মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে সভাপতি এবং আসাদুল্লাহ-হিল গালিবকে সাধারণ সম্পাদক করে দীর্ঘ সাত বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
গত শনিবার ৩৯ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে কমিটির বেশির ভাগের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এদিকে বিবাহিত, ড্রপআউট, অছাত্র ও টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ এনে সদ্যগঠিত কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন রাবি ছাত্রলীগের একাংশ।
শনিবার রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে সহসভাপতি হিসেবে ২০ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তারা হলেনমো. মেজবাহুল ইসলাম, শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন, জাকিরুল ইসলাম জ্যাক, মো. মঈনউদ্দিন রাহাত, মো. মেহেদী হাসান মিশু, মেহেদী হাসান তায়েব, মো. মামুন শেখ, মো. নূর সালাম, আলতাফ সায়েম জেমস, আশিকুর রহমান আশিক, তাওহীদুল ইসলাম দুর্জয়, আল আমিন মো. তানভীর, তামান্না আক্তার তন্বী, আবুল বাশার আহম্মেদ, জান্নাতুল নাঈমা আকন্দ জানা, সামিউল আলম সোহাগ, মো. মোমিন ইসলাম, শাখাওয়াত হোসেন শাকিল, মো. জুয়েল হোসেন এবং মনু চন্দ্র মোহন দেব বর্মণ। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আটজন হলেন ভাস্কর সাহা, মো. নাঈম আলী, নিয়াজ মোর্শেদ, মো. আশিকুর রহমান অপু, আব্দুল্লাহ আল মামুন স্বদেশ, তাজরিন আহমেদ মেধা, সাদেকুল ইসলাম সাদিক এবং মো. শামীম হোসেন। সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন ৯ জন। তারা হলেন মো. কাব্বিরুজ্জামান রুহুল, আল মুক্তাদির তরঙ্গ, প্রিয়াংকা সেন মৌ, ইমরান হোসেন, বুলবুল জোয়ার্দার, মো. জুবায়ের হাসান, নাশরাত আর্শিয়ানা ঐশী, জাহিদ হাসান সোহাগ এবং মো. কাইয়ুম।
নতুন ঘোষিত এ কমিটির বেশির ভাগই ছাত্রত্ব হারিয়ে এখন সান্ধ্যকালীন কোর্সধারী। সিটবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নির্যাতন, দলীয় কোন্দলসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাদের নামে।
ঘোষিত কমিটির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে অনার্স এবং পরের বছর মাস্টার্স শেষ করেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব আদার ল্যাঙ্গুয়েজ নামক একটি শর্টকোর্সে ভর্তি আছেন।
সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল গালিব রাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (আইআর) বিভাগে ২০১৪-১৫ সেশনে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রথম বর্ষে কৃতকার্য হয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উঠলেও দ্বিতীয় বর্ষ টপকাতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ড্রপআউট হন গালিব। ছাত্রত্ব দেখাতে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাসের ‘ভুয়া’ সনদ দেখিয়ে রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হন।
তবে এসব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে গালিব বলেন, ‘আমি বর্তমানে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি রয়েছি।’
নতুন কমিটির সহসভাপতি মো. মেজবাহুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালে অনার্স এবং পরের বছর মাস্টার্স শেষ করেন। এরপর ছাত্রত্ব ধরে রাখতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজের ইংলিশ ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি আছেন বলে অভিযোগ আছে।
আরেক সহসভাপতি মেহেদী হাসান মিশুও ড্রপআউট হয়ে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সিট-বাণিজ্য, দোকান ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে মিশু বলেন, ‘চাঁদাবাজি ও সিট-বাণিজ্যের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। যদি সেটা কেউ করে থাকে তবে আমার নাম ভাঙিয়ে করেছে।’
সহসভাপতি আলফাত সায়েম জেমসের নামে হলকক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চুরি, বরাদ্দকৃত সিটে না থাকতে দেয়া ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তার নামে সিট-বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে।
তামান্না আক্তার তন্নী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী। তার মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ হয়েছে ১৮ মাস আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মিত শিক্ষার্থী হওয়ায় তাকে নিজের দখলে রাখা সিট ছাড়ার নির্দেশ দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রহমতুন্নেসা হলের গেটে তালা মেরে দেন এই ছাত্রলীগ নেত্রী।
আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাইম আলীর নামে দলীয় কর্মসূচিতে না যাওয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) দুই শিক্ষার্থীর বিছানাপত্র নামিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায়কে নির্যাতনের পর মেরে ‘শিবির’ বলে চালিয়ে দেয়ার হুমকির ঘটনায় তদন্তে এই ছাত্রলীগ নেতার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির সভায় তার ছাত্রত্ব সাময়িক বাতিলের সুপারিশ করা হয়।
এদিকে বিতর্কিত কমিটি গঠনের প্রতিবাদে গতকাল রোববার দুপুরেই মাদার বখশ হলে ঢুকে সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল গালিবের কক্ষ ভাঙচুর করেছে একাংশের নেতাকর্মীরা।
তাদের মধ্যে ছিলেন সদ্য সাবেক কমিটির সহসভাপতি আমিনুল ইসলাম লিংকন, সদ্য ঘোষিত কমিটির সহসভাপতি তাওহীদুল ইসলাম দুর্জয়, শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য সাকিবুল হাসান বাকিসহ তাদের অনুসারীরা।
অপরদিকে গতকাল সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের একাংশ। ক্যাম্পাসে নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেয়া হয় সেখান থেকে।
বর্তমান কমিটির সহসভাপতি শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন বলেন, ‘সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে গালিব গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়েছে। আমরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এই নেতৃত্ব মানব না। বিতর্কমুক্ত কমিটি ঘোষণা করতে হবে। অন্যথায় তাদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেব না।
সার্বিক বিষয়ে রাবি ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বলেন, ‘নতুন এই কমিটিকে বিশ্ববিদ্যায়ের সব স্তরের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা স্বাগত জানিয়েছেন। আমাদের সংগঠনের কতিপয় ছাত্রনেতা ও কর্মী কমিটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন। তারা এই কমিটিকে অবাঞ্ছিত করার কেউ নন। এতে ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে আমরা প্রতিহত করব।’
প্রসঙ্গত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২৬তম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় গত ১৮ সেপ্টেম্বর। এর প্রায় এক মাস পর ৩৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গতকাল ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এর আগে ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বরের ২৫তম সম্মেলনের মাধ্যমে শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে গোলাম কিবরিয়া সভাপতি ও ফয়সাল আহমেদ রুনু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ভোরেরপাতা/এফ