গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের তালুক রামভদ্র মৌজাস্থ ঐতিহাসিক 'বামনডাঙ্গা জমিদারবাড়ি' ধ্বংসাবশেষ এখন রাজবাড়ি। জমিজাদারী সম্পত্তিতে চলছে ভূূূমিদস্যুতা।
বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, বামনডাঙ্গা জমিদারবাড়ির কিছু পরিমাণ জমিতে বিগত ২০০০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬৬ পদাতিক ডিভিশন (৩৯ ইষ্ট বেঙ্গল) ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে সম্প্রতি ভূমি ও গৃহ-হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে গৃহ নির্মিত হয়। এতে সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগ করছেন দেড় শতাধিক পরিবার। এছাড়া, রয়েছে ইউনিয়ন ভূমি অফিস, সামাজিক মসজিদ, উত্তর রামভদ্র সপ্রাবি, রাজবাড়ি বাজার। ১৯৯৬ সালের রংপুর কালেক্টরেট অফিস জমিদারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। এরআগে ১৯৪৫-১৯৫২ সালের মধ্যে পূর্ববাংলার জমিদারী প্রথার বিলুপ্তির অংশ হিসেবে বিলুপ্তি ঘটে এ 'বামনডাঙ্গা জমিদার'র গোড়াপত্তনকারী কৃষ্ণকান্ত রায় চৌধুরীর জমিদারী। বড় তরফ ও ছোট তরফ নামে প্রথমত ২ ভাগে বিভক্ত জমিদারীর মধ্যে জমিদার বংশধর জগচ্চন্দ্র রায় চৌধূরী ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এ বাড়িতেই মারা যান। এর পরবর্তীতে অন্যান্য বংশধররা পালাক্রমে ভারতে চলে যান। জমিদারী পরিচালনায় ব্যর্থতার ফলে আগেই বিলপ্তি ঘটে অপর অংশের জমিদারী।
ক্রমানুসারে মনীচন্দ্র রায় চৌধূরী গং ও সুনীতিবালা দেবী পক্ষে কোর্ট অব ওয়ার্ডস্ মোতাবেক জমিদার বংশধর ও প্রজাপত্তন সূত্রে বিপীনচন্দ্র চৌধূরী, দূর্গাকান্ত সরকারের উত্তরসূরী নরেন্দ্রনাথ সরকার, গোবিন্দ চন্দ্র সরকারের উত্তরসূরী উপেন চন্দ্র সরকার, দেবেনচন্দ্র সরকার, ভূপেন চন্দ্র সরকার, পুলীনচন্দ্র সরকার, নারায়ণ সরকারের উত্তরসূরী হরেন্দ্র চন্দ্র সরকার, প্যারিমোহন সরকার, রাজেন্দ্র মোহন সরকার, ধীরেন্দ্র নাথ সরকার দিং বিভিন্ন মৌজার কয়েক'শ বিঘা জমির একযোগে স্বত্ব বিনিময় করে ভারতে চলে যান। তাঁরা যাদের সঙ্গে এ বিনিময় করেন তারা ভারতে জমির স্বত্ব এদেরকে ছেড়ে দিয়ে এদেশে আসেন। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর'র বাংলা বিজয়ে পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হন গৌড় বংশীয়রা। এরপর পালিয়ে এসে 'বামনডাঙ্গা' নামক স্থানে বসতি স্থাপন ও জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন গৌড় বংশীয় ব্রাহ্মণ কৃষ্ণকান্ত রায় চৌধূরী (জমিদার)। ছিল বাসগৃহ, অতিথিশালা, রাজদরবার, দুর্গামন্দির, ৩ পিরামিড সদৃশ্য মঠ, ট্রেজারি, গো-শালা ও ২টি হাতিশালা। এসব স্থাপনা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল ইট, সুরকি ও লোহার রড। ২০১০ সালে অবশিষ্ট হাতিশালা ভেঙ্গে ফেলার মধ্য দিয়ে নিশ্চিহ্ন হয় ঐতিহাসিক নিদর্শন 'বামনডাঙ্গা জমিদারবাড়ি'।
অপর এক সূত্রে জানা যায়, মুঘলদের কোচবিহার মহারাজার মুস্তোফীর (সেক্রেটারি) রামেশ্বর ব্রাহ্মণ বামনডাঙ্গা জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ফতেহপুর চাকলার অর্ধাংশ কোচ মহারাজার নিকট থেকে জমিদারী লাভ করেন যা বামনডাঙ্গা পরগণা হিসেবে খ্যাত। রামেশ্বরের পর তাঁর পুত্র বিশ্বেশ্বর, তারপর তাঁর পুত্র কাশিশ্বর বামনডাঙ্গা জমিদারীর একটা অংশ লাভ করেন। তাঁর মৃত্যুতে পুত্র রামচন্দ্র ও কৃষ্ণচন্দ্র জমিদারী লাভ করেন। এরপর ১৭৭৯-১৮০৭খ্রি: পর্যন্ত প্রায় ৩ পুরুষ উত্তরাধিকারী অভাবে তাঁদের দত্তকপুত্রের বিধবা স্ত্রীগণ কোর্ট অব ওয়ার্ডস'র অধীনে পবিত্রাদেবী দক্ষতার সঙ্গেই জমিদারি পরিচালনা করেন। পরবর্তী জমিদার তাঁরই দত্তকপুত্র কার্তিকচন্দ্র ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারী কোর্ট অব ওয়ার্ডসে ন্যস্ত হয় ও ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে সদ্য বয়োপ্রাপ্ত পুত্র নবীনচন্দ্রকে জমিদারী ফেরত দেয়ার পর ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে রায় চৌধূরী উপাধি লাভ করেন। তাঁর সময়ে বামনডাঙ্গা সরোবর খনন ও কয়েকটি শিবমন্দির নির্মিত হয়।
নবীনচন্দ্রের অবর্তমানে ১৮৯০খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ২ পুত্র শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরী ও বীপিনচন্দ্র রায় চৌধুরী ছোট তরফের জমিদারী লাভ করেন। ১৯০১খ্রি: শরৎচন্দ্র মারা গেলে বীপিনচন্দ্র সমগ্র জমিদারী লাভ করেন। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুতে ২ পুত্র মনীন্দ্রচন্দ্র রায় চৌধূরী ও জগচ্চন্দ্র রায় চৌধূরী এ বংশের শেষ জমিদার হিসেবে ভোগ করেন 'বামনডাঙ্গা জমিদারী'। ১৯৪৫-১৯৫০খ্রি: পর্যন্ত মনীন্দ্রচন্দ্র ছিলেন রংপুর জমিদার এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক। একটি সূত্র জানায়, বামনডাঙ্গা জমিদারী (ছোট তরফ ও বড় তরফ মিলে) ছিল সাড়ে ৩৫ সহস্রাধিক একর জমি। জমিদার বীপিন চন্দ্র রায়ের পর তার ২ পুত্র মনীন্দ্র চন্দ্র রায় ও জগচ্চচন্দ্র রায় ছোট তরফের জমিদারীকে আরো ২ ভাগ করে আলাদাভাবে জমিদারী পরিচালনা করতে থাকেন।
এরফলে এই জমিদার বংশের জমিদারী ৩ ভাগে বিভক্ত হয়। তবে ছোট তরফের ২ জমিদার তাদের জমিদারী ঠিকমত পরিচালনা করতে পারলেও বড় তরফের জমিদারী ঠিকমত পরিচালনা করতে না পারায় ব্রিটিশ সরকারকে খাজনা প্রদানে ব্যর্থ হলে ১৯৪৬ সালে বড় তরফের জমিদারী নিলামে উঠে। যা ক্রয় করেন মহারাজা কৃষাণ লাল সিংহ। উভয় জমিদারের এসব জমির মধ্যে অধিকাংশই স্থানীয় প্রভাবশালীরা ভূমিদস্যুতা শুরু করে। তারা নামেে -বেনামে ভোগ করছেন বামনডাঙ্গা জমিদারী জমিগুলো। বর্তমানে ১টি তালগাছ, ১টি খেজুরগাছ, ১টি আমগাছ, ৩টি পুকুরের অংশ বিশেষ ছাড়া জমিদার বংশের আর কোন নিদর্শন নেই। সবই নিশ্চিহ্ন। প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে তোফাজ্জল হোসেন, মোজাম্মেল হক ও খলিল মিয়া জানান, জমিদার বাড়ি, দরবার, মন্দিরের নানা জায়গায় ধন-রত্ন ছিল, শুনেছি। কিন্তু, সেগুলো পরবর্তীতে কি হয়েছে, তা তাদের কিছুই জানা নেই। তবে, তারা জমিদারের বংশধরদের সঙ্গে ওঠা-বসা করেছেন।
এদিকে, বিনিময় সূত্রে জমিদারী আংশিক জমির স্বত্ব দাবী করছেন ভারতের কোচবিহার থেকে ছেড়ে আসা কেতাব উদ্দিনের মৃত্যুতে তার পুত্র আব্দুল আজিজ, ইব্রাহিম হোসেন গং। আব্দুল আজিজের মৃত্যুতে তাঁর উত্তরসূরী আব্দুস সোবহান, ছইদার রহমান, সোলেমান গং ও ইব্রাহিম মিয়ার উত্তরসূরী জয়নাল আবেদীন, আব্দুল জব্বার, বাবু মিয়া গং ও তাদের পরবর্তী ওয়ারিশগণ। জমির মৌজাগুলোর মধ্যে- তালুক রামভদ্র, তালুক বাজিত, তালুক বাছহাটী, তালুক সর্বানন্দ, তালুক সাহাবাজ, তালুক মনমথ, রামভদ্র উল্লেখযোগ্য।
এদিকে, আব্দুল আজিজ ও ইব্রাহিম হোসেনের বংশধরগণ তৎকালীণ জমিদারের জমির প্রাপ্যতা সূত্রে দাবী জানিয়ে জায়গা-জমি উদ্ধারে আইনগত সহযোগীতা কামনা করছেন। ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা রওশন আলম জানান, জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর কিছু জমি মালিকানায় চলে গেছে, কিছু জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প, স্কুল, মসজিদ, বাজার হয়েছে, কিছু খাস খতিয়ান ভুক্ত হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২ দফায় নির্মিত আশ্রয়ণ পকল্পের সুবিধা ভোগ করছেন। অধিকার বঞ্চিত ভুক্তভোগী ও সচেতন মহল 'বামনডাঙ্গা জমিদারী' জমিজমাসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অনুসন্ধানে ব্যবস্থা গ্রহণ পূর্বক ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান।