ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। রাষ্ট্রপতি পদ ছাড়ার পর সাবেক হিসেবে তিনি উঠেছিলেন দিল্লির ১০ রাজাজি রোডের সরকারি বাড়িতে। ক্ষমতা ছাড়ার ১৫ দিন পরই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি প্রাণবন্ত ছিলেন। নতুন বাড়িটি ঘুরিয়ে দেখালেন। বললেন, এখানে এ পি জে আবদুল কালাম থাকতেন। বাইরে খোলা লন। বাড়ির চারপাশে সকাল-সন্ধ্যায় হাঁটাহাঁটি করা যাবে। দেখলাম সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা কাগমারী সম্মেলন বইটি পড়ছেন। তাকাতেই বললেন, তোমাদের দেশের একজন রাজনীতিবিদ বইটি দিয়ে গেছেন। কয়েক দিন আগে এসেছিলেন। এখন কাজ কম, তাই পড়াশোনা করছি। বই পড়ছি। নিজেও লেখালেখি করছি। একটা বই প্রকাশ করেছি। আরেকটার কাজ চলছে। আড্ডায় বারবার উঠে আসছিল বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। তিনি ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কথা তুলে ধরছিলেন। আর বারবার প্রশংসা করছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ের বিভিন্ন ইতিবাচক কাজের।
বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার জন্য ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির একটা গভীর স্নেহ ছিল। ওয়ান-ইলেভেনের সময় শেখ হাসিনার জেলে যাওয়া নিয়ে তিনি উৎকণ্ঠিত ছিলেন। সে সময় একদিন লন্ডন থেকে উড়ে দিল্লি গেলেন শেখ রেহানা। সাক্ষাৎ করলেন প্রণব মুখার্জির সঙ্গে। কথায় কথায় প্রণব মুখার্জি তাঁকে বললেন, হাসিনা জেলে। দলের ভিতরে নানামুখী ষড়যন্ত্র আছে। পরিস্থিতি সামলাতে তুমি কি আপাতত দলের দায়িত্ব নেবে? শেখ রেহানা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন- দাদা আপনি আপাকে বের করুন। তিনি রাজনীতি করছেন। তিনি করবেন। আমি পাশে থাকতে চাই। মা আমাকে রেখে গেছেন তাঁর পাশে ছায়ার মতো থাকতে। তাঁকে সাহায্য করতে। আমি তা করছি। শেখ রেহানা আরও বলেছিলেন, বাংলাদেশে আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র আছে। এ ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে আপনি আপাকে দ্রুত বের করুন। আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করুন। প্রণবদা সেই কথাগুলো আমাকে শোনালেন। বললেন, রেহানার মধ্যে বোনের জন্য যে ভালোবাসা দেখেছি তা অসাধারণ। দুই বোনের এ সৌহার্দ্য আমাকে মুগ্ধ করে। তাঁদের জন্য সব সময় প্রার্থনা করি। তাঁরা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার মেয়ে।
অনেক বছর পর বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ের সঙ্গে কয়েকজন সাংবাদিকসহ এ নিয়ে কথা বলার সময় তিনি বললেন, একটা ষড়যন্ত্র দলের ভিতরেই হয়েছিল। সব সামলেছিলাম। তিনি আরও বললেন, আমার তো জার্মানি যাওয়ার কথা ছিল না। যাওয়ার সময় মা বলেছিলেন, ছোট বাচ্চাদের (জয়, পুতুল) একলা সামাল দিতে পারবে না হাসিনা। তুই হাসিনাকে দেখে রাখবি। বাচ্চাদের সামাল দিবি। শেখ রেহানা ওয়ান-ইলেভেনের সময় শক্ত ভূমিকা নিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা তখন কারান্তরিন। তিনি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকে নিয়মিত ফোন করতেন। দলকে ধরে রাখতে তাঁদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। মির্জা আজম এ নিয়ে স্মৃতিচারণায় বলেছেন, নানক ভাই ও আজম তখন পলাতক। নেত্রীকে মুক্ত করতে তাঁরা ছোট আপার ফোন ও নির্দেশ অনুয়ায়ী কাজ করতেন। তাঁরা সাহস ও মনোবল পেতেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারানোর পর দুই বোন কঠিন সময় অতিবাহিত করেছেন। অনিশ্চিত জীবনে একদিকে ছিল বেঁচে থাকার সংগ্রাম, অন্যদিকে বিশ্বাসঘাতক বেইমানদের চিনে পথচলা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রথম রাত পার না হতেই দেখলেন রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের নিষ্ঠুর চেহারা। তারপর পাশে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে। দিল্লিতে এলেন দুই বোন। ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে শুরু হলো কষ্টের জীবন। শরণার্থী হিসেবে বিদেশ থাকলেন। সেই পরিবেশে শেখ রেহানা দিল্লি থেকে গেলেন লন্ডনে খোকা চাচার কাছে। মমিনুল হক খোকা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই। লন্ডনের কিলবার্নে খোকা চাচার বাড়িতে শেখ রেহানার বিয়ে হয়। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতেই ড. শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে এ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন জিল্লুর রহমান ও আইভি রহমান। এ প্রস্তাব আবার আসে ১৯৭৭ সালে। শেখ রেহানা সবকিছু ছেড়ে দেন বড় বোনের ওপর। শেখ হাসিনা সম্মতি দেওয়ার পরই বিয়ে হয়।
একমাত্র ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি শেখ হাসিনা। দিল্লি থেকে লন্ডন যেতে টিকিটের টাকা ছিল না হাতে। বাবা, মা, ভাই হারানো একমাত্র বোনের বিয়েতে না যেতে পারার কষ্ট শেখ হাসিনাকে তাড়িয়ে বেড়াত। লন্ডন ও দিল্লিতে আলাদাভাবে বসবাস করা দুই বোনের অশ্রু বিসর্জন ছাড়া তখন আর করার কিছু ছিল না। আজ শেখ রেহানা তাঁর তিন সন্তানকে মানুষ করেছেন। তাঁর মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের মতো দেশে বারবার এমপি। লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলে টিউলিপের গাড়িতে পতাকা উড়বে নিশ্চিত। তার পরও পুরনো স্মৃতিগুলো তিনি এখনো হাতড়ে বেড়ান। ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুরতার পর লন্ডনের কষ্টের দিনগুলো নিয়ে ভাবেন। চাকরি ছেড়েছেন মাত্র। ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। বাসে চড়ে যেতেন অফিসে। বরফ, রোদবৃষ্টি উপেক্ষা করতেন। দুঃখকে সঙ্গী করে পথ চলেছেন। একমাত্র বড় বোন শেখ হাসিনা, তাঁর স্বামী ও সন্তানরা বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে না পারায় মন খারাপ থাকত শেখ রেহানার। দিল্লির রাজনীতিতে তখন পালাবদল। ইন্দিরা গান্ধী ভোটে পরাজিত হওয়ার পর সবকিছু বদলে যায়। ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন শেখ হাসিনা ও ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া। তাঁরা শেখ রেহানাকে দিল্লি আনতে সাহায্য চান মোরারজি দেশাইয়ের। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে শেখ রেহানা দিল্লি আসেন বোনের কাছে। মোরারজি দেশাই বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের সুযোগসুবিধা, নিরাপত্তা সব তুলে নিয়েছিলেন। মানসিকভাবে চাপ তৈরি করলেন যাতে তাঁরা ভারত ছেড়ে দেন। বিদ্যুৎ বিল বন্ধ করে দিলেন। গাড়ি ফেরত নিলেন। সেই কঠিন সময়ে দুই বোন একসঙ্গে মোকাবিলা করেছেন সবকিছু। তাঁরা পাড়ি দিয়েছেন ‘দুর্গমগিরি কান্তার-মরু দুস্তর পথ’। শোক বেদনাবিধুর পরিবেশে নিজেদের তৈরি করেছেন দেশের জন্য কঠিন পাথর হিসেবে।
১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে ইন্দিরা গান্ধী আবার ক্ষমতায় আসেন। শেখ হাসিনা লন্ডন যান রেহানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। তার আগে ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে সভাপতি করার সিদ্ধান্ত হয়। দুই বোনের জীবনে শুরু হয় আরেক সংগ্রাম। যদিও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে জনমত গঠন শুরু করেন তাঁরা আরও আগে। বড় বোনের নির্দেশে লন্ডন ও ইউরোপে অনেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন শেখ রেহানা। অংশ নিতেন বিভিন্ন সভাসমাবেশে। স্টকহোমে ইউরোপের বাকশাল আয়োজিত অনুষ্ঠানটি ছিল ১০ মে, ১৯৭৯ সালে। ব্রিটেনসহ ইউরোপিয়ান দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দেন। বিভিন্ন দেশের অনেক বিদেশি অংশ নেন। বড় বোনের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে লন্ডন থেকে স্টকহোম যান বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। সেদিন সবাই বঙ্গবন্ধুর মেয়ের কণ্ঠে শুনতে আসেন কী হয়েছিল বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি করা হয়েছিল। ইউরোপীয় আওয়ামী লীগ নেতারা আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়া বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনাকে।
আমন্ত্রণ পেয়ে খুশি হন দিল্লিতে দুঃসহ জীবন অতিবাহিতকারী বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে। দিল্লি থেকে ইউরোপ যাওয়ার বিষয়টি তখন অত সহজ ছিল না। আর্থিক সংকটের পাশাপাশি সন্তানদের রেখে যাওয়াসহ অনেক ঝামেলা ছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা লন্ডনে ফোন করেন ছোট বোন শেখ রেহানাকে। বললেন এ সম্মেলনে যোগ দিতে। ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যার কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে। শেখ রেহানা যোগ দিলেন সেই অনুষ্ঠানে। শুরুতে শেখ হাসিনার লিখিত বাণী তিনি পড়ে শোনান। আবেগঘন সেই বাণীতে শেখ হাসিনা বিশ্ববিবেকের কাছে প্রশ্ন তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে। তুলে ধরেছিলেন নিষ্ঠুরতার চিত্র। এরপর পিনপতন নীরবতায় টানা বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। দুই চোখে অশ্রুর বন্যা নিয়ে তিনি জানান, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কীভাবে সপরিবার নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। নারী ও শিশু হত্যা বিশেষ করে আদরের ছোট ভাই রাসেলের কথা তিনি তুলে ধরার সময় অনেকে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ঘটনা শুনে হতবাক হন বিদেশিরাও। শেখ রেহানা জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থাগুলোসহ বিশ্ববিবেককে অনুরোধ করেন ভয়াবহ এ হত্যার তদন্ত করতে। নারী ও শিশু হত্যার বিচারের দাবি তুলতে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য তাঁর দুই মেয়েকে দীর্ঘ সময় অপক্ষা করতে হয়েছিল।
শেখ রেহানা নীরবে কাজ করেন। বাইরে একটা শক্ত মনোভাব দেখালেও ভিতরে তিনি ঠিক বিপরীত। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েই বাবার মতো বিশাল হৃদয় পেয়েছেন। উদারতা পেয়েছেন। আজ ১৩ সেপ্টেম্বর শেখ রেহানার জন্মদিন। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। শুভ জন্মদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের প্রিয় ছোট আপা। দীর্ঘায়ু হোন। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে যেভাবে বড় বোন শেখ হাসিনার পাশে থেকে কাজ করছেন পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করুন। পরম করুণাময় আপনাদের পাশে ছিলেন, আছেন, থাকবেন। বাংলাদেশ শব্দটি আমাদের বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দিয়েছেন উন্নতি ও সমৃদ্ধি। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ স্বাপ্নিক অধ্যায়। এ অধ্যায়ে আপনার ভূমিকা ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। রক্তের উত্তরাধিকার হয়ে শেষ করুন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজগুলো। বাংলাদেশের মানুষ জানে কোনো ধরনের লোভ স্পর্শ করতে দেননি চলার পথে। এমনকি নিজের নামে বরাদ্দকৃত সরকারি বাড়িটিও দান করেছেন।
২০০১ সালে ধানমন্ডি ৬ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়িটি বরাদ্দ পান বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে। বরাদ্দের বিপরীতে ক্রয়মূল্য রাজউককে প্রদান করেন তিনি। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে এ বরাদ্দ বাতিল করে। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে শেখ রেহানা মামলা করেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি এ বাড়ির ওপর নিজের অধিকার ছেড়ে দেন। থানা হিসেবে তাঁর বাড়িটি ব্যবহারের কারণে তিনি ঘোষণা দেন এ সম্পদ দেশের কাজে লাগছে। আমার এ সম্পদের দরকার নেই। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে পরিচয়ে বেঁচে থাকতে চাই। লোভের বাইরে নিজেকে রেখেছেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা। চাইলে রাজনীতিতে জড়াতে পারতেন। নিতে পারতেন পদপদবি। নেননি। বোনের পাশে আছেন ছায়াসঙ্গী হিসেবে। কাজ করছেন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে। সামনের সব জটিল সময় মোকাবিলা করে এভাবে এগিয়ে যাবে- সেই প্রত্যাশা বাংলাদেশের সব মানুষের মতো শেখ রেহানারও।
লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন