বলেন। দ্রুত কারাগারের মূল ফটকে গিয়ে মি. রহমান দেখলেন, একটি পিকআপে কয়েকজন সেনা সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় আছে। জানামতে, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং অন্যদিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফের দুই গ্রুপের সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলার জেরে ছিল ফলত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। তাঁদের অনৈতিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের অভিলাষের উদ্রেকে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব শূন্য করার মিশনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। এমন মানবতাবিরোধী হত্যাকান্ড পরিচালনা করেও এই জিয়াউর রহমানেরা রাজনৈতিক দল গঠন করে ক্ষমতায় গিয়েছে, তা কেহ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করতে পারলে, ধিক জানানো ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
৩ নভেম্বর পিছিয়েও দেয়, আবার এগোতেও আহবান করে। কারণ, বাবাকে হারিয়ে আমার সত্তা শোকে বিহবলে কাতর হয়। আবার অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করতে পারার অতি আগ্রহে নিজেকে সঁপে দিতে পারি বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কাছেও। এখানেই রাজনৈতিক সত্তার বিজয়। সেখানে তখন শোক সত্যিকার অর্থেই শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সন্দেহ নেই, জেল হত্যা দিবস; আমাকে কাঁদায়। নেতৃত্ব শূন্য করার অপউদ্যোগেই চার নেতাকে জেলেই হত্যা করা হয়। এও সম্ভব ! বঙ্গবন্ধু থেকে জাতীয় চার নেতা; কাউকে বাঁচতে দেয়নি ওরা। কারণ, তাঁরা ভারতীয় বিদগ্ধশ্রনির ছোঁড়া অভিযোগের অর্থবহ পর্যায়ের আসামী বা অপরাধী। ওরা বাংলার মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে থাকা বকধার্মিক। ওরা সত্যিকার অর্থে ইসলাম ধর্মকেও লালন করতে পারেনি।
বাংলাদেশের দার্শনিক ঈশ্বরমিত্রের একটা মতবাদ উল্লেখ করেই শেষ করি। "হত্যা করা ফলত অপরাধীদের অপরাধ নয়, আইন মেনে চলা নাগরিকরুপে রাজনীতিকদের বা ক্ষমতাধরদের অপরাধ, যা আদেশক্রমে নির্দেশিত ফলাফলের পরিণতি ।" সঙ্গত কারণে, যারা হত্যা করে শাসকশ্রেণির আওতাভুক্ত হয়ে দুই দিনের রাজনৈতিক সংসার করতে উদ্যোগী হয়, প্রকৃতি বিচার করে দেয়। হিসাব মিলিয়ে নিন প্রিয় দেশবাসী। জিয়াউর রহমানদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি এবং তাঁর পরিবারও সুখে নেই। এখানেই প্রকৃতির বিচার নিষ্পত্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে এই পৃথিবী এগিয়ে যায়। সন্তান হিসাবে বঙ্গবন্ধু, তিন জাতীয় নেতা ও আমার বাবার জন্য এতিম হয়ে একাকিত্বে কাঁদি, পরক্ষণেই আবার শপথ নিয়ে হারিয়েও যাই জনশ্রেণির সুখ খুঁজতে মিছিলে, জনাকীর্ণ সমাবেশে...
লেখকঃ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।