বিশ্ব মুসলিম উম্মার দ্বিতীয় জমায়াতে তাবলীগ। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের তাবলীগ জামায়াতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে হেফাজতপন্থীরা। আর হেফাজতপন্থীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন খোদ সরকারের একটি অংশ, বিশেষ করে একজন মন্ত্রী। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান বিরোধে হামলা, সংঘর্ষে প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটেছে। টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানকে ব্যবহার করা নিয়েও চলছে নানা ধরণের ষড়যন্ত্র। মূল বিশ্ব ইজতেমার আগে ৫ দিনের জোড় ইজতেমার আয়োজন করা হয় প্রতিবছরই।
এমনকি গাজীপুরের টঙ্গীতে আগামী ১৩-১৭ অক্টোবর হতে যাচ্ছে দিল্লির নিজামুদ্দিন বিশ্ব মার্কাজের অনুসারী তথা মাওলানা সাদ আহমদ কান্ধলভী অনুসারীদের পাঁচ দিনব্যাপী জোড় ইজতেমা। রোববার গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কার্যালয় এ সংক্রান্ত একটি অনুমতিপত্র দিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নিজামুদ্দিন বিশ্ব মার্কাজ অনুসারী টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটির মিডিয়া সমন্বয়কারী মো. সায়েম।
তিনি জানান, দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনত সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার সফলতার জন্য পুরনো সাথীদের সমন্বয়ে টঙ্গী ময়দানে পাঁচ দিনের জোড় আগামী ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৭ অক্টোবর করার জন্য অনুমতি চেয়ে এক সপ্তাহ আগে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর আবেদন করা হয়। আবেদনটি করেন নিজামুদ্দিন বিশ্ব মার্কাজের অনুসারী তাবলিগের মূলধারা ও ঢাকা কাকরাইল জামে মসজিদ মার্কাজের আহলে শুরার পক্ষে সৈয়দ ওয়াসিফ ইসলাম।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে পাঁচ দিনব্যাপী জোড় ইজতেমা পালনের অনুমতি দিয়েছেন। জোড় ইজতেমা কেন্দ্র করে কিছু দিনের মধ্যেই ময়দান প্রস্তুতির কাজ শুরু হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। তবে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে গাজীপুর মেট্রোপলিটান পুলিশ অনুমতি দিলেও পরের দিনই সরকারের একজন মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করেন হেফাজতপন্থীরা। তারা ওই মন্ত্রীকে দিয়ে জোড় ইজতেমা বন্ধের দাবি তুলেছেন। ফলে মাওলানা সাদ আহমদ কান্ধলভী অনুসারীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। অনেকে অভিযোগ করেই বলেছেন, একজন মন্ত্রী এবং সরকারের মধ্যে থাকা কয়েকজন হেফাজতপন্থীদের দিয়ে এসব করাচ্ছে। ধর্মীয় এই কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায় একটি মহল। ফলে বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক একটি মনোভাব গড়ে উঠছে।
এদিকে, তাবলীগ জামাতের মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারী মুরব্বিরা সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে ৭ দফা দাবি জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, বিশ্ব ইজতেমা ময়দান নিয়ে তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। কোনো কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। তাবলীগ জামাতের মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারী মুরব্বিরা অভিযোগ করেছেন, তাবলিগ জামাতকে বিতর্কিত করতে নানা ষড়যন্ত্র চলছে। বিশ্ব ইজতেমা ময়দান নিয়ে তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। কোনো কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না।সাদপন্থী মুরব্বিরা দাবি করেন, বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা ও তাবলিগের যাবতীয় কাজ পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ হওয়া দরকার। তারা প্রশাসনের তদারকিতে দু’পক্ষকে প্যান্ডেল তৈরি ও খোলার দায়িত্ব অর্পণসহ ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অ্যাডভোকেট আব্দুল কুদ্দুস বাদল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মাওলানা সা’দপন্থী ইজতেমা আয়োজক কমিটির মিডিয়া সমন্বয়ক মোহাম্মদ সায়েম, অ্যাডভোকেট ইউনুস মিয়া, মাওলানা সৈয়দ আনোয়ার আব্দুল্লাহ, মো. সোহেল ও আতাউল্লাহ।
উল্লেখ্য, হেফাজতে ইসলাম শুরুতে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কার্যক্রম শুরু করলেও সময়ে সাথে নিজেদের রাজনৈতিক মোড়কে মুড়িয়ে ফেলে। বিশেষ করে সংগঠনটির আমির আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর জুনায়েদ বাবানুগরীর নেতৃত্বে অর্থ ও রাষ্ট্রক্ষমতার লোভ চরমভাবে পেয়ে বসে সংগঠনটির। এরপর থেকে রাষ্ট্র ও সরকার বিরোধী নানা ইস্যুতে জড়িয়ে ফেলে নিজেদের।হেফাজত নেতাদের গ্রেফতারের পর একে একে বেড়িয়ে এসছে সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাবলীগ জামাত ভাঙার পেছনেও হেফাজতের ইন্ধনের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ একাধিক নেতাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
হেফাজতের একটি সূত্র বলছে, হেফাজতের একটি অংশ নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে এবং ধর্মভিত্তিক একমাত্র শক্তি হতে অন্য ইসলামীক সংগঠনগুলোকেও টার্গেট বানাতে ছাড়েনি। বিশেষ করে তবলীগ জামাতে যে সমস্যার কারণে তাদের মধ্যে বিভাজন এবং ভেঙেছে তার পেছনে হেফাজতের ইন্ধন একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। আর এসব বিষয়গুলো এখন হেফাজতের অনেক নেতাই রিমান্ডে এসে মুখ খুলছেন যা নিয়ে খোদ হেফাজতের মধ্যেই এখন টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাবলীগ জামাত ভাঙার ব্যাপারে নতুন তথ্য পেয়েছি। তাবলীগ জামাত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। এতে ইজতেমার জৌলুস আগের চেয়ে কমে গেছে। তাবলীগ জামাতকে পরিকল্পিতভাবে ভাঙতে হেফাজতের কোনো কোনো নেতা দীর্ঘদিন কাজ করেছে, যাতে অরাজনৈতিক এই সংগঠন তাদের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়। এটা ছিল তাবলীগ জামাত ভাঙার অন্যতম উদ্দেশ্য। হেফাজতের বেশ কয়েকজন নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাবলীগ জামাত ভাঙার ব্যাপারে এমন বক্তব্য তারা দিয়েছেন।
দিল্লি ও লাহোরের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের জেরে ২০১৮ সালে বিভক্ত হয়ে পড়ে তাবলীগ জামাত। এ দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসার আলেমদের একটি অংশ যুক্ত হয়ে পড়ে। তারা একটি পক্ষকে সমর্থন দেওয়ায় এ বিরোধ নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলে মনে করছেন তাবলীগ জামাত সংশ্নিষ্টরা। বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের দু`পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, হেফাজতের রাজনৈতিক অভিলাস এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে আকাঙ্খা পেয়ে বসেছিলো তাই তারা নিজদের অবস্থান শক্ত করার জন্য অনেক কিছুই করে। তবে সবচেয়ে বড় কথা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা যে ষড়যন্ত্র করেছে তার জন্য সাধারণ মানুষের মথ্যেও এখন তাদের অবস্থান শূন্যের কোঠায়। এই পরিস্থিতিতে সরকার বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যখন প্রমাণের ভিত্তিতে হেফাজত নেতাদের গ্রেফতার করছে তখন হেফাজতের মধ্যেই বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। ফলে হেফাজত এখন ভেঙেচুরে একটি অচল অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। এ অবস্থার পরও তারা এখন তাবলীগ জামায়াতের পাকিস্তানপন্থী মাওলানা জুবায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে তাবলীগকে দুর্বল করতে তারা সরকারের একজন মন্ত্রীকে প্রতিনিয়তই ভুল বুঝিয়ে যাচ্ছে।