নোবেল প্রাইজের জন্ম ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে। সেই থেকে এ যাবৎকালে পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে সংঘটিত হয়েছে, বহু কাঙ্ক্ষিত অনাকাঙ্ক্ষিত হরেক রকমের চমকপ্রদ ঘটনা। নোবেল প্রাইজ প্রত্যাখ্যানকারীদের কথা শোনা যাক। লেখক-সাহিত্যিক জাঁ-পল সার্ত্র। তিনি ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন। কিন্তু তা প্রত্যাখান করতে গিয়ে যে দু-চারটি বাক্য খরচ করেন, তাতেই উপলব্ধি করা যায়, তাঁর ব্যক্তিত্বের আকাশচুম্বী গভীরতা। জাঁ-পল সার্ত্র বলেন, ‘লেখকরা সমগ্র পৃথিবীর, তাঁদের কোনো প্রতিষ্ঠানের হওয়া উচিত নয়।’
১৯৭৩ সালে শান্তিতে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন ভিয়েতনামী রাজনীতিক দিউথো। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন নীতি-নৈতিকতার বিরল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরতি স্থাপনের জন্যে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল যৌথভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ও ভিয়েতনামী দিউথোকে।
কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তখনও শান্তি স্থাপিত হয়নি। এই কারণে থো নোবেল শান্তি প্রাইজ প্রত্যাখ্যান করেন।
নোবেল প্রাইজ পেয়েও যাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হন, সেই তাঁদের কথা শোনা যাক। সংখ্যায় তাঁরা চারজন। এদের তিনজনই জার্মানির। জার্মান শাসক এডলফ হিটলার তাঁদের নোবেল প্রাইজ গ্রহণ করতে দেননি। এঁরা হলেন, অ্যাডলফ বাটেননানডট, গারহার্ড ডোমাগক ও
বরিস পাস্তারনাক। প্রথম তিনজন নোবেল প্রাইজ গ্রহণ করতে পারেননি, অ্যাডলফ হিটলারের কারণে। শেষোক্ত জন সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের কারণে। জার্মান রসায়নবিদ অ্যাডল্ফ বাটেননানডট নোবেল প্রাইজে ভূষিত হয়েছিলেন, সেক্স হরমোন নিয়ে গবেষণার জন্য। আরেক জার্মান রসায়নবিদ রিচার্ড কাহন নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন ভিটামিন নিয়ে কাজ করার জন্যে। প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারক হিসেবে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন জার্মান নাগরিক গারহার্ড ডোমাগক। এসবই ঘটেছিলো চল্লিশ দশকে অর্থাৎ হিটলারের রাজত্বকালে। অপরদিকে ১৯৫৮ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন রাশিয়ান লেখক বরিস পাস্তারনাক। তিনি নোবেল প্রাইজ গ্রহণ করলেও সোভিয়েত সরকারের চাপে তা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন।
সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় নোবেল শান্তি প্রাইজকে। রাজনৈতিক প্রকৃতির কারণে এই প্রাইজটি অন্য পাঁচটি প্রাইজের চেয়ে অনেক বেশি বিতর্ক তৈরি করেছে।
এই বিতর্কিত শান্তিতে নোবেল প্রাইজে ভূষিত ব্যক্তিদের বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনুসও রয়েছেন।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেল শান্তি প্রাইজে ভূষিত হন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধকালীন যার ভূমিকা বিশ্বময় বিতর্কিত। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যাকে সমর্থন করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ক্ষিপ্র হয়ে ওঠার মূলে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার। তিনি ত্রিশ লাখ বাঙালি হত্যার পরও পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন সপ্তম নৌবহর পাঠানোর নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে যখন শান্তিতে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন, তখননও তিনি কম্বোডিয়ায় বোমা বর্ষণ, দক্ষিণ আমেরিকায় সামরিক শাসনকে সমর্থন করছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারের নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন নোবেল কমিটির দু-জন সদস্য। নিউইয়র্ক টাইমস পুরস্কারটিকে আখ্যায়িত করে ‘নোবেল ওয়ার প্রাইজ’ হিসেবে।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পান অং সান সূচি। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে পার্লামেন্ট কক্ষেআততায়ীর হাতে নিহত তাঁর পিতা অং সান। মিয়ানমারের জাতির পিতা অং সানের কন্যা হিসেবে তিনি পরিচিত। শান্তিতে সূচির এ নোবেল প্রাইজ মূলত, নিজ দেশ মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের জন্য। কিন্তু সূচি মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ঘটলো রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যা। রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন এতোটাই হয় যে, রাখাইনের ঘটনাকে জাতিসংঘ গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ওয়াঙ্গারি মাথাই। প্রয়াত এই কেনিয়ান পরিবেশবাদী প্রথম আফ্রিকান নারী। ২০০৪ সালে নোবেল প্রাইজলাভ করেন। কিন্তু তার প্রাইজ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ওঠে। যখন এইচআইভি ও এইডস নিয়ে তার একটি মন্তব্য সামনে চলে আসে। ওয়াঙ্গারি মাথাই বলেছিলেন, এইচআইভি ভাইরাস জীবাণু অস্ত্র হিসেবে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের শেষ করা।
১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পান ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত। একইসাথে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন প্যারেজকেও নোবেল শান্তি প্রাইজে ভূষিত হন। সেনিয়ে তখন তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মূলত, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব অবসানে 'অসলো শান্তি চুক্তি'র জন্য তাদের যৌথভাবে এ নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়েছিল। তাঁদের মনোনয়ন নিয়ে নোবেল কমিটিই বিভক্ত হয়ে পড়ে। তারপরও নোবেল প্রাইজ দেয়া হলে প্রতিবাদে নোবেল কমিটির একজন সদস্য পদত্যাগ করেন।
২০০৯ সালে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয় বারাক ওবামাকে। এ প্রাইজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মাত্র নয় মাসের মাথায়। সমালোচকরা এ প্রাইজ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে 'অপরিপক্ক' বলে তিরস্কার করেন। কারণ বারক ওবামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার ১২ দিনের মধ্যেই পুরস্কারের জন্য নাম জমা দেয়ার সময় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। নোবেল কমিটির পরিচালক গের লান্ডেটস্ট্যাড বিবিসিকে তখন বলেছিলেন, যে কমিটি ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বারাক ওবামা সয়ং নোবেল প্রাইজের খবরে আকাশ থেকে পড়েন। তিনি নিজের স্মৃতিকথায় ওই ঘোষণার প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিখেছেন "কিসের জন্য?" লক্ষনীয় বারাক ওবামার দুই মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধরত ছিল।
২০২০ সালে শান্তিতে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। ইরিত্রিয়ার সাথে দীর্ঘ দিনের সীমান্ত সংঘাত নিরসনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই এ পুরস্কারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। কারণ নিজে দেশের টাইগ্রের উত্তরাঞ্চলে সেনা মোতায়েন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়েন। সেখানে লড়াইয়ে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়। যাকে জাতিসংঘ একে 'হৃদয় বিদারক বিপর্যয়' হিসেবে আখ্যায়িত করে। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে শান্তিতে নোবেল প্রাইজে ভূষিত বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনুস। অর্থনীতিতে নোবেল না পেয়ে শান্তিতে কেনো নোবেল প্রাইজ, সে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তিনি এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে এ প্রাইজ লাভ করেন। গ্রামীণ ব্যাংকের অমানবিক কর্মকাণ্ড নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। ভুক্তভোগীদের চোখে গ্রামীণ ব্যাংক শোষণের হাতিয়ার আর শোষক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। বহু মানুষ আর্থিকভাবে নিঃস্ব রিক্ত হয়েগেছে এই গ্রামীণ অর্থনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে। ড. ইউনুস স্বদেশে বিতর্কিত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন তিনি। মহামান্য রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমতি না নিয়ে নোবেল প্রাইজ গ্রহণ করায়। ৩০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদন ব্যতীত কোনো নাগরিক কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নিকট হইতে কোনো উপাধি, সম্মান, পুরস্কার বা ভূষণ গ্রহণ করিবেন না।’
২০০৬ খ্রিস্টাব্দে যৌথভাবে ড. ইউনুস ও তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক শান্তিতে নোবেল প্রাইজে মনোনীত বা নির্বাচিত হওয়ার আগে পরে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের কোনো অনুমতি বা অনুমোদন নেননি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় রাষ্ট্র হচ্ছে, সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারি, আধা সরকারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামরিক বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ব্যাংক, বীমাসহ সকল সায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে বুঝায়। নোবেল প্রাইজ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটি নরওয়ে ও সুইডেনের সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সেদেশের ব্যাংকিং খাত থেকে আসা সুদ বা লাভাংশ থেকেই নোবেল প্রাইজের আর্থিক ব্যয়নির্বাহ করা হয়। এছাড়াও আজ অবধি ড. ইউনুস বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অপর্ণ না করে সাংস্কৃতিক প্রথাও ভঙ্গ করেন। বারবার মনোনীত হয়েও নোবেল প্রাইজ পাননি অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি। সেই না পাওয়াদের মধ্যে অন্যতম মহাত্মা গান্ধী ও টলস্টয়। টলস্টয় জীবনকালে অত্যধিক জনপ্রিয় ও মেধাবী ছিলেন। লেভ নিকোলায়েভিচ টলস্টয় ১৯০২ থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত প্রতিবারই সাহিত্যে নোবেল প্রাইজের জন্য এবং ১৯১০ সালে শান্তিতে নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু একবারও নোবেল পাননি। যা নোবেল ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা। রাশিয়ান সাহিত্যের যুগশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হচ্ছেন টলস্টয়, পুশকিন ও গোর্কি। ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন, ‘টলস্টয় নিজেই একটি পৃথিবী।’
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপ ভ্রমণকালে ভিক্টর হুগোর সঙ্গে টলস্টয়ের পরিচয়। হুগোর ‘লা মিজারেবল’ তার জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। যার প্রতিফলন ঘটে টলস্টয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’ উপন্যাসে। এই উপন্যাস লেখেন নেপোলিয়নের রুশ আক্রমণের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে, যেখানে তিনি তার যুদ্ধ ও শান্তি সম্পর্কে মতামত দিয়েছেন।
টলস্টয়ের একটি উপন্যাসের নাম ‘সাড়ে তিন হাত জমি’ হাজারটা উপন্যাসের সমান। ১৩ সন্তানের জনক টলস্টয়ের ‘আন্না কারেনিনা’ তাঁর জীবন অবলম্বনে লেখা অপূর্ব এক সৃষ্টি। টলস্টয় সাহিত্যিক কেবল নন, দার্শনিকও ছিলেন। তাঁর দর্শন ছিল চার্চের বিরুদ্ধে আসল ধর্মচর্চা করা এবং অভিজাততন্ত্রকে বর্জন করা। বিখ্যাত অক্টোবর বিপ্লবের আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। একটি মৃত্যুদন্ড স্বচক্ষে দেখে টলস্টয় বলেন, ‘সত্যি কথা হলো রাষ্ট্র একটি ষড়যন্ত্র যা শুধু শোষণের জন্যই তৈরি হয়েছে।’ ‘দ্য মিডিয়েটর’ ‘চাইল্ডহুড’ ‘বয়হুড’ ও ‘ইয়ুথ’ টলস্টয়ের অনবদ্য রচনা।
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি হত্যা করা হয় ভারত জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে। অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধীকে। এর মাত্র দুইদিন পরই ছিল সে বছরের নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন জমাদানের শেষ তারিখ। সেবার নোবেল কমিটি গান্ধীজিকে মনোনীত করা ছয়টি চিঠি পায়, যার মধ্যে ছিল প্রাক্তন নোবেল লরেট দ্য কোয়েকার্স এবং এমিলি গ্রিন বলচের চিঠিও।
ইতঃপূর্বে নোবেল শান্তি প্রাইজ মরণোত্তর কাউকে দেয়া হয়নি। কিন্তু নোবেল ফাউন্ডেশনের তৎকালীন সংবিধি মোতাবেক, কয়েকটি শর্ত মেনে মরণোত্তর শান্তিতে নোবেল দেয়া যেত। ফলে গান্ধীজিকে নোবেল দেয়ারও রাস্তা খোলা ছিল। কিন্তু তারপরও, নোবেল কমিটি সে বছর গান্ধীজিকে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ দেয়নি। এর পেছনে কারণ হিসেবে তারা বলে, গান্ধীজি কোনো সংগঠনের অংশীদার ছিলেন না, তিনি কোনো সম্পদ রেখে যাননি, কোনো উইলও করে যাননি, ফলে তার পুরস্কার গ্রহণ করার মতো কী নেই। এ কারণে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি শেষ পর্যন্ত একটি চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর তারা জানায়, ‘কোনো যোগ্য জীবিত প্রার্থী না থাকায় এ বছর কাউকে পুরস্কারটি প্রদান করা হবে না।’
নোবেল কমিটির সেক্রেটারি লিন্ডস্ট্যাড আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ‘নোবেল প্রাইজ ছাড়াও চলে যায় গান্ধীজির। তবে গান্ধীজিকে ছাড়া নোবেল কমিটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।’
নরওয়েজিন নোবেল কমিটির সেক্রেটারি লিন্ডস্ট্যাডের মতে, ‘১০৬ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাদ পড়াটা (গ্রেটেস্ট অমিশন) হল নিঃসন্দেহে মহাত্মা গান্ধীর কখনও নোবেল প্রাইজ না-পাওয়া।’ পাঁচবার নোবেল প্রাইজের জন্য শর্টলিস্টেড হন গান্ধীজি। ১৯৪৬, ১৯৪৭, ১৯৪৮ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দু বার। শতাব্দী ধরে নোবেল কমিটি যে ঘরে বসে প্রাইজপ্রাপকদের নাম নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছিলেন, সেই ঘরে বসেই লিন্ডস্ট্যাড জানান, ‘তবে এটা ঐতিহাসিক একটা সত্যি হয়ে থেকে গিয়েছে যে গান্ধী কখনও নোবেল পুরস্কার পাননি।’ তাঁর মতে, এই সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ ছিল নোবেল কমিটির সদস্যদের ইউরোপ-কেন্দ্রিক মনোভাব। গান্ধীজির স্বাধীনতা সংগ্রামকে ছোট করে দেখিয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নোবেল কমিটির সদস্যরা। গান্ধীজির ‘সঙ্গতিহীন শান্তিবাদ’-এরও বিরোধিতা করেন তাঁরা। বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীজির গুরুত্বপূ্র্ণ ভূমিকা থাকলেও তাঁর সমালোচকের সংখ্যাও কম নয়। লিন্ডস্ট্যাডের মতে, ১৯৪৮ সালে গান্ধীজিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হবে, এটা একরকম ঠিকই হয়ে গিয়েছিল। তবে তার কিছুদিনের মধ্যেই চরমপন্থি মুসলিম বিদ্বেষী নাথুরাম গডসে তাঁকে হত্যা করে।
মহাত্মা গান্ধীর নোবেল পুরস্কার না জেতার কারণ সম্পর্কে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির দৃষ্টিভঙ্গি বুঝি খুবই সংকীর্ণ ছিল? কমিটির সদস্যরা কি স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে নন-ইউরোপিয়ানদের সংগ্রামকে স্বীকৃতি প্রদানে নারাজ ছিলেন? নাকি তারা নিছকই ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলেন যে মহাত্মা গান্ধীর হাতে প্রাইজ তুলে দিলে গ্রেট ব্রিটেনের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর যা-ই হোক, এ ব্যাপারে অনেকের মনেই কোনো সন্দেহ নেই যে মহাত্মা গান্ধীই হলেন ‘যোগ্য দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও শান্তিতে নোবেল না জেতার’ সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তাই তো ১৯৮৯ সালে যখন দালাই লামাকে শান্তিতে নোবেল দেয়া হয়, তিনি ঘোষণা দেন যে গান্ধীজির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবেই তিনি পুরস্কারটি গ্রহণ করছেন। ২০০৬ সালে, গান্ধীজির মৃত্যুর অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় পরে, নোবেল কমিটি জনসম্মুখে স্বীকার করে নেয়, মহাত্মা গান্ধীকে পুরস্কৃত না করা ছিল তাদের মস্ত বড় একটি ভুল।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।