শিল্পপতি ও দানবীর ড. রাগীব আলী সিলেট তথা বাংলাদেশের এক কৃতি সন্তান। দান ও সাহায্যের ক্ষেত্রে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে রাগীব আলী বিলেতে গমন করেন। অল্প সময়ের মধ্যে বিলেতে অত্যন্ত সফল একজন ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু দেশমাতৃকার টানে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিলেতের অনেকটা আরাম-আয়েশের জীবন ত্যাগ করে তিনি বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে ফিরে আসেন। এরপর বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের জন্য তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে যা করেছেন এবং অদ্যাবধি করে যাচ্ছেন তা আজ ইতিহাস।
কঠোর পরিশ্রাম, ইস্পাত কঠিন সংকল্প ও পাহাড়সম প্রতিজ্ঞা জনাব রাগীব আলীকে অল্পদিনের মধ্যে পরিণত করে দেশের অন্যতম শিল্প উদ্যোক্তা। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্পপতি। যে দিকে হাত দিয়েছেন সে দিক থেকেই এসেছে অভূতপূর্ব ও অচিন্ত্যনীয় সফলতা। তিনি ব্যক্তি-মালিকানাধীন বাংলাদেশের চা-শিল্পের অন্যতম পুরোধা। সিলেটের প্রথম আধুনিক শপিং সেন্টার তাঁরই করা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ আজ বাংলাদেশের প্রধান প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজগুলোর অন্যতম। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই মেডিক্যাল কলেজ থেকে একদিকে যেমন প্রতি বছর শত শত ডাক্তার বের হচ্ছে ঠিক অপরদিকে লক্ষ লক্ষ রোগী প্রতি বছর সহনীয় খরচে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। বৃহত্তর সিলেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারিত দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকা তাঁর হাত দিয়েই গড়া। জনাব রাগীব আলীর প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আজ দেশসেরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোর মধ্যে অন্যতম। তিনি ব্যাংক-বীমাসহ বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত।
এ ছাড়া জনাব রাগীব আলী হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মসজিদ, এতিমখানা, চ্যারিটেবল ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান। প্রাইভেট ব্যাংক ও অন্যান্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা অগ্রগণ্য। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মসংস্থান হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। অপরদিকে গরিব, দুস্থ, অভাবীদের দুহাতে দান করে যাচ্ছেন এই কর্মবীর। বহু ঘটনা এমন আছে, যেখানে অভাবীরা এসেছেন তাঁর কাছে একটু সাহায্যের জন্য, কিন্তু রাগীব আলী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে শুধু তাদের অভাবটুকু দূর করে দেননি, বরং বিভিন্নভাবে তাদেরকে স্থায়ীভাবে স্বাবলম্বী করে দিয়েছেন। তাঁর দান ও সাহায্য এমন ব্যাপক ও গভীর যে, ধীরে ধীরে তিনি সাধারণ জনতার কাছে হয়ে ওঠেন ‘দানবীর রাগীব আলী’ হিসেবে।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে ড. রাগীব আলী অসংখ্য রাস্তাঘাট ও কালভার্ট নির্মাণ করেছেন, স্থাপন করেছেন শত শত টিউবওয়েল। সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় নিজ উদ্যোগে রাস্তা পাকা করেছেন, মেরামত ও সংস্কার করেছেন প্রায় ২৫ কিলোমিটারের উপরে পুরাতন রাস্তা। তাঁর নিজ অর্থ ব্যয়ে কয়েক শত আশ্রয়হীন ও গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ করে দিয়েছেন। তাঁর কর্মতৎপরতা শুধু সিলেটে নয় বরং গোটা বাংলাদেশ জুড়ে। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, হবিগঞ্জ, রাঙামাটি, কুষ্টিয়া ও মাগুরাসহ বিভিন্ন জেলায় স্কুল, মাদরাসা, কলেজ ও বিভিন্ন ইন্সটিটিউট তিনি নির্মাণ করেন।
দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দানবীর রাগীব আলীর ভূমিকা অপরিসীম। তাঁর একক প্রচেষ্টায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক পাকা গৃহনির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। তিনি দক্ষিণ সুরমা থানা কমান্ড অফিস ও জকিগঞ্জ থানা কমান্ড অফিসের জন্য আর্থিক অনুদান এবং জৈন্তাপুর ইউনিয়ন কমান্ড অফিস নির্মাণ করে দিয়েছেন। এছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জ ও জৈন্তাপুরে দুটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে দিয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা বিনা বেতনে অধ্যয়ন করছে। রাগীব আলী প্রতি বছর দুই ঈদে নিয়মিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নগদ আর্থিক অনুদান ও বস্ত্র বিতরণ করে আসছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার পরিজনদের জন্য বিনা খরচে তাঁর প্রতিষ্ঠিত জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র্রে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করেছেন।
রাগীব আলী তাঁর দীর্ঘজীবনে দেশে-বিদেশে পেয়েছেন অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার। তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন, পেয়েছেন অগণিত মানুষের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। তাঁকে নিয়ে, তাঁর জীবনী ও কর্ম নিয়ে বের হয়েছে অনেক বইপুস্তক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তাঁকে এখনও বাংলাদেশের রাষ্ট্র্রীয় সম্মানে ভূষিত করা হয়নি। এটা আমাদের দীনতা ও ব্যর্থতা।
অথচ ব্রিটেনে দীর্ঘদিন থেকে সেখানে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এমন নিরবিচ্ছন্নি অবদান রাখলে তাঁকে ‘স্যার’ উপাধি দেয়া হতো, যেমন দেয়া হয়েছে স্যার ফজলে হাসান আবেদনসহ ব্রিটেনে অবদান রাখা অনেক গুণী ব্যক্তিদের। তাঁকে হয়তো নেয়া হতো হাউস অব লর্ডস-এর মেম্বার তথা লর্ড হিসেবে। তাঁর একক ব্যক্তি অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ হয়তো তাঁকে নোবেল পুরস্কারের জন্য নমিনেট করা হতো।
জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলতেন ‘যে দেশে জ্ঞানীর কদর নেই, সেই দেশে জ্ঞানীর জন্ম হয় না’। তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে বলব, যে দেশে রাগীব আলীর মতো দানবীর ও শিল্পপতির রাষ্ট্র্রীয় কদর নেই সেই দেশে এমন ব্যক্তি বেশি জন্মায় না। বরং বেশি জন্মায় বিদেশে পাচারকারী ও কালো টাকার মালিক নামের ব্যক্তিরা যারা শুধুই চিনে টাকা আর মুনাফা!
দানবীর রাগীব আলী একজন সহজ-সরল ও উদার মনের মানুষ। তিনি নিজেকে নিজস্ব পরিম-লে রেখে জীবনে শুধু অর্থ কামানো ও মুনাফা করাকে ব্রত বানিয়ে এগিয়ে যাননি। বরং একজন সাধারণ বাঙালি হিসেবে দেশের সার্বিক কল্যাণে বহুমাত্রিক কর্মকা-ে নিয়োজিত হয়ে সমাজ উন্নয়নে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। তিনি রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন গঠন করে তাঁর জীবনের অর্জিত সব সম্পদকে জণকল্যাণে প্রতিনিয়ত ব্যয় করছেন। তাঁর অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে ব্যক্তিগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক বিরল দৃষ্টান্ত। এমন ব্যক্তিকে নিয়ে জাতি গর্ব করতে পারে।
দানবীর রাগীব আলী আজ জীবনসায়াহ্নে উপনীত। গতকাল ১০ অক্টোবর ২০২৩-এ অবতীর্ণ হন তিনি শতবর্ষী ব্যক্তিত্বে। দাঁত থাকতে আমরা দাঁতের গুরুত্ব দেই না। আমরা অনেককে সম্মান দেই, তবে মৃত্যুর পরে। মৃত্যুর পর কোনো ব্যক্তিকে সম্মান দিলে ঐ ব্যক্তি তো আর দেখে যেতে পারেন না। আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যক্তিত্বদেরকে জীবিত থাকতেই মূল্যায়ন করা দরকার, দরকার যথাযথ সম্মান দেখানো। এতে অন্যরা অনুপ্রাণিত হবেন। ড. রাগীব আলী এই ধরা ছেড়ে যাবার আগে তাঁকে রাষ্ট্র্রীয় সম্মানে ভূষিত করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার ও লন্ডন বারা অব নিউহ্যামের সাবেক ডেপুটি স্পিকার।