বালুকাময় নদীতীরে দাঁড়িয়ে সমুদ্র সৈকতের আবহ, তপ্ত দুপুরে খোলা আকাশের নিচে নদীতে সূর্যের ঝলকানি, আর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অপূর্ব সুযোগ- এসবই উপভোগ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার মোহনপুর পর্যটনকেন্দ্রে। এ যেন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের একখ- প্রতিচ্ছবি। চাঁদুপর জেলার মতলব উত্তর উপজেলায় মেঘনা নদীতীরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের আদলে গড়ে উঠা এ পর্যটনকেন্দ্রে প্রতিদিনই ভিড় করছেন ভ্রমণপিয়াসী হাজারো দর্শনার্থী। মোহনপুর ইউনিয়নের লঞ্চঘাট এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত মিঠাপানির এ সৈকত এরই মধ্যে 'মিনি কক্সবাজার' হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত হয়েছে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং বিশেষ দিনগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড়ে সরগরম থাকে গোটা এলাকা। সব বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরদের আনাগোনায় তৈরি হয় প্রাণের উচ্ছ্বাস। দর্শনার্থীদের কেউ কেউ বালুময় মেঘনার তীরে শরীর গড়াগড়ি দিচ্ছেন। কেউবা নদীতে নেমে জলকেলি করছেন। সেলফি তুলেও সময় কাটাচ্ছেন অনেকে। পার্কে দোলনায় মনের আনন্দে দোল খাচ্ছে শিশুরা। রাইডে উঠেও হইহুল্লোড় করছে তারা। কেউবা আবার বিনোদন কেন্দ্রের পাশে গড়ে উঠা মার্কেটে কেনাকাটায় ব্যস্ত। বিনোদনের এ অনিন্দ্যসুন্দর কেন্দ্রটিতে এসে ক্লান্ত-শ্রান্ত পর্যটকরা যেন খুঁজছেন একটু স্বস্তি ও নির্মল আনন্দ।
ভ্রমণপিপাসুদের জন্য পর্যটনকেন্দ্রের মূল ফটকে রয়েছে ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর লেখা- বৃহদাকারের ইলিশের প্রতিচ্ছবি। নদীতীরের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় শতাধিক বিচ বেড বসানো হয়েছে। রয়েছে খোলা মাঠ ও বালু প্রান্তর। মাঠের পাশে রয়েছে চটপটি-ফুচকা, আচার, চকলেট, চা ও মুড়ি বিক্রেতার ছোট-বড় দোকান। নদীতে নৌকা ভ্রমণ, রিভার ড্রাইভ স্পিডবোট, সুইমিংপুলসহ খেলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাঁচ হাজার আসনের উন্মুক্ত মঞ্চ। কেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য রয়েছে সুন্দর রাস্তা, দু'পাশে ও মাঝখানে ফুলের বাগান। এছাড়া শিশু-কিশোরদের জন্য বিভিন্ন রাইড সম্বলিত মিনি থিম পার্ক, মিনি চিড়িয়াখানা, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য হাঁটা ও বসার ব্যবস্থা এবং পুরো এলাকাজুড়ে রয়েছে রকমারি গাছপালা ও বনবনানী। পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার সুবিধার্থে এখানে 'দ্যা শিপ ইন' নামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্ট ও পাঁচটি ফাইভ স্টার মানের কটেজ রয়েছে। রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে ৫০০ থেকে ৬০০ পর্যটক বসে বুফে এবং বারবিকিউ আইটেমের খাবার খেতে পারবেন। রেস্টুরেন্টের মেন্যুতে বাংলা, চায়নিজ, ভারতীয়, ইউরোপীয় ও কন্টিনেন্টাল প্রায় সব ধরনের খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। সন্ধ্যার পর পুরো এলাকায় রয়েছে সুদৃশ্য আলোর ব্যবস্থা। পর্যটনকেন্দ্রের ভেতরে রয়েছে অত্যাধুনিক মার্কেট, ওয়াচ টাওয়ার ও দূরপাল্লার লঞ্চের জন্য পন্টুনের ব্যবস্থা। এখানে ড্রোন উড়ানোর ব্যবস্থাও আছে।
সম্প্রতি মোহনপুর পর্যটনকেন্দ্রে পরিবার নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন সাংবাদিক এস.কে মাসুদ রানা। তিনি তার এক সহকর্মীর মাধ্যমে পর্যটনকেন্দ্রটির খবর পান। জানান, স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে মোহনপুরে গিয়ে কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ তাদের বেশ ভালো লেগেছে। বিশেষ করে নদীর তীরে বসার সুব্যবস্থা, কক্সবাজারের মতোই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ। কটেজের সঙ্গেই রয়েছে সুইমিংপুল। শিপ ইন রেস্টুরেন্টর পরিবেশটাও বেশ গোছালো, বসার ও খাবারের ব্যবস্থাপনাও ভালো। এছাড়া নদীতে স্পিডবোটে ঘোরার ব্যবস্থা, কেন্দ্রের ভেতরে বাচ্চাদের জন্য বিনোদন কর্নার, সৌদি আরবের খেজুর বাগান ও বাহারি ফুলের বাগান তাদের খুব ভালো লেগেছে। বাচ্চারাও খুব এনজয় করেছে। এছাড়া ব্যবস্থাপনার মান অনুযায়ী খরচটাও মধ্যবিত্তের আওতার মধ্যে।
পর্যটনকেন্দ্রের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরের বাম পাশেই রয়েছে টিকিট কাউন্টার। জনপ্রতি প্রবেশ ফি ১০০ টাকা। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে কেন্দ্রের ভেতর প্রবেশ এবং বের হওয়ার জন্য রয়েছে আলাদা গেটের ব্যবস্থা। নদীর পাড়ঘেঁষে ছাতা চেয়ারের জন্যও রয়েছে টিকিট। ২ জন একসঙ্গে বা ১ জনের জন্য প্রতি ছাতা চেয়ারের ভাড়া ঘণ্টাপ্রতি ৩০ টাকা। অনেকটা কক্সবাজারের মতোই। কার পার্কিংয়ের জন্য কেন্দ্রের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে রয়েছে বিশাল জায়গা। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ফি আগে জমা দিয়ে একটি টোকেন নিতে হবে। আবার চলে যাওবার সময় সেই টোকেন দেখিয়েই গাড়ি নিতে হবে। এখানে টোকেন ফি আগেই দিতে হয়।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. মিজানুর রহমান জানান, প্রায় ১৫ বছর আগে মেঘনা নদীকে ঘিরে এ পর্যটনকেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা করি। প্রায় ৬০ একর জমির ওপর ২০২০ সালে পর্যটনকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়। তিনি জানান, প্রথম দিকে চাঁদপুর ও আশপাশের জেলার ভ্রমণপিপাসু লোকজনের বিনোদনের কথা ভেবে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের আদলে এটি তৈরি করা হয়। মেঘনার পাড়ে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ এ বিনোদনকেন্দ্রের সৈকতে উন্নতমানের কৃত্রিম বালু বসানো হয়েছে। পরে এটিকে পরিণত করা হয় মাল্টিপল পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে। এখানে রয়েছে সার্বক্ষণিক তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কম খরচে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দিনে এসে দিনেই ফিরে যেতে পারছেন পর্যটকরা। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে টা পর্যন্ত খোলা থাকে পর্যটককেন্দ্রটি।