খন্দকার মো. মাহফুজুল হক
ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ যুদ্ধের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির কারসাজিতে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল নামক ইহুদি ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত আরববিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের বড়সড় যুদ্ধ হয়েছে তিনবার। এর মধ্যে ১৯৪৮, ১৯৬৭ ও সর্বশেষ ১৯৭৩ সালে টানা ২১ দিন যুদ্ধ করে মিসর ও সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাহিনী। পরে আরো কয়েকটি ছোটখাটো যুদ্ধ হয়েছে ইসরায়েলের সঙ্গে।
জন্মলগ্ন থেকেই ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা পশ্চিমা দুনিয়ার সর্বাত্মক সমর্থন ও সহায়তা পেয়ে আসছে ইসরায়েল। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পরিকল্পনা এবং প্রত্যক্ষ সহায়তায় ইসরায়েল গঠিত হলেও এতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। যদিও বাহ্যত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েল নামক ইহুদি রাষ্ট্রের সম্পর্ক দৃঢ় হয় ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ‘অফিস অব দ্য হিসটোরিয়ানসে’ উল্লেখ রয়েছে, হ্যারি এস ট্রুম্যান ১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের নীলনকশা অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। এর একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য।
ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেওয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। কিন্তু আরবদের জনসংখ্যা এবং জমির মালিকানা ছিল বহিরাগত ইহুদিদের দ্বিগুণ। স্বভাবতই আরবরা জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি।
অপর দিকে জাতিসংঘের ঘোষণার পর ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে ইহুদিরা বিজয় উল্লাস শুরু করে। পাশাপাশি চলে উগ্র ইহুদি দলগুলোর সন্ত্রাস ও জবরদখলের মহোৎসব। জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে স্বাধীন ভূখণ্ডের মালিক হওয়ার উল্লাসে বর্ণবাদী সশস্ত্র ইহুদি দলগুলোর নির্যাতন তখন এতটাই বেড়ে যায় যে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে জায়গা জুড়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ইহুদিরা তার চেয়ে আরো অনেক বেশি ভূখণ্ড দখল করে নেয়, ফলে সেখান থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই ফিলিস্তিনিরা আজ পর্যন্ত আর কখনো নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরে আসতে পারেনি।
১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘে যে ইশতেহার গ্রহণ করা হয় তার পক্ষে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ ভোট দেয় ৩৩ দেশ আর ১৩টি দেশ ভোট দেয় বিপক্ষে।
এরপর ৩১ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যরা ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে, অপর দিকে ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো এবং তাদের গোপন অস্ত্র কারখানা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এ সময় ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা-নির্যাতনের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে আরবরা অনুধাবন করেছিল যে কূটনীতি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। তখন তারা ইহুদিদের হামলার পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। একই দিন তৎকালীন ইহুদি নেতারা ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্মের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার পরপরই মিসর, ইরাক, লেবানন, জর্দান ও সিরিয়া মিলে ইসরায়েলের ওপর হামলা শুরু করে। তখন এই পাঁচ দেশের সম্মিলিত সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজারের মতো। অন্যদিকে ইসরায়েলের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার, যারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রশিক্ষিত এবং আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত। তার পরও তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। তাদের অস্ত্রের মজুদও শেষ হয়ে যায়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে আরেকটু অগ্রসর হলেই মিসরীয় বাহিনী তেল আবিবে ঢুকে পড়তে পারত। সম্ভাব্য পরাজয় আঁচ করতে পেরে ইহুদিরা নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সময় নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে। তখন ইসরাইলকে সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে যেতে কৌশলী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পশ্চিমা বিশ্ব। তাদের উদ্যোগে জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
যুদ্ধবিরতির ফাঁকে চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে আধুনিক অস্ত্রের চালান পাঠানো হয় ইসরায়েলের হাতে। ফলে যুদ্ধবিরতি শেষ হলে নতুন করে আরবদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরায়েলি বাহিনী এবং একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয় ইহুদিরা। মূলত ১৯৬৭ সালের ৫ জুন ইসরায়েলের অতর্কিত হামলায় আরবরা বেশ পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। ওই যুদ্ধে গাজা উপত্যকা, মিসরের সিনাই উপদ্বীপ, সিরিয়ার গোলান উপত্যকা, পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম সবই দখল করে নেয় ইসরায়েল।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ইসরায়েলের বর্ণবাদী ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার যে তাণ্ডব শুরু করেছিল তা দীর্ঘ ৭৫ বছরেও থেমে থাকেনি। পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে বর্ণবাদী এই রাষ্ট্রটি ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে। অপর দিকে নির্যাতন, বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার ফিলিস্তিনের জনগণ অপেক্ষাকৃত দুর্বল হলেও তারা তাদের মাতৃভূমি ফিরে পাওয়ার বাসনা পরিত্যাগ করেনি, বরং সাত দশক আগে প্রতিরোধের যে ধারা সূচিত হয়েছিল তা যে কেবল অব্যাহত রেখেছে তা-ই নয়, বরং তাতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভেতরে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের নজিরবিহীন অভিযান প্রমাণ করে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে। তারা তাদের শৌর্যবীর্য, সাহসিকতা ও প্রতিরোধের দক্ষতার জানান দিতে সক্ষম হয়েছে। জবরদখলকারীদের পৃষ্ঠপোষকদের এই বার্তাই দিতে চেয়েছে যে ফিলিস্তিনিদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পাশ কাটিয়ে কয়েকটি দেশের সঙ্গে আপসরফার মাধ্যমে কোনো ফল পাওয়া যাবে না বরং ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। দশকের পর দশক ধরে চলে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো নৃশংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক সমাজ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে তার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। এ ছাড়া এতকাল অজেয় ইসরায়েল বলে যে রূপকথা গড়ে তোলা হয়েছে, হামাসের অভিযানে তা খানখান হয়ে যায়। হামাসের অভিযান ইসরায়েল ও তার পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি আরেকটি স্পষ্ট বার্তা হলো―ফিলিস্তিনিরা একতরফা আঘাত আর চোখ বুজে সহ্য করবে না। বরং সময় হয়েছে আঘাতের প্রতিঘাত করার।
অপর দিকে হামাসের দুঃসাহসিক অভিযানের প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল যা করে যাচ্ছে তা কাপুরুষতা ছাড়া আর কিছু নয়। খাদ্য-পানি-বিদ্যুৎ ও চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ বন্ধ করে এবং নারী-শিশুসহ বেসামরিক মানুষ হত্যা ও সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো বীরত্বের পরিচায়ক হতে পারে না।
তবে ইসরায়েলের বর্ণবাদী সরকারের ধ্বংসযজ্ঞ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ নতুন কিছু নয়। ১৯৪৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে নির্বিচার হত্যা, নির্যাতন এবং ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে সেখানে ইহুদি উপশহর নির্মাণের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে ২২৫টির মতো প্রস্তাব পাস হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল এর একটি প্রস্তাবকেও গ্রাহ্য করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশের একপেশে সমর্থন এবং কয়েকটি আরবদেশের বিশ্বাসঘাতকতা ও আপসকামী নীতি ইসরায়েলের বর্ণবাদী সরকারকে এক ঔদ্ধত শক্তিতে পরিণত করেছে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর একতরফা সমর্থন এবং প্রশ্রয়ে বিশ্বের একমাত্র ইহুদিবাদী এই রাষ্ট্রটি শুধু ফিলিস্তিন নয় বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। গড়ে তুলেছে পরমাণু অস্ত্রসহ অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিশাল মজুদ। প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর যখন-তখন বিমান হামলা চালানো, কোনো কোনো মুসলিম দেশের শান্তিপূর্ণ পরমাণু স্থাপনা ও বিজ্ঞানীদের টার্গেটে পরিণত করাসহ নানা অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমে গোটা অঞ্চলকে অশান্ত করে তুলেছে।
বিস্ময়ের বিষয় হলো, কুয়েতকে মুক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র বাহিনী ইরাক আক্রমণের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের অবাধ্যতাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছিল। অথচ জাতিসংঘের অসংখ্য প্রস্তাবের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করলেও ইসরায়েলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো নীরব-নির্বিকার।
বিশ্বকে এখন বলা হয় গ্লোবাল ভিলেজ। তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমোন্নতি ও দ্রুত বিস্তারের ফলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মানুষ সহজেই দূরবর্তী স্থান থেকেও তথ্যের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে পারছে। এ ছাড়া মানুষ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সচেতন। তাই ইসরায়েলের অব্যাহত অপরাধযজ্ঞ এবং বর্ণবাদী আচরণের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের একতরফা সহায়তা ও সমর্থন বিশ্ববাসীকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। বিশ্বের সব জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ যুদ্ধ, হানাহানি ও রক্তপাত দেখতে চায় না। সুন্দর শান্তিপূর্ণ ও মানবিক এক বিশ্ব এখন মানবজাতির উদগ্র প্রত্যাশা। গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক গণহত্যা এবং অবরোধের মাধ্যমে নিরীহ বেসামরিক মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো অমানবিক কাজের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে যে প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে শান্তির প্রতি মানুষের উদগ্র বাসনার চিত্র ফুটে ওঠে।
অতএব বিশ্বশান্তির জন্য যুদ্ধ ও যুদ্ধংদেহী মানসিকতা পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ও সংবেদনশীল ফিলিস্তিন ইস্যুর ন্যায্য সমাধান হতে হবে। আর এখন এটা সুস্পষ্ট যে গণহত্যা চালিয়ে কিংবা কয়েকটি দেশকে আপসরফায় বাধ্য করে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া এই সংকট সমাধানে যে দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের ধারণা উপস্থাপন করা হয়েছে তা শুরু থেকেই দুই পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। অতএব এই সমস্যার স্থায়ী ও ন্যায্য সমাধানের জন্য গণতান্ত্রিক পন্থার দিয়ে ফিরে যেতে হবে। ৭০ লাখ ফিলিস্তিনি, যারা নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে অন্য দেশের আশ্রয়ে রয়েছে তাদেরকে নিজ ভিটেমাটিতে পুনর্বাসন করে এই ভূখণ্ডের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। গণভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে এই ভূখণ্ডের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা গেলে তাতে স্থায়ী শান্তির দুয়ার খুলে যেতে পারে।
লেখক : ইরানের সম্প্রচার সংস্থার বাংলা বিভাগের সাবেক পরিচালক