আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের মধ্যে বিরোধ ও গ্রুপিং ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিলেও উল্টোপথেই হাঁটছে সিলেট আওয়ামী লীগ। সেখানে আওয়ামী লীগ বর্তমানে দুটি বলয়ে বিভক্ত। একটি ‘প্রবাসী’, আরেকটি ‘স্থানীয়’। জাতীয় নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, বলয়ভিত্তিক নেতাদের বিরোধ ততই প্রকাশ্যে আসছে। সম্প্রতি রেজিস্টারি মাঠে এক সমাবেশে সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) হাবিবুর রহমান হাবিব ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। ছাত্র-যুবলীগের জেলা ও মহানগরের কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের বাদ দিয়ে করা হয়। সর্বশেষ জেলা ও মহানগর যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ‘প্রবাসী’বলয়ের নেতা আনোয়ারুজ্জামানের অনুসারীরাই বেশি পদ পেয়েছেন। এসব বিষয়কে দুই বলয়ের প্রভাবের রাজনীতির অংশ হিসেবে দেখছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
তৃণমূলের কয়েকজন নেতা-কর্মী জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের এমপি এ কে আব্দুল মোমেন, সিলেট-৩ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান হাবিব ও সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষে দেশে এসেই দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। এ নিয়ে অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ভেতরে-ভেতরে ক্ষুব্ধ। বিষয়টি স্থানীয় অন্য নেতা-কর্মীদেরও ভাবিয়ে তোলে। এতেই দুটি বলয়ে বিভক্ত হয় সিলেট আওয়ামী লীগ।
বর্তমানে একটি বলয়ের নেতৃত্বে আছেন জেলা ও মহানগরের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। অপরটিতে আছেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও সিলেট-৩ আসনের এমপি হাবিব। আনোয়ার-হাবিবের সঙ্গে রয়েছেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (ময়মনসিংহ বিভাগ) শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল।
দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচন ও সিটি নির্বাচনে বিরোধী হেভিওয়েট কোনো প্রার্থী না থাকায় সহজেই জয় পায় ক্ষমতাসীনেরা। অন্তঃন্দলে জর্জরিত সিলেট আওয়ামী লীগের দলীয় সক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা পরীক্ষার তেমন সুযোগ হয়নি। তবে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর প্রবাসীবলয়ের প্রভাব বাড়ছে। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে, সেটিও এখনো কমেনি। বরং জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নেতায়-নেতায় দ্বন্দ্ব বাড়ছে।
দলীয় সূত্রে আরো জানা গেছে, সিটি নির্বাচনের মাসখানেক পর গত ১৮ জুলাই নগরের রেজিস্টারি মাঠে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের এক অনুষ্ঠানে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের ঘটনা ঘটে এমপি হাবিব ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের মধ্যে। অভিযোগ ওঠে, এমপি হাবিব নগর সম্পাদক জাকিরের সঙ্গে অসদাচরণ ও কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করেছেন। পরে ৩০ জুলাই মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সভায় উপস্থিত নেতারা এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে এমপি হাবিবের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সম্প্রতি কেন্দ্রে একটি চিঠি পাঠানো হয়। গত রোববার ওই চিঠির অনুলিপি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তরেও পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, ‘এ রকম কিছু হয়নি। মহানগরের সভাপতিকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। বলয় বা গ্রুপিং করি না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কাজ করে যাচ্ছি।’
দলীয় বলয় প্রসঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ‘কোনো গ্রুপিংয়ের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও তাঁর কন্যার নেতৃত্বে রাজনীতি করি। যারা বলয় সৃষ্টি করে, তারা বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে করে। আমি এসব নীতির বিরোধী।’
এমপি হাবিব প্রসঙ্গে জাকির হোসেন বলেন, ‘একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মহানগর আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক রীতি-নীতির মধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে অনুযায়ী কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপও করেছি। এগুলো সাংগঠনিক বিষয়। গণমাধ্যমে বলা ঠিক না।’
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান বলেন, ‘এমপি হাবিব ও মেয়র আনোয়ারুজ্জামান দলের জন্য ইতিবাচক চিন্তা করবেন। গ্রুপিং বা নিজের আধিপত্যের দিকে কম প্রাধান্য দেবেন। কেননা, সবাই মিলেই তাঁদের নির্বাচিত করেছে। তাই সবাইকে নিয়ে চলার চেষ্টা করলে ভালো হবে।’
গ্রুপিংয়ের বিষয়ে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আওয়ামী লীগে কোনো গ্রুপিং বা বলয় নেই। সবাই ঐক্যবদ্ধ। গ্রুপিং প্রতিরোধে যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।’
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটে আওয়ামী লীগের মধ্যে এই বিভাজনের সুযোগে বিরোধী শিবির যথেষ্ট চাঙা হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিকভাবে বিএনপি-জামায়াত এক সাথে কাজ করে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে দলটি আওয়ামী লীগের এই বিভেদকেই পুঁজি করে জয়ের সম্ভাবনাও দেখছেন খোদ আওয়ামী লীগেরই কেউ কেউ।
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভেদ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ্যাড. জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আওয়ামী লীগ এদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। দলের মধ্যে ছোটখাটো বিভেদ থাকবেই। তবে এ ধরণের কোনো সুনির্দিষ্ট বিভেদ থাকলে সেটি মিটিয়ে নেয়া হবে সাংগঠনিকভাবে। বৃহৎ দল হওয়ায় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকবেই। সেটি যেন সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা হয়, এ বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে।