দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর মামলাতেও বদলে যায় কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ভাগ্য। যেখানে তদন্তে প্রমাণিত হলে চলে যাবে চাকরি, সেখানে হয়েছে পুরো উল্টো। এমনি অনিয়ম ও দুর্নীতির নজিরবিহীন ইতিহাস স্থাপন করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)-তে। ১ কোটি ৬৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা পে-অর্ডাররে মাধ্যমে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে দুদকের করা মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে ৩ ধাপের পদোন্নতি বাগিয়েছেন এই দপ্তরেরই ৪ কর্মকর্তা। মামলার আসামিরা হলেন- সংস্থাটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফরহাদ উজ্জামান, নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক, নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম ও নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিএর আরিচা-রাজশাহী গোদাগাড়ী-ভোলাহাট নদীপথ খনন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেসিক ড্রেজিং কোম্পানির কাছ থেকে এই কর্মকর্তা নিজেদের এবং স্ত্রী ও শাশুড়ির ব্যাংক হিসাবে পে-অর্ডাররে মাধ্যমে মোট এক কোটি ২৯ লাখ ৫ হাজার ৯৩৯ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন। এ ঘটনায় অভিযোগপ্রাপ্ত হয়ে প্রাথমিক তদন্ত শেষে দুর্নীতি দমন কমিশনের আদেশক্রমে অভিযুক্তদের নামে ২০১৮ সালের জুন মাসের ৪ তারিখে মতিঝিল থানায় বিআইডব্লিউটিএ’র বেসিক ড্রেজিং কোম্পানির অর্থ ও হিসাব শাখার সচিব কাম সহকারী মহাব্যবস্থাপক গাজী মো. জাহাঙ্গীর হোসেন দন্ডবিধির ১৬১/১৬৫ (ক) ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলা দায়ে করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দীর্ঘ ১২ বছর তদন্ত করে ওই কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীসহ অপরাধে সংশ্লিষ্ট আত্মীয়দের নামে ২০১৯ সালে জুলাই মাসের ২৩ তারিখে আদালতে চার্জশীট দাখিল করে। তবে এরই ফাঁকে অর্থাৎ ২০১৫ সালে পদোন্নতি বাগিয়ে নেয় এই ৪ কর্মকর্তা। প্রকৃত তথ্য গোপন করে পদোন্নতি দেয়া বা নেয়া উভয়ই অপরাধ। কারণ সরকারী কর্মচারী কর্মকর্তাদের নামে অভিযোগ থাকলে বা মামলা হলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে রাখেন। এ সময় ওই কর্মকর্তা বেতন ভাতাসহ খোরপোষ প্রাপ্ত হলেও পদোন্নতিসহ অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্তিতে নিষিদ্ধ থাকেন। কিন্তু অভিযুক্তরা তথ্য গোপন করে দুদকের মামলা চলাকালীন সময়ে ৩ দফায় উচ্চতর পদোন্নতি নিয়েছেন। অভিযুক্ত এ এইচ এম ফরহাদ উজ্জামান নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে ৩ ধাপে পদোন্নতি নিয়ে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে দায়িত্ব পালন করছেন। আবু বক্কর সিদ্দিক উপ-সহকারী প্রকৌশলী হতে দুই দফা পদোন্নতি নিয়ে বর্তমানে তিনি নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে বরিশাল-চট্টগ্রাম বিভাগে ডেজিং কাজে কর্মরত রয়েছেন।
এছাড়াও অভিযুক্ত মো. জহিরুল ইসলাম দুর্নীতি মামলার তথ্য গোপন করে উপ-সহকারী প্রকৌশলী হতে দুইদফা পদোন্নতি নিয়ে বর্তমানে তিনি নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে আরিচা ডিভিশনে প্রকৌশল বিভাগে কর্মরত। তবে এসব কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক কাজী ওয়াকিল নেওয়াজ ও পদোন্নতি কমিটির সদস্যরা কোটি টাকা উৎকোচ হাতিয়ে নিয়েছে বলে জোর গুণজন শোনা যাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্থাটিতে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা ভোরের পাতার এই প্রতিবেদককে জানান, এখানে আসলে প্রকৃত যারা কাজ করে তারা অনেই পদোন্নতি পায় না। তাদের পিছনে লাগিয়ে দেওয়া হয় কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের। কি বলবো বলেন, কেউ এক টেবিলেই ১ যুগ পার করছে আবার কেউ বছর যেতে না যেতেই হচ্ছেন বদলি। ঠিক তেমনি একটি বিষয় বলতে চাই- কথায় আছে টাকা হলে নাকি বাঘের চোখও মেলে। আর বিআইডব্লিউটিএ এর বাহিরে না। এখানে ক্ষমতা আর টাকা থাকলে সব কিছুই সম্ভব। ১৫ বছরের বেশি হয়েছে এই সংস্থাটিতে কাজ করছি। অনেক কিছুই দেখেছি। আসলে আমাদের বলার মত কোন ভাষা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএতে ড্রেজিং বিভাগে কর্মরত এ প্রতিবেদককে বলেন, এখানে ক্ষমতাই সবকিছু টাকা দিলে সব মেনেজ। প্রতিষ্ঠানটিতে যেমন ভালো কাজ হচ্ছে তেমনি কিছু অসাধু কর্মকর্তার জন্য প্রতিষ্ঠানটির বদনাম হচ্ছে। আসলে তাদের কিছু করতে পারছেন না কেন? কারণ তারা অফিসার এসোসিয়েশন রাজনীতি করেন। তাদের খুটির জোর অনেক।
এই বিষয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘কি বলবো বলেন, কিছুদিন পরপরই বিআইডব্লিউটিএ বিভিন্ন কর্মকর্তার নামে মামলা হয়। আবার কিছুদিন না যেতেই আবার তা শেষ হয়ে যায়। তার মানে তারা অপরাধী না। চাকরি করি তো তাই অনেক কিছুই বলতে পারি না। তবে এটা সত্যিই দুঃখজনক মামলা থাকার পরও পদোন্নতি কিভাবে সম্ভব?
এই বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের পাতাকে বলেন, ‘আমাদের ভেতরে যখন ক্ষমতার অপব্যবহারের চিন্তা থাকে তখনই দুর্নীতি হয়। আর দুর্নীতিকে রোধ করতে নিজেদের মনোভাবকে পরিবর্তন করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। না হলে দুর্নীতি বন্ধ হবে না। মনে রাখতে হবে ক্ষমতা চিরস্থায়ী না। আইন সবার জন্য সমান।’
এই বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা ভোরের পাতাকে বলেন, ‘আমি গত কয়েক মাস হয়েছে বিআইডব্লিউটিএতে এসেছি। তারপরও আমার জানা মতে কারো বিরুদ্ধে মামলা নেই। যদি অতিতের কারো থেকে থাকে খোঁজ নিতে হবে। পদোন্নতি বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারো বিরুদ্ধে মামলা থাকা অবস্থায় পদোন্নতি নিতে পারে না। আমি যেহেতু এসেছি বিষয়টি যদি চলমান থাকে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তাছাড়া মামলা যেহেতু দুদক করেছেন তারা বিষয়টি অবশ্যই তদন্ত করছেন। আমি সংস্থার প্রধান হিসেবে তাদেরকেও সহযোগিতা করবো।’
এই বিষয়ে অভিযুক্ত বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) এ. এইচ. এম ফরহাদউজ্জামান ভোরের পাতাকে বলেন, এই বিষয়ে হাইকোর্ট একটি রায় দিয়েছেন আমাদের পক্ষে। আমরা অপরাধী না। তাছাড়া আমাদের পদোন্নতি দুদকের তদন্তের আগেই হয়েছে বলে দাবী করেন।