প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় শুধুমাত্র জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে। এছাড়া অন্যান্য সব জায়গাতে আমাদের ঘুষ দিয়ে কাজ করতে হয়। ঘুষ দেয়া ছাড়া কোনো অফিসের ফাইল নড়ে না। আজকে থেকে ঘুষ নেয়া বন্ধ করে দেন, আমরা কালকেই শ্রমিকদের বেতন বাড়িয়ে দেবো বলে মন্তব্য করেছেন গার্মেন্টস মালিক আব্দুল্লাহ আল-জহির স্বপন।
ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধির দাবিতে পোশাকশিল্পে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বুধবার রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে আয়োজিত এক জরুরি আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন আব্দুল্লাহ আল জহির স্বপন। বিজিএমইএর প্রায় ২০০ সদস্য সভায় উপস্থিত ছিলেন।
জিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসানের উপস্থিতিতে এ বক্তব্য দেওয়ার সময় আরও উপস্থিত ছিলেন—বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ও আব্দুস সালাম মুর্শেদী, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি হা–মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একে আজাদ ও বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এসএম মান্নান কচিসহ সাবেক ও বর্তমান নেতারা।
আব্দুল্লাহ আল জহির বলেন, ‘কাস্টমসসহ সরকারি যত সংস্থা আছে প্রত্যেক জায়গায় ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ ছাড়া ফাইল চলে...কোনো ফাইল চলে না। কথা বললে এই ভাবে বলতে হবে। লুকোচুরি করে বললে হবে না।’
এ সময় উপস্থিত বিজিএমইএর সদস্যরা করতালি দিয়ে তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন জানান। আব্দুল্লাহ আল জহির বলেন, ‘আমাদের যদি এয়ারফ্রেইট (বিমানে পণ্য পাঠানো) করতে হয়, তাহলে কাস্টমস হবে এই জায়গায় (বিজিএমইএ ভবনে), আমাদের বিজিএমইএ ভবনে ওদেরকে (কাস্টমসকে) নিয়ে আসতে হবে। এই জায়গায় আমরা একটা তাদের জন্য অফিস করে দেব। এই জায়গায় কাস্টমসের সবকিছু হবে। যা হওয়ার সবকিছু এখানে হবে...এদের কাছে কেন আমরা নাকে খত দিতে যাব?’
অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শাখা বিজিএমইএতে আনার দাবি জানিয়ে আব্দুল্লাহ আল জহির বলেন, ‘সবাইকে এইখানে (বিজিএমইএ ভবনে) নিয়ে আসেন। এনবিআর কী করে? এনবিআরের কাজ কী? তারা আমাদের ফাইল আটকায় টাকার জন্য।’
‘আমরা এত কষ্ট করি, রাত–দিন ২৪ ঘণ্টা খাটনি (পরিশ্রম) করে রপ্তানি করি, আমাদের দিকে কেউ তাকায় না। শুধু টাকা, শুধু টাকা! এনবিআরের একটা উইং এখানে নিয়ে আসা উচিত। কমার্স মিনিস্ট্রির একজন জয়েন্ট সেক্রেটারিকে এখানে (বিজিএমইএ) বসানো উচিত।’ যোগ করেন এ ব্যবসায়ী।
বিজিএমইএকে সমান্তরাল সরকার দাবি করে তৈরি পোশাক খাতের এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘আমাদের গভর্নমেন্ট আছে। আর বিজিএমইএ। বিজিএমইএ কিন্তু একটা প্যারালাল গভর্নমেন্ট। আমরা আশির দশক থেকে ব্যবসায় আছি। বিজিএমইএ প্যারালাল গভর্নমেন্ট।’
তৈরি পোশাক খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে উল্লেখ করে উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আজ পর্যন্ত এনবিআরের চেয়ারম্যান, কমার্স মিনিস্ট্রির সেক্রেটারি, ফাইন্যান্স মিনিস্ট্রির সেক্রেটারি—তারা এই পর্যন্ত দশটা লোকের চাকরি দিছে? কাউকে চাকরি দেয় নাই। চাকরি দিছি আমরাই।’
উপস্থিত বিজিএমইএর সদস্যদের দিকে নির্দেশ করে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটা লোক রাত–দিন ২৪ ঘণ্টা খাটে। তাদের কোনো ঘুম নাই। কই সরকারি সচিব, সরকারি চাকরিজীবীরা যারা ওইখানে (সচিবালয়ে) বসে আছে, তাদের কোনো অবদান আছে? আমরা অনেক কষ্ট করে যাচ্ছি। কিন্তু ওরা একেকটা সচিব, দেখেন, আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের কত কিছু করতে হয়।’
সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে আব্দুল্লাহ আল জহির আরও বলেন, ‘একদিকে আমরা কি ব্যাংক সামলাব, ফ্যাক্টরি সামলাব, নাকি বেতন দিব, নাকি ঘর সংসার চালাব?...আমরা এতগুলো গরিব দুঃখী শ্রমিককে পালতেছি। সরকারের কোনো লোকতো এদের পালে না। তুমি (সচিবদের নির্দেশ করে) পাইলা দেখ না। তুমি একটা সচিব, তুমি পাইলা দেখ না। তুমি আমাদের চেয়ারে আইস্যা দেখ। তুমি সচিব, ২ হাজার শ্রমিকের একটা গার্মেন্টস চালাই দেখ। বড় বড় কথা বলো!’
এ পর্যায়ে সভার সঞ্চালক তাঁকে বক্তব্য থামাতে অনুরোধ করলে উপস্থিত অনেক সদস্য তাঁকে বক্তব্য চালিয়ে যেতে বলেন। তালি বাজিয়ে তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন জানান তাঁরা।
আব্দুল্লাহ আল জহির আবার বলেন, ‘আমরা এই দেশের চালিকাশক্তি। আমরা এই দেশকে ধরে রাখছি। এই শিল্পের সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত সোয়া কোটি মানুষ।’
বেতন বৃদ্ধির দাবিতে চলমান শ্রমিক আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন যে সমস্যা হচ্ছে সেটা কোনো সমস্যা না। এই সমস্যা সমাধান করা কিছুই না।’
সরকারি কর্মচারীদের ঘুষ নেওয়া বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কালকে থেকে ঘুষ বন্ধ করে দেন, আমরা শ্রমিকদের পয়সা বাড়িয়ে দেব। এমন কোনো জায়গা নেই, ঘুষ দিতে হয় না। প্রত্যেকটা জায়গায় ঘুষ, ঘুষ, ঘুষ। কালকে আমার সঙ্গে আমার এক বন্ধুর কথা হলো, সে বলল, প্রত্যেকটা জায়গায় ঘুষ দিতে হয়।’
আবদুল্লাহ আল জহির স্বপন তাঁর এক বন্ধুর বরাত দিয়ে বলেন, ‘সে জানিয়েছে, প্রত্যেক মাসে ১০–২০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। আমি (বন্ধু) এনবিআরে গিয়েছি। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছে টাকা দিতে হবে।’
ঘুষের টাকা কোথায় যায় প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘টাকাটা কোথায় যায়? এটা কি সরকারি খাতে যায়? টাকাতো নিজেদের পকেটে যায়। সরকারি কাজে তো যায় না। আমার কথা হলো, কালকে থেকে আমরা ঘুষ দিব না। তাহলে আমরা শ্রমিকদের বেতন বাড়াব। ঘুষ দিতে হলে আমরা বেতন বাড়িয়ে দিতে পারব না। এটা সবার বলা উচিত। ঘুষ দিতে দিতে আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। কথা বললে এইভাবে বলতে হবে। আর কথা না বলে বিড়ালের মতো বসে থাকলে হবে না কিন্তু।’
তিনি আরো বলেন, ‘শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে ১৩/১ ধারায় কার্যকর করতে হবে। আমরা এখন পর্যন্ত অনেক নমনীয় ছিলাম। এ আইন কার্যকর করতে পারি না। আমরা মাফ করে দেই। এই মাফ করে দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নো ওয়ার্ক, নো পে এই ফর্মুলায় যেতে হবে। এখানে আর কোনো কম্প্রোমাইজ করা যাবে না। কাল থেকেই আন্দোলন বন্ধ না করলে ১৩/১ ধারায় কারখানা বন্ধ করে দিবো। নইলে আমাদের সম্পদ বাঁচানো যাবে না।