শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিরোনাম: কর্মোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব   নববর্ষের আনন্দ যেন বিষাদের কারণ না হয়: রাষ্ট্রপতি   নির্বাচনে ২১ সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন ইসির   দেশজুড়ে যে তিনদিন মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা!   মির্জা ফখরুলের জামিন শুনানি ৯ জানুয়ারি   প্রাথমিকের ছুটি বাড়ল ১৬ দিন (তালিকা)   নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিএনপির প্রচারণা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
সাতক্ষীরায় রেল: প্রতিশ্রুতি আর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ১১০ বছর!
আবুল কালাম আজাদ
প্রকাশ: শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ২:০৫ এএম | অনলাইন সংস্করণ

ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে পদ্মাসেতুর উপর দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় এলো ট্রেন। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে এই ট্রেন যশোর এসে পৌছানোর কথা রয়েছে। এর মধ্যদিয়ে পদ্মপাড়ের মানুষের পাশাপাশি পদ্মার এ পারের ২১ জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। এতে উচ্ছ্বসিত এই অঞ্চলের জনসাধারণ। এই রেললাইন উদ্বোধনের ফলে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হবে। কিন্তু তার সুফল থেকে বঞ্চিত বর্তমানে পদ্মাসেতুর এপারের সবচেয়ে দুরের জেলা সাতক্ষীরার জনগন। ১১০ বছর পূর্ব থেকে সাতক্ষীরার মানুষ রেলের স্বপ্ন দেখছে। প্রতিশ্রুতি, নির্দেশনা আর বিভিন্ন সরকারী পদক্ষেপ এই স্বপ্ন বারবার জাগিয়ে তুলছে। কিন্তু সাতক্ষীরায় রেল আসেনি। রেল আসার মত প্রত্যক্ষ কোন কার্যকর পদক্ষেপও শুরু হয়নি। সবকিছুই প্রাথমিক পদক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

সাতক্ষীরায় রেলওয়ে: শুধু প্রতিশ্রুতি আর নির্দেশনা
বাংলাদেশে প্রথম রেলওয়ের সূচনা হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা-জগতি রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে। ১৮৮২-৮৪ সালের মধ্যে সেন্ট্রাল রেলওয়ে নামে পরিচিত বনগাঁ-যশোর-খুলনা ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হয়। এসময় নাভারনে রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়। ১৯১৪ সালে ভাইসরয় অব বৃটিশ ইন্ডিয়া কলকাতা থেকে নাভারণ হয়ে সাতক্ষীরার মধ্য দিয়ে সুন্দরবন পর্যন্ত রেল লিংক স্থাপনের নির্দেশ দেন এবং সেটি অনুমোদনও করেন। ১৯৫৮ সালে সাতক্ষীরা ভেটখালী সড়ক নির্মাণের সময়েও রেলের জায়গা রেখে জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা নেওয়ার কথা শোনা যায়। কালেক্রমে দেশে ২ হাজার ৮৭৭ কিঃমিঃ রেল লাইন নির্মাণ করা হয়। রেল নেটওয়ার্কে দেশের ৪৪টি জেলা সংযুক্ত হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পৃথক রেল মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। নতুন মন্ত্রণালয় ২০১০ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে নতুন করে আরো ১৫টি জেলাকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরমধ্যে ৭টি নতুন জেলায় রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ শেষের পথে। চলতি ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে এগুলো চালু হওয়ার কথা রয়েছে। মহাপরিকল্পনা ঘোষণার পূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাভারন-সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ রেললাইন নির্মাণের ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণা এবং রেল মহাপরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে সাতক্ষীরা জেলার নাম থাকলেও দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ আজো গ্রহণ করা হয়নি।

অগ্রগতি যেটুকু হয়েছে সেটি গত ১০ বছরে সম্ভাব্যতা যাচাই, নাভারন থেকে সাতক্ষীরা এবং সাতক্ষীরা থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত দুটি পৃথক প্রকল্প তৈরী, পিডিপিপি প্রণয়ন এবং অর্থের জন্য দাতা অনুসন্ধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সবকিছুই এখন দাতা খোঁজার প্রক্রিয়ার মধ্যেই ফাইল বন্দি।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও সম্ভাব্যতা যাচাই:
ঘূর্ণিঝড় আয়লা পরবর্তী ২০১০ সালের ২৩ জুলাই সাতক্ষীরার শ্যামনগর মহাসীন ডিগ্রি কলেজ মাঠে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাভারণ-সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ রেললাইন নির্মাণের ঘোষণা দেন। এ সময় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের প্রচেষ্ঠায় ২০১৩-২০১৪ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানারেইল কোম্পানি লিমিটেড সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কার্যক্রম সম্পন্ন করে এবং এ সম্পর্কিত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেয়।

এনিয়ে ২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সম্ভাব্যতা যাচাই এর ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। ১৪ জন আন্তর্জাতিক এবং ২০ জন জাতীয় পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত টিমের জরিপ কার্যক্রমের ফলাফলের উপর সাতক্ষীরা ও যশোরে আরো কয়েকদফা পর্যালোচনা ও অগ্রগতি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সম্ভাব্যতা যাচাই পরবর্তী প্রস্তুতকৃত প্রস্তাবনা:
নাভারণ-সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ রেললাইনের সম্ভাব্যতা ম্যাপে নাভারণ থেকে সাতক্ষীরা হয়ে শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ গ্যারেজ পর্যন্ত ৯৮ দশমিক ৪২ কিলোমিটার এলাকায় মোট আটটি স্টেশনের কথা বলা হয়। স্টেশনগুলোর সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করা হয় নাভারণ, বাগআচড়া, কলারোয়া, সাতক্ষীরা, পারুলিয়া, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর ও মুন্সীগঞ্জে। এছাড়া ম্যাপে বাঁকাল, লাবণ্যবতী, সাপমারা খাল ও কাকশিয়ালী নদীর ওপর রেল সেতু নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করা হয়।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী, নাভারন থেকে বাগআচড়া স্টেশনের দূরত্ব ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার, বাগআচড়া থেকে কলারোয়া ১২ দশমিক ৬৮, কলারোয়া থেকে সাতক্ষীরা ১৪ দশমিক ২৩, সাতক্ষীরা থেকে পারুলিয়া ১৫ দশমিক ১১, পারুলিয়া থেকে কালিগঞ্জ ১৮ দশমিক ৩৭, কালিগঞ্জ থেকে শ্যামনগর ১৩ দশমিক ৮২ ও শ্যামনগর থেকে মুন্সীগঞ্জ স্টেশনের দূরত্ব হবে ১১ দশমিক ৮১ কিলোমিটার। প্রকল্পটি মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের পরিবর্তে আরও ১০ কি.মি. বাদ দিয়ে শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ গ্যারেজ বাজার পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয় এবং সেটিরই পিডিপিপি প্রণয়ন করা হয়।

জাতীয় সংসদে সর্বশেষ রেলমন্ত্রীর বক্তব্য:
চলতি ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছিলেন, জনগণকে স্বল্পখরচ নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দময় পরিবহন সেবা দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রী সব জেলাকে রেল নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করার নির্দেশে দিয়েছেন। সে লক্ষ্যে সাতক্ষীরা জেলায় রেলপথ সম্প্রসারণের জন্য নাভারণ থেকে সাতক্ষীরা হয়ে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন নির্মাণের সম্ভাবতা সমীক্ষা প্রকল্প শেষ হয়েছে। ‘নাভারণ থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ’ এবং ‘সাতক্ষীরা থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ’ প্রকল্প দুটির পিডিপিপি প্রণয়ন করা হয়েছে। যা পরিকল্পনা মন্ত্রী নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছেন। প্রকল্প দুটির অর্থায়ন অনুসন্ধানের জন্য পিডিপিপি দুটি ইআরডিতে পাঠান হয়েছে। তারা অর্থায়নের জন্য দাতা সংস্থার খোঁজ নিচ্ছেন। বৈদেশিক অর্থায়ন পাওয়ার নিশ্চয়তা সাপেক্ষে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করা যাবে বলে রেলমন্ত্রী সেদিন সংসদকে জানান। পরবর্তীতে আরো বিভিন্ন পর্যায়ে মাননীয় রেলমন্ত্রী একই কথা বলেছেন।

প্রকল্পের মোট ব্যয় ও ঋণ প্রত্যাশা:
এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ‘কন্সট্রাকশন অব নিউ বিজি ট্র্যাক ফর্ম নাভারন টু সাতক্ষীরা’ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৩২৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা চীনের কাছে থেকে ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়। প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৬৬২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৩৩২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দবিহীন নতুন প্রকল্প তালিকায় এটা রাখা হয়।

বসুন্দিয়া-সাতক্ষীরা ভায়া মনিরামপুর-কেশবপুর রেল লাইন নির্মাণের নতুন দাবী:
নাভারণ-সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ রেললাইন নির্মাণে ১৯১৪ সালের পর থেকে গত ১১০ বছরেও আলোর মুখ না দেখলেও যশোরের বসুন্দিয়া-সাতক্ষীরা ভায়া মণিরামপুর-কেশবপুর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের দাবীতে ২০২২ সালের শুরুতে যশোরের মণিরামপুর-কেশবপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি সভা সমাবেশ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।

এসব সভা সমাবেশ থেকে বলা হয়, যশোরের বসুন্দিয়া থেকে নাভারন-বাগআচড়া হয়ে সাতক্ষীরার দূরত্ব ৯২ কিলোমিটার। কিন্তু এ পথটি পরিবর্তন করে বসুন্দিয়া থেকে মনিরামপুর-কেশবপুর হয়ে সাতক্ষীরা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হলে দূরত্ব হবে মাত্র ৪৯ কিলোমিটার। তখন রেলপথের দূরত্ব কমবে ৪৩ কিলোমিটার। আন্দোলনকারীরা বসুন্দিয়া হতে মনিরামপুর-কেশবপুর-সাগরদাঁড়ি হয়ে সাতক্ষীরা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের দাবীতে মণিরামপুর এবং কেশবপুরে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন, স্মারকলিপি পেশসহ ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচী পালন করে। সে দাবীর প্রেক্ষিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য রেলমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাত ও রেলমন্ত্রীর কাছে ডিও লেটার প্রদান করেন।

মোংলা-খুলনা-ডুমুরিয়া-তালা-সাতক্ষীরা রুট সম্পর্কিত দাবী:
মোংলা সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম গতিশীল হওয়ায় এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মিত হওয়ায় খুলনার সাথে এই দুই বন্দরের রেল নেটওয়ার্কের সাথে খুলনা-ডুমুরিয়া-তালা-সাতক্ষীরা-ভোমরা রুট নির্মাণেরও দাবী উঠে। বিশেষ করে ভারতের কোলকাতা বন্দরের সবচেয়ে নিকটবর্তী সাতক্ষীরার ভোমরা স্থল বন্দর। সে কারণে মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের সাথে কোলকাতার দূরত্ব কমাতে পারবে খুলনা-ডুমুরিয়া-তালা-সাতক্ষীরা-ভোমরা রেলপথ রুট। ভবিষ্যতে পদ্মা নদীর চাঁদপুর-শরিয়তপুর এলাকায় ব্রিজ নির্মিত হলে চট্টগ্রাম ও পতেঙ্গা সমূদ্র বন্দরের সাথে কোলকাতার দূরত্বও কমাতে পারবে এই একই রুট।

২০১১ সালের ৪ডিসেম্বর রেলওয়ে মন্ত্রণালয় গঠনের পূর্বে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪৪টি জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় ছিল। পরবর্তীতে সাতক্ষীরা-কক্সবাজারসহ দেশের আরও ৯টি জেলা ২০২২ সালের মধ্যে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের মধ্যে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। এসব জেলাগুলো হলো- মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, বরিশাল, বান্দরবান, কক্সবাজার ও নড়াইল। এরমধ্যে ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে ৭টি জেলা তথা কক্সবাজার, নড়াইল, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর এবং নতুন অর্ন্তভুক্ত করে মাগুরা ও বাগেরহাট জেলা রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার যাবতীয় কার্যক্রম শেষ হওয়ার পথে। তবে এখনো শুরুই হয়নি মহাপরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে অর্ন্তভুক্ত সাতক্ষীরাসহ কয়েকটি জেলার কাজ।

এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের আরও ৬টি জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আসার কথা রয়েছে। জেলাগুলো হল-শেরপুর, ঝালকাঠি, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, পটুয়াখালী ও বরগুনা। সরকার গৃহীত ২০১০ সাল থেকে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫টি জেলাকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনার মহাপরিকল্পনায় উক্ত ১৫টি জেলা অর্ন্তভুক্ত রয়েছে।

রেলওয়ের দাবীতে সাতক্ষীরায় নাগরিক সমাজের কর্মকান্ড:
পাকিস্তান শাসন আমলে ১৯৫৮ সালে সাতক্ষীরা-ভেটখালী সড়ক নির্মাণের সময়ও রেললাইনের জায়গা ধরে জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়। তখনও রেলের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। কিন্তু সে প্রক্রিয়া বেশিদুর যায়নি। দেশ স্বাধীনের পর আশির দশকের মধ্যবর্তী সময় হতে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাতক্ষীরা শাখা জেলার উন্নয়নের দাবী নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রেলওয়ের দাবীও ছিল। পরবর্তীতে জেলার উন্নয়নের দাবীতে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন সংগ্রামে রেলের বিষয়টি প্রধান্য পায়।

প্রয়াত সাংবাদিক অধ্যাপক তবিবুর রহমান ৩১-৭-১৯৬৮ তারিখে প্রকাশিত দ্য মর্নিং নিউজের এক রিপোর্টে লেখেন, ১৯১৪ সালে ভাইসরয় অব বৃটিশ ইন্ডিয়া কলকাতা থেকে নাভারণ হয়ে সাতক্ষীরার মধ্য দিয়ে সুন্দরবন পর্যন্ত রেল লিংক স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং সেটি অনুমোদনও করেছেন। সে অনুযায়ী দ্রুত গতিতে কাজও চলছে। এ রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘সাতক্ষীরা নিডস রেইল লিংক ফর ট্রেড প্রসপেক্টস’। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়েও সাতক্ষীরার নাগরিক সমাজের রেল নিয়ে যে তৎপরতা ছিল সেটা এই রিপোর্ট থেকেই পাওয়া যায়।

নাভারণ-সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ রেললাইনের বিরোধীতা:
নাভারণ-সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ রেললাইন নির্মাণের প্রাথমিক তৎপরতা শুরু হওয়ার পরপরই এর বিরোধীতায় নামে একটি মহল। একটি জাতীয় দৈনিকে এনিয়ে প্রধান শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। সেই খবরে ভূল তথ্য দিয়ে নাভারণ-সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ রেললাইন সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নির্মাণ হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়। এরফলে সুন্দরবনের বহু গাছ-গাছালি কাটা পড়বে এবং বাঘ হরিণসহ প্রাণিকূলের উপর এর বিরুপ প্রভাব পড়বে বলে উল্লেখ করা হয়। জাতীয় পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভুল বুঝিয়ে তাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে ঐ খবরটি প্রকাশের পর বেশ হৈ-চৈ পড়ে যায়। এই মিথ্যা বিভ্রান্তিকর খবরের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালিত হয়। কিন্তু ঢাকায় এর বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোন তৎপরতা না থাকায় ঐ বিভ্রান্তিরকর খবরের প্রভাব পড়ে প্রস্তাবিত প্রকল্পে। এরফলে মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের পরিবর্তে আরও ১০ কি.মি. বাদ দিয়ে প্রকল্পটি শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ গ্যারেজ বাজার পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয় এবং সেটিরই পিডিপিপি প্রণয়ন করা হয়।

দুর্যোগকবলিত জেলা হিসেবে সাতক্ষীরায় রেলওয়ের গুরুত্ব:
সারাদেশে উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এপারের জেলাগুলোতেও উন্নয়নের জোয়ার বইতে শুরু করেছে। কিন্তু সেই উন্নয়ন যশোর-নড়াইল-খুলনা-বাগেরহাট পর্যন্ত এসে পৌছালেও সাতক্ষীরা জেলা এখনো অনেকটা দূরে রয়ে গেছে। সাতক্ষীরা জেলার উন্নয়নের গতি খুবই ধীর। জলবায়ু পরিবর্তন, ঘন ঘন ঝড় জলোচ্ছ্বাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদী ভাঙন এবং জলাবদ্ধতা সমস্যার কারণে ধীর গতির সেই উন্নয়নের তেমন কোন সুফলই পাচ্ছে না এই জনপদের মানুষ। প্রতিবছর বহু মানুষ কাজের সন্ধানে অন্যত্রে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের অনেকেই আর ফিরে আসছে না। এখানে শিক্ষার হার কম। দরিদ্রতার হার দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে বেশি। ফলে মৌলবাদ জঙ্গিবাদসহ নানা সংকটে জর্জরিত এই এলাকা। এসব কারনে এই পশ্চাৎপদ এলাকাকে দেশের উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত করতে রেলের গুরুত্ব অপরিসীম।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাতক্ষীরার উজ্জ্বল সম্ভাবনা:
কৃষি উৎপাদন, মৎস্য চাষ, সুন্দরবন ও পর্যটন, ভারতের সাথে ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রে সাতক্ষীরার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এখানকার মোট কৃষি জমির এক-তৃতীয়াংশের বেশি জমিতে বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ করা হয়।

জেলার ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক লক্ষ ৩৯ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন চিংড়ি ও সাদা মাছের উৎপাদন হয়। জেলায় মাছের চাহিদা ৫২ হাজার ১১৩ মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত প্রায় ৮৭ হাজার ৫৭৬ মেট্রিক টন। এর একাংশ বিদেশে রপ্তানি এবং অবশিষ্ট মাছ দেশের অন্যান্য এলাকায় সরবরাহ করা হয়।

জেলায় ২০২৩ সালে প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। ধানসহ শাক সবজির ক্ষেত্রেও সাতক্ষীরা জেলা উদ্বৃত্ত খাদ্য শস্য উৎপাদন করে। এই উদ্বৃত্ত খাদ্য শস্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন করা হয়। আম, কুলসহ সাতক্ষীরায় উৎপাদিত শাক-সবজির একটা বড় অংশ দেশের বিভিন্নস্থান ছাড়াও দেশের বাইরে রপ্তানী হয়।

সড়ক পথে সুন্দরবন ভ্রমনের একমাত্র সুযোগ রয়েছে সাতক্ষীরা জেলায়। ঢাকা বা দেশের অন্যান্য স্থান থেকে যে কোন যানবাহনে সাতক্ষীরা শহরের উপর দিয়ে শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ পৌছালেই চুনকড়ি নদীর ওপারে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। পর্যটনে কক্সবাজারের পরেই সুন্দরবন হতে পারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্পট।

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার ২৭২কি.মি. সীমান্ত রয়েছে সাতক্ষীরা জেলায়। এখানকার ভোমরা স্থল বন্দর থেকে মাত্র ৮০কি.মি. দূরত্বে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা শহর অবস্থিত। কোলকাতা সমুদ্র বন্দরের সবচেয়ে নিকটে রয়েছে অধুনালুপ্ত সাতক্ষীরার বসন্তপুর নৌবন্দর। যেটি পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি চালু হলে নৌ-পথে সবচেয়ে কম খরচে ভারত-বাংলাদেশ আমদানী-রপ্তানী পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে। এটিই হবে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যকার ব্যবসা-বানিজ্যের সেতুবন্ধনকারী একমাত্র নৌবন্দর।

এবছর সাতক্ষীরায় উৎপাদিত আম কুরিয়ারে ঢাকায় পাঠাতে কেজি প্রতি খরচ হয়েছে ১২ থেকে ১৫ টাকা। প্যাকিংসহ অন্যান্য খরচ যোগ করলে প্রতি কেজির খরচ ২০ টাকার কম নয়। একই আম চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে রেলওয়ের মাধ্যমে ঢাকায় পাঠাতে প্রতি কেজির খরচ হয়েছে ১টাকা ৩১ পয়সা। রেলে ঝুক্কি-ঝাকি কম হওয়ায় প্যাকিংসহ অন্যান্য খরচ কম। ফলে রেলে আম পরিবহনে প্যাকিংসহ খরচ গড়ে ৫টাকার বেশি নয়। সাতক্ষীরা এবং চাপাইনবাবগঞ্জের এই আম পরিবহনের খরচের পার্থক্য গড়ে প্রায় ১৫ টাকা। সেক্ষেত্রে সাতক্ষীরার আম তুলনামূলক সুস্বাদু হওয়া সত্বেও পরিবহন ব্যয়ের এই পার্থক্যের কারনে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পিছিয়ে পড়ছে।

আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সাতক্ষীরার যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে পন্য পরিবহনের সিংহভাগ ছিল নদী কেন্দ্রীক। তখন সড়ক পথে খুলনায় যেতে হতো যশোর হয়ে এবং সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় যেতে সময় লাগতো ১৫/২০ ঘন্টা। নৌপথ বন্ধ হওয়ার পর সারাদেশের সাথে সাতক্ষীরার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এখন সড়ক পথ। সারাদেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগন্তরকারী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে সাতক্ষীরায় সড়ক উন্নয়ন হয়েছে কম। এর অন্যতম প্রধান কারন মনে করা হয় সাতক্ষীরা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বশেষ জেলা।

পদ্মা সেতু চালুর পরও সাতক্ষীরা থেকে খুলনা-গোপালগঞ্জ হয়ে ঢাকার দুরুত্ব এখন ২৬৮ কি.মি.। পদ্মার এপারের জেলাগুলোর মধ্যে সাতক্ষীরা এখনো ঢাকার সবচেয়ে দুরের জেলা। পদ্মার এপারের জেলাগুলোর সাথে অন্যান্য জেলার যে পরিমান দুরত্ব কমেছে সেই হিসাবে সাতক্ষীরার দুরুত্ব কমেছে যৎসামান্য।

এসব কারণে সাতক্ষীরায় রেললাইন সাতক্ষীরার জন্য যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তারচেয়ে সারাদেশের জন্য এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

শেষ কথা:
ঢাকা হতে মাওয়া-পদ্মাসেতু হয়ে ভাঙা-কালনা-নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ শেষের পথে। এর একাংশ ঢাকা ভাঙার কাজ শেষ হয়েছে। তার সুফল সাতক্ষীরার নিকটবর্তী যশোরের নাভারনের মানুষও পাবে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী সাফল্য আসবে। কিন্তু সাতক্ষীরা থেকে যাবে এসব থেকে বঞ্চিত। এই পরিস্থিতির অবসানে জরুরিভাবে নাভারন-সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সরকারের আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আর সেজন্য প্রয়োজন সাতক্ষীরার রাজনীতিবীদ, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ।

লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক পত্রদূত



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Vorer-pata-23-12-23.gif
http://www.dailyvorerpata.com/ad/bb.jpg
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Screenshot_1.jpg
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]