মেলা বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি অংশ। কবে, কোথায়, কখন মেলার প্রচলন শুরু হয় তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে, অনেকের ধারণা গ্রাম্য হাট থেকেই এই মেলার উৎপত্তি। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থার জরিপে সারাদেশে মোট মেলার সংখ্যা বলা হয়েছে ১০০৫টি। এর অল্প কিছু ছাড়া আর প্রায় সবটাই গ্রামীণ মেলা।
আবহওয়ামান বাংলার সংস্কৃতির ঐতিহ্য মেলার একটি বাণিজ্যিক দিক রয়েছে। ধর্মীয় চেতনার বাইরে অন্যান্য সামাজিক বা লৌকিক আচারগুলোও এই মেলার সঙ্গে যুক্ত।
বহুকাল ধরে সাতক্ষীরায় হয়ে আসছে গুড়পুকুরের মেলা। দেশের অন্যান্য অনেক মেলার মতো এই মেলারও উৎপত্তি, নামকরণ এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়না। অতীতে এনিয়ে তেমন কোন লেখালেখিও হয়নি। তবে গত বিংশ শতাব্দির শেষ দিক থেকে এই মেলা সম্পর্কে অনেকের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। শুরু হয় লেখালেখি। এসব লেখায় পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত না থাকলেও কিছু সূত্র পাওয়া যায়। যেসব সূত্র এই মেলার ইতিহাস সম্পর্কে একটা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ধারণা দিতে পারে।
এক.
গুড় বংশের উত্তরসূরিদের পুকুর। তাই গুড়পুকুর। সেই পুকুরকে ঘিরে শুরু হয়েছিল মেলা। তাই নাম হয়েছে গুড়পুকুরের মেলা। সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহি গুড়পুকুরের মেলার নামকরণের ইতিহাস নিয়ে যে সীমিত পরিমান লেখালেখি হয়েছে, সেখানে কামদেব ও জয়দেব-এর কামালউদ্দিন খাঁ ও জামালউদ্দিন খাঁ হয়ে ওঠার কাহিনী উল্লেখ রয়েছে। এ দু’জনের মধ্যে কোনো একজনের পরবর্তী বংশধর হিসেবে বোরহার খাঁ ওরফে বুড়া খাঁ এঁর নাম উল্লেখ করেন কেউ কেউ।
বাগেরহাটের পীর খান জাহান আলী দক্ষিণবঙ্গে আগমনের পর দক্ষিণডিহির শাসনভার তাঁর বিশ্বস্ত সহচর মুহম্মদ আবু তাহেরের হাতে অর্পন করেন। তিনি তাঁর দলকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে একটি দল নিয়ে ভৈরবকূল দিয়ে বাগেরহাট অভিমুখে যাত্রা করেন। অপরদলটির নেতৃত্বে ছিলেন বোরহান খাঁ ওরফে বুড়া খাঁ। বুড়া খাঁ ও তাঁর পুত্র ফতেহ খাঁ এর নেতৃত্বে এই দলটি কপোতাক্ষ নদ বেয়ে দক্ষিণে সুন্দরবনাঞ্চলে পৌছান। বুড়া খাঁ এই এলাকা দিয়ে রাস্তা নির্মাণ, আবাদ পত্তন ও ধর্ম প্রচার করেন। এছাড়াও তিনি কয়রার আমাদি এলাকায় শাসনভার পরিচালনার জন্য কাছারি গড়ে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে এখানে নির্মাণ করা হয় মসজিদকুড় মসজিদ। রাজা প্রতাপাদিত্যের যশোর রাজ্যের রাজধানী ঈশ্বরীপুর এলাকায়ও বুড়া খাঁর আস্তানা ছিল। খান জাহান আলীর পরামর্শে বুড়া খাঁসহ তাঁর সহচররা যে পথ দিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন তার উভয় পার্শ্বের জনসাধারণের পানির কষ্ট নিবারণের জন্য দিঘি খনন করেছিলেন। কেশবপুরের বিদ্যানন্দকাটি, মাগুরাঘোনা, আসরনগর, পাইকগাছার লষ্করবেড়, বেদকাশিসহ বিভিন্নস্থানে এ ধরনের দিঘির অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
কারো কারো মতে বুড়া খাঁ বাগেরহাট থেকে চলে এসে সাতক্ষীরার প্রাণকেন্দ্রের পলাশপোল গ্রামে বাড়ি ঘর তৈরি করে বসতি স্থাপন করেন। গড়ে তোলেন পলাশপোল চৌধুরী বাড়ি। চৌধুরী বাড়ির পূর্বপাশের একটা দরগা তৈরি করে সেখানে ধর্ম সাধনা করতে থাকেন। দরগাটি বিরাট এক বটগাছ কাঁধে নিয়ে বহুকাল টিকে ছিল। বুড়া খাঁ তার বংশধরদের রেখে যান পলাশপোল চৌধুরী বাড়িতে। চৌধুরী বাড়ির অধীনে তখন পলাশপোল মৌজার বৃহৎ এলাকা। এলাকাবাসী খাজনা দিতো চৌধুরীদের। এটি সাতক্ষীরার জমিদারদের অধীনে ছিল না।
গুড়পুকুরের মেলার নামকরণের ইতিহাস খুঁজতে সাতক্ষীরার কোনো কোনো লেখক কামদেব, জয়দেবদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সময়কাল চতুর্দশ শতাব্দির মধ্যভাগ পর্যন্ত পিছনে গেছেন এবং শুরু করেছেন সেখান থেকেই। কিন্তু এই কামদেব, জয়দেবরা কোথা থেকে এলেন এবং তাদের পূর্বপুরুষরা কারা ছিলেন সেই ইতিহাস খুঁজে দেখেননি। অথবা সেটাকে গুরুত্ব দেননি।
ইতিহাসে পাওয়া যায় কামদেব, জয়দেবরা ছিলেন গুড় বংশের উত্তরসূরি। এই গুড় বংশের উৎপত্তি মুর্শিদাবাদের ৬ ক্রোশ পশ্চিমে গুড় গ্রাম থেকে। কনোজাগত দক্ষ-এর জ্যৈষ্ঠ পুত্র ধীর ‘গুড় গ্রাম’ প্রাপ্ত হয়ে সেখানে বসবাস শুরু করেন। সেজন্য এই বংশের লোকজন গুড়ী বা গুড়গ্রামী হিসেবে পরিচিতি পান। ধীর হয়ে ওঠেন ‘ধীর গুড়’।
এই বংশের চতুর্থ প্রজন্ম শরণ বল¬ালসেনের গৌণ কুলীনের অন্যতম। শরণের প্রপৌত্র ভবদত্ত পশ্চিমবঙ্গের পাঠান শাসনকালে গুণগরিমায় খাঁ উপাধি পান। ব্রাহ্মণের খাঁ উপাধি পাওয়ায় লোকে তাঁকে ‘বামন খাঁ’ বলতেন। ভবদত্তের পৌত্র রঘুপতি আচার্য্য শেষ বয়সে বানপ্রস্থ অবলম্বন করে (ধর্মীয় কারনে অবসর গ্রহণ) কাশীবাস কালে পান্ডিত্যের জন্য দন্ডীদের নিকট হতে একটি স্বর্ণদন্ড উপহার পান, এজন্য তাঁর উপাধি হয় কনকদন্ডী। তাঁর বংশধররা কনকদন্ডী গুড় বলে পরিচিতি পান।
বল¬ালসেনের সময় সূর্যমাঝি নামক একজন জেলে সম্প্রদায়ের লোক অদ্ভুত কাজের পুরস্কার স্বরূপ সূর্যদ্বীপের রাজত্ব পান। এই সূর্যমাঝির এক অধস্তন পুরুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুলতান মাঝি বলে পরিচিত হন। প্রবাদ আছে, কনকদন্ডী গুড়-এর পুত্র রমাপতি এই সুলতান মাঝির কাছ থেকে সূর্যর্দ্বীপ অধিকার করে নেন।
রমাপতির চার পুত্র-সর্ব্বানন্দ, জ্ঞানানন্দ, প্রেমানন্দ ও অমৃতানন্দ। তন্মধ্যে অমৃতানন্দ সরস্বতী সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করে সিদ্ধিলাভ করেন। জ্ঞানানন্দের পুত্র জয়কৃষ্ণ; তৎপুত্র নাগরনাথ ও দক্ষিণানাথ। সম্ভবত: রাজা গণেশের সময় নাগর ও দক্ষিণানাথ ভ্রাতাদ্বয় হিন্দু নরপতির সাহায্য করে সন্তুষ্ঠ করেন এবং তার ফলে রায়চৌধুরী উপাধি পান। এই দুই ভ্রাতা চেঙ্গুটিয়া পরগণা দখল করেন এবং অপেক্ষাকৃত নিরাপদ প্রদেশে সদর্পে শাসনদন্ড পরিচালনার জন্য দক্ষিণডিহি অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। কেউ কেউ দক্ষিণডিহি নামের সাথে দক্ষিণানাথ নামেরও সম্বন্ধ স্থাপন করেন।
নাগরনাথ নি:সন্তান ছিলেন। দক্ষিণানাথের চার পুত্র ছিল- কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব। ১৪৪২ খ্রিষ্টব্দে খান জাহান আলী দক্ষিণবঙ্গ জয় করেন। দক্ষিণডিহিতে তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠার পর কামদেব ও জয়দেব প্রধান কর্মাধ্যক্ষ হন এবং তাঁর উজীর হন মুহম্মদ আবু তাহের। এই মুহম্মদ আবু তাহের ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং তার নাম ছিল গোবিন্দ ঠাকুর। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার বিভিন্ন কর্মকান্ডে সন্তুষ্ট হয়ে স্থানীয় হিন্দু মুসলমানরা তাঁকে ‘পীর আলী’ উপাধি দেন। এই পীর আলীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে স্থানীয় হিন্দু বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকেন। এভাবে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, তারা পীর আলী মুসলমান’ বলে চিহ্নিত হন এবং যারা ইসলাম গ্রহণ করলেন না তারা পীর আলী ব্রাহ্মণ, পীর আলী কায়স্থ, পীর আলী নাপিত ইত্যাদি হিসেবে চিহ্নিত হন। এইরূপ পীর আলী বা পীরালি হিন্দু ও মুসলমান যশোহর-খুলনার বহুস্থানে বসবাস করেন।
পীর আলী উপাধি সম্পর্কে আর একটি ধারণা প্রচলিত আছে। দক্ষিণানাথ রায় চৌধুরীর দুই পুত্র কামদের ও জয়দের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজ তাদেরকে ভালো চোখে দেখতো না। তাদের অপর দুই ভ্রাতা রতিদেব ও শুকদেবসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলেও তাদেরকে সমাজচ্যুত করা হয়। এজন্য কামদেব ও জয়দেবদেরকে পীর আলী মুসলমান এবং রতিদেব ও শুকদেবসহ তাদের অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের পীর আলী ব্রাহ্মণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারো কারো মতে পীর আলী উপাধিটাকে এভাবে উপস্থাপন করা হলেও প্রকৃত পক্ষে অনেকের কাছে এটি একটি সম্মানজনক পদবীতে পরিণত হয়।
একবার রোজার দিনে কামদেব, জয়দেরসহ কর্মচারিরা বসে থাকা অবস্থায় একব্যক্তি পীর আলীকে একটি সুগন্ধি কমলা লেবু উপহার দেন। পীর আলী উক্ত কমলার ঘ্রাণ নেন। এ সময় কামদেব রসিকতা করে বলেন, হুজুর, ঘ্রাণ নিলে যে অর্ধেক ভোজন হয়, আপনি যে গন্ধ গ্রহণ করে রোজা ভেঙে ফেললেন?
পীর আলীর দরবারে এই হাস্য রসিকতার কিছুদিন পর দরবারে গরুর মাংস রান্না হচ্ছিল। এর গন্ধে দরবার ভরপুর ছিল। এ সময় কামদেব ও জয়দেবসহ প্রজারা দরবারে উপস্থিত হন। তখন কামদেব কিসের গন্ধ জিজ্ঞেস করলে পীর আলী বলেন, সেখানে গরুর মাংস রান্না হচ্ছে। আর ঘ্রাণে তাদের অর্ধেক ভোজন হওয়ায় জাত গেছে। এই ঘটনার কিছুদিন পর কামদেব ও জয়দেব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে কামাল উদ্দীন খাঁ ও জামাল উদ্দীন খাঁ উপাধি পান (কমলা লেবু ও গরুর মাংস রান্নার ঘ্রাণ সম্পর্কিত হাস্য রসিকতার ঘটনাটি দরবারের পীর আলীর পরিবর্তে খান জাহান আলীর সাথে হয়েছিল বলে কোন কোন লেখায় উল্লেখ রয়েছে)।
পরবর্তীতে কামাল উদ্দীন খান ও জামাল উদ্দীন খান জায়গীর পেয়ে নিকটবর্তী সিঙ্গিয়া গ্রামে বাস করতে শুরু করেন। তাঁরা মুসলমান হলেও হিন্দু আচার ব্যবহার পরিত্যাগ করতে তাদের বহুপুরুষ লাগে। এসময় পীর আলী মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা বহুপুরুষ পর্যন্ত হিন্দুর মতো নাম রেখে শিবপূজা, শিবরাত্রিব্রত, ষষ্ঠীপূজা প্রভৃতি অনুষ্ঠান করতেন।
মোগল শাসনের শুরুতে জনৈক চাঁদ খাঁ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে এঁর নেতৃত্বে বহু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই চাঁদ খাঁ সাতক্ষীরার চাঁদপুরে বসবাস করতেন। তিনিও পীর আলী মুসলমান হিসেবে পরিচিতি পান।
ক্রমে ক্রমে সাতক্ষীরার শ্রীরামপুর, কুলিয়া, কোমরপুর, পলাশপোল, হেলাতলা, নগরতলা, (সম্ভবত নগরঘাটা) গণপতিপুর, পাথরঘাটা, হাকিমপুর, রসুলপুর প্রভৃতি স্থানে পীরালি মুসলমানের বসবাস শুরু হয়।
দক্ষিণানাথ রায় চৌধুরীর পুত্র কামদেব ও জয়দেব ওরফে কামাল উদ্দীন খাঁ ও জামাল উদ্দীন খাঁ গুড় বংশের ত্রয়োদশ প্রজন্ম। তাদের অপর দুই ভাই রতিদেব ও শুকদেব। এরমধ্যে শুকদেব প্রথম পীর আলী হিসেবে চিহ্নিত। এই শুকদেবের বংশধররা দক্ষিণডিহী, হলদা-মহেশপুর, জগন্নাথপুর, মহাকাল, শেখহাটি, নরেন্দ্রপুর, ঘোপেরঘাটসহ বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়েন। শুকদেবের কন্যা বা পৌত্রীর বিবাহ হয় খুলনার পিঠাভোগের কুশারী বংশে। এই বংশে বিবাহ করেন কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরসহ ঠাকুর পরিবারের অনেকেই।
সাতক্ষীরার গুড়পুকুরের মেলার নামকরণ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত হয়েছে। যেমন-
ক) কেউ বলেন, মনসা পূজার সময় পুকুরে বাতাসা ফেলা হতো। ওই বাতাসার জন্যে পুকুরের পানি মিষ্টি লাগতো। তখন থেকেই গুড়পুকুর।
খ) অনেকের ধারণা পুকুরে পানি থাকতো না বেশিদিন। স্বপ্ন দর্শনে জানা গেল একশ’ ভাঁড় গুড় ঢালতে হবে পুকুরে। স্বপ্ন নির্দেশ মোতাবেক কাজ করা হলো। সেই যে পুকুরে পানি এলো আর শুকালো না।
গ) আবার শোনা যায় পুকুরের তলদেশ থেকে এক সময় মিষ্টি পানি উঠতো তাই এর নাম গুড়পুকুর হয়েছে।
ঘ) আবার কারো মতে পুকুরের জায়গাতে অসংখ্য খেজুর গাছ ছিল এবং প্রচুর রস হতো ওই গাছে। একবার গাছের সমস্তরস দিয়ে গুড় তৈরি করে তা বিক্রি করা হলো এবং ওই বিক্রিত টাকা দিয়ে পুকুরটি কাটা হলো। তখন থেকে গুড়পুকুর।
ঙ) আবার পলাশপোল চৌধুরী পাড়ার রায় চৌধুরীরা গৌর বর্ণের ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাই তাদের পুকুরকে বলা হতো গৌরদের পুকুর। কালক্রমে হয়েছে গুড়পুকুর।
দুই.
সাতক্ষীরার এই গুড়পুকুরের মেলাকে ঘিরে প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শেষ দিনে পলাশপোল গুড়পুকুরের দক্ষিণ পাশে মনসা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মা মনসা হিন্দুধর্মের লৌকিক সর্পদেবী। মধ্যযুগের লোককাহিনী বিষয়ক মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র। আষাঢ় মাসের কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিকে বলা হয় নাগপঞ্চমী। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিতেও মনসাপূজার বিধান আছে। বর্ষাকালে সাপের উপদ্রুপ বেড়ে যায়, তাই সর্পদংশন প্রতিরোধ ও সাপের বিষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এ সময় তাঁর পূজা করা হয়। বাঙালি মেয়েরা শ্রাবণ মাসের নাগ পঞ্চমীর দিন উপবাস ব্রত করে সাপের গর্তে দুধ ঢালতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, প্রতিমায় মনসা পূজা করা হয় না। মনসা পূজিতা হন বিশেষভাবে সর্পচিত্রিত ঘট বা ঝাঁপিতে। যদিও কোথাও কোথাও মনসা মূর্তিরও পূজা হয়। বর্তমানে সর্বজনীনভাবে মনসাদেবীর মন্দিরে মনসাপূজা করা হয়। আবার পারিবারিক পর্যায়ে পারিবারিক মন্দিরেও মনসাদেবীর পূজা হয়। প্রধানত সর্পদংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে বা সর্পদংশনের প্রতিকার পেতে মনসার পূজা করা হয়।
এক সময় সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোলসহ বিভিন্ন এলাকা ঘনজঙ্গলে ঘেরা ছিল। এখানে ছিল বিষধর সাপের উপদ্রুপ। ধারণা করা হয় সে কারণে এখানে মনসা পূজার প্রচলন হয়।
তবে, গুড় পুকুরের মেলার উৎপত্তির মতো মেলা এলাকায় মনসা পূজার উৎপত্তি নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনী। সেই বাংলা ১২ শতকের কোনো এক সময় বুড়া খাঁর বংশধর ফাজেল খান চৌধুরী পলাশপোল এলাকায় খাজনা আদায় করে ফিরছিলেন। সেদিন ছিল ভাদ্র মাসের ৩১ তারিখ। ক্লান্ত ফাজেল খাঁ গুড়পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের বটের ছায়ায় বসেন এবং ঘুমিয়ে পড়েন। এ সময় বটের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের তীব্র রশ্মি এসে পড়ে ফাজেলের মুখে। তখন ঘুম ভেঙে যেতে লাগল এবং অস্বস্তিবোধ করলেন তিনি। মগডালে ছিল এক পদ্মগোখরো। সাপটি এই অবস্থা দেখে যে পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মি পড়ছিল ফাজেলের মুখে ঠিক সেখানে ফণা তুলে দাঁড়াল। সাপের ফণার ছায়া এসে পড়ল ফাজেলের মুখে। আরাম পেয়ে আবারো ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার পর আবার ঘুম ভেঙে গেল। এর মধ্যে ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়ে গেছে তার। বটের পাতায় পাতায় দৃষ্টি ঘোরাতে লাগল ফাজেল। হঠাৎ চোখে পড়ল সেই সাপটা। তখনও সে ফণা তুলে সূর্যকে আড়াল করে রেখেছে। এবার ফণাটা একটু দুলে উঠল। দুলে উঠল গাছের পাতারা। ফণা নামিয়ে সাপটা হারিয়ে গেল ডালে ডালে। আবার সূর্য রশ্মি এসে পড়ল ফাজেলের মুখে। তখন তার চোখে ঘুমের রেশ মাত্র নেই। শরীরে নেই একরত্তি ক্লান্তি। ফাজেল বটতলা ত্যাগ করল এবং এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ডেকে বলল, এখানে তোমরা মনসা পূজা করো।
সাতক্ষীরার জেলার ওয়েব পোর্টালে জেলার ঐতিহ্য হিসেবে সোবহান খান চৌধুরীর উদ্ধৃতি দিয়ে এ কাহিনী লেখা হয়েছে। তার এই বর্ণনা অনুযায়ী ১২ শতকের কোনো এক সময়ের এই কাহিনী অনুযায়ী গুড়পুকুর পাড়ে মনসা পূজার বর্তমান (১৪৩০ বঙ্গাব্দ) বয়স হয় দু’ শ’ বছরের কাছাকাছি। সেই পূজাকে ঘিরে এই মেলা শুরু হয়েছে হয়তো আরো পরে অথবা আগে মেলা পরে পূজা শুরু হয়েছে। তবে উক্ত কাহিনী অনুযায়ী বর্তমানে এই মেলার বয়স সর্বোচ্চ দু’ শ’ বছর।
তিন.
পলাশপোল এলাকার প্রবীন ব্যক্তিত্ব সাপ্তাহিক সূর্যের আলো সম্পাদক আব্দুল ওয়ারেশ খান চৌধুরী এই মেলা, পুকুর এবং মনসা পূজার উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করতে বেশ আগ্রহী মানুষ। তিনি বলেন, তৎকালীন বুড়ন পরগনার পলাশপোলসহ বেশ কয়েকটি মৌজা সাতক্ষীরার জমিদারদের অধীনে ছিল না। এসব মৌজার খাজনা আদায় করা হতো পলাশপোলের চৌধুরীপাড়ায়। এখানকার খাজনা আদায়ের কাছারিবাড়িতে বর্তমানে আমজাদ খান চৌধুরী ও শওকত খান চৌধুরীর পরিবার বসবাস করেন। আদায়কৃত খাজনা সরাসরি রাজার দরবারে জমা দেওয়া হতো। আউস ধান ওঠার সময় ভাদ্র মাস ছিল প্রজাদের খাজনা পরিশোধের নির্ধারিত শেষ সময়। হয়তো সেটা ভাদ্র মাসের শেষ তারিখ হতে পারে।
ওয়ারেশ খান চৌধুরী আরো বলেন, সাধারণ মুসলমানরা যেসব ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠান, প্রথা, রীতি বহু পূর্ব থেকে পালন করে আসছে সেগুলো চৌধুরীদের মধ্যে এসেছে অনেক পরে। কিছুদিন পূর্বেও চৌধুরীদের ছেলে মেয়েদের বিয়ে-শাদী নিজেদের বংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। চৌধুরীদের পুরাতন বাড়িগুলো হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিজাত পরিবারের বাড়ি ঘরের মতোই ছিল। ঘরের প্রশস্ত দেওয়ালে খাদ কেটে মূর্তি রাখার মতো ছোট ছোট ঘর রাখা হতো। সেগুলোর চারিপাশে আলপনা আঁকা হতো। ওয়ারেশ খান চৌধুরীর বর্ণনার সাথে বর্তমানেও পলাশপোল এলাকায় অনেক পরিবারের কিছু কিছু মিল পাওয়া যায়। পুরাতন বাড়ি-ঘরগুলোতে সেই অতীতের ছাপ পাওয়া যায়।
চার.
সাতক্ষীরার গুড়পুকুরে মেলা এক সময় এ অঞ্চলের ব্যবসা-বানিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সারাবছর ধরে নিয়মিত কাজের অবসরে সংশ্লি¬ষ্ট কাজের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা দা, কুড়াল, খুন্তা, কড়াই, কোদাল, ছুরি, চাকু, লাঙ্গল, ফলা, ধামা, কুলা, ঝুড়ি, খারা, চেয়ার, টিবিল, খাট, পালং, শোকেজ, আলমারি, দরজা, জানালা, মাটির তৈরী হাড়ি-পাতিল, কলসসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরী করে মজুদ করতো। সম্ভবত এদেশে নার্সারী শিল্পের গোড়াপত্তন হয় সাতক্ষীরা থেকে এবং তা আসে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। এক সময় এই এলাকায় গড়ে ওঠে বড় বড় নার্সারী। সে সময়ে এখানে মেলাকে সামনে রেখে লক্ষ লক্ষ গাছের চারা উৎপাদন করা হয়। সেই চারা বেচা-কেনা হতো গুড়পুকুরের মেলায়। আনুষ্ঠানিকভাবে মেলা শুরুর ১৫দিন থেকে একমাস আগে গাছের চারা নিয়ে অস্থায়ী দোকানগুলোর কার্যক্রম শুরু হয়ে যেত। সারাদেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ গাছের চারা কেনার জন্যেও এই মেলায় আসতেন।
এক সময় এই মেলা বৃক্ষমেলা হিসেবেও পরিচিতি পায়। গাছের চারা ছাড়াও হাজারো সামগ্রী তৈরী করে মজুত করা হতো সাতক্ষীরা খুলনা যশোরসহ বিভিন্ন এলাকা বাড়িতে বাড়িতে। রীতিমতো এসব তৈরীর সময়ও উৎসব চলতো। তারপর মেলার নির্ধারিত সময়ের পূর্ব থেকেই পশারীরা সাতক্ষীরা শহরে এসে বিভিন্ন এলাকায় বসে পড়তো। ভাদ্র মাসের শেষ দিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়া তিন দিনের এই মেলা চলতো আশ্বিন মাসব্যাপি। তারপর কর্তৃপক্ষ অস্থায়ী দোকানঘরগুলো ভেঙে না দেওয়া পর্যন্ত অনেকেই থেকে যেতেন আরো অনেক দিন।
সাতক্ষীরা খুলনা যশোরাঞ্চল নয় কোলকাতাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের আগমন ঘটতো এই মেলায়। ফলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই মেলা ছড়িয়ে পড়ে সাতক্ষীরা শহরব্যাপি। ১৯৮৪ খ্রি. জেলায় উন্নীত হওয়ার পূর্বে তৎকালীন সাতক্ষীরা মহাকুমার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই অনুন্নত। এ সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল মূলত নদী কেন্দ্রীক। খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ছাড়া অন্যান্য সামগ্রীর জন্য অপেক্ষা করতে হতো আশাশুনির বড়দলের সাপ্তাহিক হাট, দেবহাটার পারুলিয়া সাপ্তাহিক গরুহাট, শ্যামনগরের নওয়াবেকী সাপ্তাহিক হাটসহ হাতে গোনা কয়েকটি হাটের জন্য। সেখানেও অনেক কিছু পাওয়া যেত না। কালক্রমে গুড়পুকুরের মেলা হয়ে ওঠে সেইসব দুষ্প্রাপ্য সামগ্রীর বেচা- কেনার কেন্দ্রবিন্দু।
যদিও স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে এই মেলার কেন্দ্রস্থল সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশের বটতলাকে ঘিরে। মেলার পরিধি ছিল পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে বর্তমান জজকোট পর্যন্ত। এছাড়া বর্তমানের মতো সে সময় পলাশপোল গুড়পুকুর এলাকায় এত বাড়ি ঘর দোকানপাট ছিল না। এই এলাকা ঘিরে বসতো মূল মেলা। বর্তমানের পূজার স্থানটিতে থাকা বটগাছটির স্থানে বিশাল আকৃতির একটি বটগাছ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ১৯৭২-৭৩ সালে সেই গাছটি কেটে ফেলা হয়। বটগাছটি ছিল মনসা পূজার কেন্দ্রবিন্দু। এখানে থাকা পূজার পুরাতন থানটি পরবর্তীতে নতুন বটগাছটি ঘিরে সংস্কার করা হয়েছে।
মেলার পরিধি এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী গুড়পুকুরের মেলা সম্পর্কে ধারণার জন্য এই লেখকের পূর্বে প্রকাশিত একটি লেখা “সাতক্ষীরার গুড়পুকুরের মেলা: একাল সেকাল” পঞ্চম পরিচ্ছেদে যুক্ত করা হলো।
পাচ.
এক মেলায় লক্ষ্মীঘট কিনতাম, আর এক মেলায় তা ভেঙে যে টাকা হতো তাই দিয়ে খেলনা সামগ্রীসহ অন্যান্য জিনিষপত্র কিনতাম। তখন আমি স্কুলে পড়ি। বাড়ির সামনে হাট। প্রতিদিন বিকালে হাট বসতো। বাবা প্রতিদিন কোর্ট থেকে এসে ৫ পয়সা- আবার কোন কোন দিন ১০ পয়সা দিতেন। তখন ৫ পয়সায় একটা আইসক্রিম পাওয়া যেত। ঐ হাটে বিকালে সাধারণত যে আইসক্রিম পাওয়া যেত তা অনেকটা গলে যাওয়া। ফলে ৫ পয়সায় কখনো কখনো ২-৩টা আইসক্রিমও কিনতাম। মাঝে মধ্যে যে পয়সা বাঁচতো তা ফেলতাম লক্ষ্মীঘটে। এভাবেই সারা বছর পর ৪-৫ টাকা যা হতো তাই ছিলো আমার সম্বল। তা ছাড়া মেলা উপলক্ষেও বাবা চারআনা-আটআনা, মা আরো দু’এক টাকা ছাড়া আত্মীয়-স্বজন যারা মেলা দেখতে আমাদের বাড়ি এসে উঠতেন তাদের কাছ থেকেও পাওয়া যেত নগদ অর্থ ছাড়াও মেলার জিনিষপত্র। তারা সঙ্গে নিয়ে যেয়ে পছন্দমত জিনিষপত্র কিনে দিতেন।
আমাদের বাড়ি তখন কেবল একতলা হয়েছে। ৫টি ঘর এবং সামনে পিছনের বারান্দা ভরে যেত আত্মীয়-স্বজনে। বোন-বোনাইরা আসতেন। সাথে তাদের ননদ-দেবরসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন। আমাদের রাত কাটানোর জায়গা ছিলো ফাকা ছাদের উপর। যদিও মূল মেলার সময় আমরা রাত কাটাতাম সারারাত সিনেমা দেখে। বাড়িতে কখনো কখনো দাদী নানীরাও আসতেন। তাদের কাজ ছিলো রান্না ঘর সামলানো। প্রায় সারাটা দিনই তাদের কাটতো রান্না ঘরে।
সাধারণত মূল মেলার তিনদিন শহরের প্রায় সকল স্কুল ছুটি থাকতো। আমরা সকাল হলেই বেরিয়ে পড়তাম মেলা দেখতে। হাওয়াই মিঠাই খেয়ে মুখ লাল করে ঘুরে বেড়াতাম। কখনো রসমুন্ডা, বাতাশা, গজাসহ মিস্টি-মিঠাই কিনে বাড়ি ফিরতাম। আঁখ কিনে চিবুতে চিবুতেও ঘুরতাম বিভিন্নস্থানে। নাগরদোলায় চড়ার আনন্দটাই ছিল আলাদা। তারপর দু’আনা চারআনা দিয়ে প্রথম দিকে মাটির নৌকা, গাড়ি, মাথা কাপানো বুড়ো দাদাসহ বিভিন্ন পুতুল কিনে নৌকায় দড়ি বেঁধে পাকারাস্তা ধরে টানতে টানতে বাড়ি আসতাম। তারমধ্যে নৌকা বা গাড়ির চাকা শেষ। বুড়ু দাদার দাড়ি খুলে গেছে। তাই আরো পরের দিকে মাটির খেলনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে টিনের প্রতি আকর্ষণ শুরু হয়। পিস্তল কিনে কাগজে লাগানো বারুদের ব্যান্ডিল নিয়ে শুরু করতাম চোর-পুলিশ আর দারোগার খেলা। দু’একদিনের মধ্যে ভেঙে যেয়ে পিস্তলও শেষ। তাই আরো বেশি দামের ভালো টিনের খেলনা পিস্তল কিনতাম মেলার শেষের দিকে। শুনেছি মেলার শেষের দিকে দাম কমে যায়। তাই প্রতিদিন যেয়ে দাম শুনতাম, দাম কমেছে কি না? লঞ্চ কিনতাম। আর তার পলতেতে আগুন ধরিয়ে পানিতে ছেড়ে দিতাম। বড-বড করে চলতো কিছু সময়। তারপর পানি ঢুকে লঞ্চ শেষ।
গুড়পুকুরের মেলা ছিলো সাতক্ষীরাবাসির মিলনমেলা। হিন্দু মুসলিম সব সম্প্রদায়ের মানুষের এক হওয়ার মহা উৎসব। যে উৎসবের ঢেউ ছড়িয়ে পড়তো তৎকালীন সাতক্ষীরা মহাকুমার সকল এলাকায়। দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষের মধ্যে।
আমার বাবা সারা বছর ধরে এই মেলার জন্য অপেক্ষা করতেন ঘরের একটি দরজা অথবা জানালা বা চেয়ার-টেবিল কেনার জন্য। মা অপেক্ষা করতেন খুন্তা কড়াই দা বটি ধামা কুলা ঝুড়ি বা অন্য কোন জিনিষ কেনার জন্য। শহরের বাইরের মানুষেরও অপেক্ষা ছিলো এ মেলার জন্য। কৃষক তার চাষের জিনিষপত্র তথা লাঙ্গল ফলা ইত্যাদী কেনার জন্য অপেক্ষা করতেন। শ্রমিক তার নির্মাণ কাজের জন্য হাতুড়ি কড়াইসহ প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনতেন এই মেলা থেকে।
এতো গেল ক্রেতাদের কথা। কাঠ মিস্ত্রিরা সারা বছর ধরে তার কাজের ফাকে কাঠের জিনিষপত্র বানিয়ে নিজ বাড়ি ভরতেন। কুমাররা মাটির জিনিষপত্র বানিয়ে মজুদ করতেন। নার্সাারী ব্যবসায়ীরা সারা বছর ধরে চারা তৈরী করতেন। কামাররা বানাতেন লৌহজাত জিনিষপত্র। বিভিন্ন পেশার মানুষ সারা বছর ধরে গায়ে-গতরে খেটে এসব তৈরী করতেন মেলায় বিক্রি করে একসাথে অনেক টাকা উপার্জনের জন্য। প্রথমে দাম একটু বেশ হলেও পরে কম দামেই সব বিক্রি করে একসাথে অনেকগুলো নগদ টাকা নিয়ে তারা বাড়ি ফিরতেন। তাদের লোকসান হতো না। কারণ অবসর সময়েই কমদামে সংগ্রহ করা সামগ্রী দিয়েই এগুলো বানাতেন তারা।
শুনেছি সাতক্ষীরার প্রাণসায়রে লঞ্চ চলতো। তবে আমরা তা দেখেনি। আমরা দেখেছি সাতক্ষীরা বড়বাজারের কাছে প্রাণসায়র খালে একটা বড় দোতলা লঞ্চ বাঁধা ছিল বেশ কয়েক বছর। বর্তমান সাতক্ষীরা নাইট স্কুলটি তখন ছিল সাতক্ষীরার এসডিপিও’র অফিস। সামনে লেখা ছিল জ্ঞান মন্দির। তার সামনে থাকতো স্পীডবোর্ড বাঁধা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্পীড বোর্ড থাকতো বড়বাজারের দক্ষিণ পাশে খাদ্যগুদামের দক্ষিণ দিকে। আর স্টেডিয়ামের সামনে বর্তমান টেনিস গ্রাউন্ড ছিল তখন বিডিআর ক্যাম্প। ক্যাম্পের পাশে বাঁধা থাকতো বিডিআর ও এসডিও’র স্পিডবোর্ড। প্রাণসায়রের পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকা থেকে গার্লস স্কুলের কাঠের পুল পর্যন্ত থাকতো ছোট বড় শত শত গহনা ও টাবরু নৌকা। মেলার বিভিন্ন সামগ্রী আসতো ঐ সব নৌকায়। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ নৌকায় করে মেলায় এসে রাত কাটাতো সেখানে। রান্না-বান্না খাওয়া দাওয়া চলতো ঐসব নৌকায়।
শহরের সঙ্গীতা সিনেমা হলের উত্তর পাশের রাস্তার দু’ধারে সারিবদ্ধভাবে বসতো অসংখ্য নার্সারীর দোকান এবং তা বর্তমান নিউমার্কেট পর্যন্ত যেত। তার উত্তর পাশে প্রায় বর্তমান জজকোর্ট পর্যন্ত বসতো কাঠের ফার্নিচার, দা-বটি-খোন্তা-কোদাল-লাঙ্গলসহ বিভিন্ন লৌহজাত সামগ্রী। পলাশপোল স্কুলে বসতো বাশ বেতের বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান। আর সেই সাথে নাগরদোলা। পাশে গুড়পুকুর কান্দায় (পাড়ে) বসতো জিলাপি বাতাশাসহ হরেক রকমের মিষ্টি মিঠাইয়ের দোকান। পলাশপোল বর্তমান সেটেলমেন্ট অফিসের এলাকাটি (আমতলা নামে খ্যাত) ছিল সার্কাসের এলাকা। এখানে সার্কাস বসতো। তখন সাতক্ষীরা নিউমার্কেট নির্মিত হয়নি। ঐ স্থানে টিনের বেড়া দিয়ে উপরে চট টাঙিয়ে প্রোজেক্টর মেশিনের মাধ্যমে অস্থায়ী সিনেমা হল বসানো হতো।
লাবনী সিনেমা হলের সামনের রাস্তাটির দু’ধারে পাকাপুল পর্যন্ত বসতো হরেক রকমের খেলনা সামগ্রীসহ মনোহরি পন্যের দোকান। পাকাপুলের বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা সড়কে থাকতো কমদামী কাঠের চেয়ার টেবিল চৌকি দরজা জানালাসহ কাঠজাত সামগ্রীর দোকান। পাকাপুলের উত্তর পাশের পাওয়ার হাউজের পাচিলের পূর্ব পাশে বসতো আখ লেবুসহ বিভিন্ন ফলের দোকান। মাটির খেলনার দোকান বসতো এর আশে পাশের এলাকায়। ইলিশের দোকান বসতো ইটাগাছা হাটের সামনে। আর সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে কখনো কখনো বসতো যাত্রা-সার্কাস-পুতুলনাচের আসর। এ রকমই ছিল সাতক্ষীরার গুড়পুকুরের মেলার পরিধি। এক এক বছর এর কম বেশি হতো।
ভাদ্র মাসের ৩১ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে মেলা শুরু হওয়ার ১৫ দিন পূর্ব থেকে শুরু হতো দোকান পাট বানানোর কাজ। মূল মেলা ৩দিনের হলেও তা চলতো মাসব্যাপি। তারপর পুলিশ ভেঙে না দেওয়া পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা থেকে যেত। মূল মেলার তিনদিন সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়ক ছাড়া মেলা এলাকায় তেমন কোন যানবাহন চলতো না। চলার কথাও নয়। পাকাপুল থেকে লাবনী পর্যন্ত মানুষের ভীড় ঠেলে যাতায়াত করতে কখনো কখনো আধাঘন্টাও সময় লেগে যেত। দিনরাত ২৪ ঘন্টার শেষ রাতের কিছু সময় ছাড়া প্রায় সকল সময় মেলার দোকানপাট খোলা থাকতো।
মেলায় দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আগত হাজার হাজার মানুষের মধ্যে যাদের শহরে আত্মীয়স্বজন ছিল তারা তাদের বাড়িতে উঠতেন। দক্ষিণের মানুষের থাকা খাওয়া ছিল নৌকার মধ্যে। এছাড়াও আরো বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য তখনকার একমাত্র সিনেমা হল লাবনী, পরে সঙ্গীতা, নিউমার্কেটের অস্থায়ী সিনেমা হলে সারা রাত ব্যাপি এক টিকিটে ২-৩টি ছবি দেখার ব্যবস্থা করা হতো। এছাড়া যাত্রা চলতো সারারাত। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের রাত কাটানোর ব্যবস্থা হয়ে যেত এভাবেই। এরপরও পার্কে, পুরাতন বাসস্টান্ডে এবং বিভিন্ন বাসা বাড়ির সামনের বারান্দায়ও মানুষ রাত কাটাতো।
সাতক্ষীরার ঐতিহ্যের এই মেলা আশির দশকের শুরু দিক থেকেই তার জৌলুস হারাতে থাকে রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের চাঁদাবাজির কারণে। তারপরও শুরুটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় হলেও শেষটা হতো ভালোভাবেই। তবে শহরে একের পর এক বাড়ি ঘর দোকান পাট মার্কেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কারণে মেলার স্থান অনেকটা সংকীর্ণ হতে শুরু করলেও মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা কমেনি। মেলার ধারাবাহিকতা ছিল ঠিকই। কিন্তু ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মেলা উপলক্ষে সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে বসা সার্কাস প্যান্ডেল এবং শহরের রকসি সিনেমা হলে বোমা হামলায় ৩জন নিহত এবং অর্ধ শতাধিক আহতের ঘটনার পর এই মেলা তার জৌলুস হারায়। কয়েক বছর বন্ধ থাকে। এরই মধ্যে অল্প সময়ে চিরচেনা সেই সাতক্ষীরা শহরের চেহারা সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যায়। পূর্বে সেই মেলার স্থানগুলো এখন বাড়ি ঘর দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ হয়ে গেছ�