বরখাস্তকৃত ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশিদ ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে ‘রূপায়ণ স্বপ্ন নিলয়’ তে নগদ ৩ কোটি টাকা দিয়ে ৩ হাজার বর্গফুট আয়তনের একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন।
একজন সরকারি চাকরিজীবী কীভাবে কোটি কোটি টাকা দিয়ে এ ধরনের ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক বেঞ্চ বরখাস্তকৃত ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশিদের সাজা বহালের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে এমন প্রশ্ন তোলে বলেন, বজলুর রশিদ পৈত্রিক সূত্রে কোনো সম্পত্তি পাননি। তার আয়ের একমাত্র বৈধ উৎস ছিল সরকারি চাকরি। ২১ বছর চাকরি করে তা থেকে প্রাপ্ত বেতন হতে পারিবারিক ব্যয় মিটিয়ে কোটি কোটি টাকা নগদ জমা রাখার বিষয়টি অবাস্তব, অবিশ্বাস্য ও কল্পকাহিনীকেও হার মানায়।
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় মো. বজলুর রশিদকে গত বছরের ২৩ অক্টোবর পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫। পাশাপাশি ৫ লাখ টাকা জরিমানা এবং ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকায় ক্রয়কৃত ফ্ল্যাটটি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের আদেশ দেওয়া হয়।
এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ওই কারা কর্মকর্তা। আপিল খারিজ করে বিশেষ জজ আদালতের দেওয়া সাজার রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট।
রায়ে হাইকোর্ট বলেন, আপিলকারী বজলুর রশিদ তার লিখিত ও মৌখিক সাক্ষীর কোথাও ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য ঋণের আবেদন করেছেন এমন তথ্য প্রদান করেননি। বরং জেরায় তিনি বলেছেন, আমি রূপায়ণ হাউজিং লিমিটেডকে নগদ টাকা দিয়েছি। অথচ তিনি জবানবন্দিতে বলেছেন, ব্যাংক ঋণ ছাড়া ফ্ল্যাট ক্রয় করতে পারবেন না। অথচ ব্যাংক ঋণের জন্য তিনি কোনো দরখাস্তই করেননি। অর্থাৎ আপিলকারী অপরাধের দায় থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য আদালতে একের পর এক মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন।
হাইকোর্ট আরও বলেন, কোনো ক্রেতা ফ্ল্যাট নির্মাণ কোম্পানিকে ব্যাংক চেকের মাধ্যমে বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে ফ্ল্যাটের মূল্য বা কিস্তি পরিশোধ করেন। আপিলকারী স্বীকারও করেছেন তার একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। অথচ তিনি কোটি কোটি টাকা ব্যাংক চেকে বা পে-অর্ডারে প্রদান না করে কেন নগদে পরিশোধ করলেন? এর একটাই উত্তর তা হলো উক্ত টাকা বৈধ না হওয়ায় তিনি ব্যাংকে রাখতে পারেননি।
নথি পর্যালোচনা করে হাইকোর্ট বলেন, বজলুর রশিদের মাতা নূরজাহান বেওয়ার কোনো আয় ছিল না। ছিল না কোনো আয়কর নথিও। যে দলিলগুলো দ্বারা তিনি সম্পদের মালিক হয়েছেন সে সময় তার আয় না থাকায় প্রশ্ন ওঠে উক্ত সম্পত্তি উনি কীভাবে ক্রয় করলেন? প্রকৃতপক্ষে বজলুর রশিদ তার অবৈধ পন্থায় অর্জিত টাকা দিয়ে উক্ত দলিলগুলোর মাধ্যমে মায়ের নামে সম্পত্তি ক্রয় করেন। পরবর্তীকালে সেসব সম্পত্তি নিজের নামে হেবামূলে গ্রহণ করেছেন আপিলকারী। আপিলকারীর এহেন কর্মনীতি নৈতিকতারও পরিপন্থী। কারণ অবৈধ অর্থ বৈধ করার নিমিত্তে গর্ভধারিণী মায়ের নাম ব্যবহার করেছেন, যা এক জন সন্তানের নিকট কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দদুক) করা মামলায় কারা অধিদপ্তরের সাময়িক বরখাস্ত ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশিদকে বিচারিক আদালতের দেওয়া পাঁচ বছরের দণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ১৯ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ হয়েছে।
চলতি বছরের ১৮ জুন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক বেঞ্চ তার আপিল খারিজ করে রায় ঘোষণা করেন। আদালতে ওইদিন দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। আপিল আবেদনের পক্ষে ছিলেন মো. মাসুদ-উল হক ও মোহাম্মদ হুমায়ন কবির।
এর আগে গত বছরের ৩ নভেম্বর বজলুর রশিদের খালাস চেয়ে করা আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেছিলেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তার জরিমানা স্থগিত করে নিম্ন আদালতের নথি তলব করেন।
খুরশীদ আলম খান বলেন, গত বছরের ২৩ অক্টোবর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক মো. ইকবাল হোসেন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি তাকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। এছাড়া রাষ্ট্রের অনুকূলে তিন কোটি ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯০২ টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছিলেন। শুনানি শেষে পাঁচ বছরের দণ্ড ও জরিমানা বহাল রাখেন আদালত। তবে তাকে সশ্রম কারাদণ্ডের স্থলে বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর বেলা ১১টা থেকে বজলুর রশীদ ও তার স্ত্রী রাজ্জাকুন নাহারকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুপুরে দুদক পরিচালক মো. ইউসুফের নেতৃত্বে একটি টিম তাকে গ্রেফতার করে। ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক মো. নাসির উদ্দীন বজলুর রশিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওবি বছরের ২২ অক্টোবর মামলায় বজলুর রশিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, বজলুর রশিদ রূপায়ন হাউজিং এস্টেট থেকে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী রোডের ৫৫/১ (পুরাতন) ৫৬/৫৭ (নতুন) নির্মাণাধীন স্বপ্ন নিলয় প্রকল্পের ২৯৮১ বর্গফুট আয়তনের অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। অ্যাপার্টমেন্টের মূল্য বাবদ তিন কোটি আট লাখ টাকা পরিশোধও করেছেন। এ অ্যাপার্টমেন্ট কেনায় বজলুর রশিদ যে টাকা পরিশোধ করেছেন, এর সপক্ষে কোনো বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি। এমনকি তিনি অ্যাপার্টমেন্টের ক্রয় সংক্রান্ত কোনো তথ্য তার আয়কর নথিতে দেখাননি। পরিশোধিত তিন কোটি আট লাখ টাকা জ্ঞাত আয় উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
সবমিলিয়ে তার নামে তিন কোটি ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯০২ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক আইন ২৭ (১) ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। কারা ক্যাডারের ১৯৯৩ ব্যাচের কর্মকর্তা বজলুর রশিদ ঢাকায় কারা সদর দপ্তরে দায়িত্ব পালন করেন।