বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক ও মুন্সীগঞ্জ-৩ আসন থেকে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতা ও আত্নীয় স্বজন দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন ও পুলিশকে মারধরের কারণে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তার কপাল পুড়তে পারে। এমনটাই মনে করেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।
মৃণাল কান্তির বিরুদ্ধে নিজ সংসদীয় আসনে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংসদ সদস্য ও নেতা যাদের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে ওপরের দিকেই রয়েছে মৃণাল কান্তির নাম।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, এবার কারো মুখ দেখে মনোনয়ন দেয়া হবে না। জনবিচ্ছিন্ন বিতর্কিত কাউকে মনোনয়ন দিবেন না। এসব কারণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মৃণাল কান্তি দাস নিজের জনপ্রিয়তা বোঝাতে ১১/০৭/২০২৩ তারিখে নির্বাচনী শো-ডাউন করেন। জনসমর্থন দেখাতে তিনি সংসদীয় আসনের বাইরে শ্রীনগর, টঙ্গিবাড়ি উপজেলা এমনকি নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকেও লোক ভাড়া করে আনেন। আবার মহিলাদের আটা দিবেন বলে স্লিপ দিয়ে মুন্সিগঞ্জে এনে সমাবেশে বসিয়ে রাখেন। যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
গত ৭ জুন ২০২৩ খ্রি. তারিখে মুন্সিগঞ্জ জেলা স্টেডিয়ামে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সামনে ইউনিফর্ম পড়া দায়িত্বরত অবস্থায় মুন্সিগঞ্জ সদর থানার ওসিকে জনসম্মুখে উচ্চস্বরে গালাগালি করেন মুন্সিগঞ্জ -৩ আসনের এমপি মৃনাল কান্তি দাস। বিষয়টি নিয়ে এমপির লোকেরা অপ-প্রচার করে যে, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধমক দেওয়ায় ওসিকে বকাবকি করেছেন এমপি।
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল মৃধার নেতৃত্বে সদর উপজেলা, শহর ও সরকারি হরগঙ্গা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি, সধারণ সম্পাদক সহ প্রায় কয়েক'শ নেতাকর্মী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়টি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল মৃধা ও সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুরুজ মিয়া সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য আকারে প্রকাশ করেন। তারা বলেন ওসি আসলে মন্ত্রীকে প্রোটোকল দিচ্ছিলেন এমন সময় হঠাৎ করে মন্ত্রীর সামনে উচ্চস্বরে ওসিকে বকাবকি শুরু করেন এমপি মৃনাল কান্তি দাস। ওসির সাথে তার ব্যক্তিগত বিরোধ ও প্রতিমন্ত্রীর সামনে মুন্সিগঞ্জে তার অবস্থান বোঝানোর উদ্দেশ্যে মূলত তিনি এ কাজটি করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। তার কথামতো আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা না নেওয়ায় ওসির উপর আগে থেকেই ক্ষিপ্ত ছিলেন জনবিচ্ছিন্ন এই এমপি।
জেলার আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ মানুষের প্রশ্ন - ইউনির্ফম পরা দায়িত্বরত পুলিশ পরিদর্শক যেখানে তার প্রতিহিংসার শিকার হয়, সেখানে আমাদের কি অবস্থা বুঝে নিন!
এদিকে, পুলিশকে ও আওয়ামী লীগ কর্মীকে মারধর সহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকার কারণে এবার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্নাঙ্গ কমিটি থেকে বাদ পরেছেন এমপি মৃণাল কান্তি দাসের ভাতিজা আপন দাস। তিনি পূর্বের কমিটির উপ-আইন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে প্রচারনায় অংশ নেয়। ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের তার সাথে সার্বক্ষণিক দেখা যায়। সর্বশেষ ২১/০৬/২০২৩ তারিখে তিনি পিবিআইয়ের এক পুলিশ কর্মকর্তাকে মারধর করে বলেন "তোর এসপি বাপকে গিয়ে বলিস আমি এমপির ভাতিজা, পারলে কিছু করতে।"
তখন পুলিশকে মারধর করার প্রতিবাদ করায় শহর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক বাদশা বিপ্লবকেও তিনি তার লোকজন নিয়ে মারধর করেন।
মুন্সিগঞ্জ ৩ আসনের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসের বাবার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকার ও পিস কমিটিকে সহযোগিতার অভিযোগ করেন যুদ্ধকালীন সময়ে মুন্সিগঞ্জ জেলা কমান্ডার, জেলা আওয়ামী লীগ সিনিয়র সহ-সভাপতি, উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আনিসুজ্জামান আনিস। অথচ তিনি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদকও। দলীয় এমন একটি পদে থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে আশকারা দেওয়ায় ক্ষোভ বিরাজ করছে তার নিজ দলের মধ্যেই।
মুন্সিগঞ্জের তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, মৃণাল কান্তি দাস আওয়ামী লীগের এমপি হয়েও সরাসরি বিএনপির লোকজনকে আশ্রয়-প্রশয় দিচ্ছেন। এমনকি বজ্রযোগিনী ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সভাপতি বাবু মুন্সি এমপির প্রশ্রয়ে পুরো ইউনিয়নেই মাদক কারবার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি এই বাবুকে সব সময়ই এমপি মৃণাল কান্তির আশপাশে দেখা যায়। উল্লেখ্য, বাবু মুন্সির আপন চাচা বিএনপির ধানের শীষের চেয়ারম্যান ছিলেন। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ভাঙচুর করে সেগুলোতে অগ্নিসংযোগের পর সেখানে মুত্রত্যাগও করেছিল এই বাবু। গত উপ নির্বাচনেও তার আপন চাচাতো ভাই নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রার্থী হন।সেখানেও মৃণাল কান্তির সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়।
গজারিয়া উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি,বর্তমানে যুবদল নেতা আসাদুজ্জামান (জামান) এমপি মৃণাল কান্তির মদদে উপজেলার কলকারখানা থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করেন। এমপি গজারিয়ায় গেলে তার সাথে সব সময়ই এই জামানকে দেখা যায়। এমপির ক্ষমতায় তিনি তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অত্যাচার করে চলেছেন।
গজারিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক মেধাবী ছাত্র মাহবুব আলম ছোটন হত্যার মূল আসামি, উপজেলা যুব দলের সাবেক সহ-সভাপতি, কুখ্যাত সন্ত্রাসী ভূমিদস্যু মিজান এমপি মৃণাল কান্তির সহযোগী হিসেবে পরিচিত।
বিগত ৩০ মে ২০২৩ তারিখে রামপাল, পঞ্চসার, বজ্রযোগিনী ও মহাকালী ইউনিয়ন সেচ্ছাসেবক লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি মোঃ তোফাজ্জল হোসেন তার বিএনপির নিজ পদ ব্যবহার করে এমপি মৃণাল কান্তির ছবি দিয়ে সম্মেলনের সফলতা কামনা করে ব্যানার করেন।
যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ গজারিয়া উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আমিরুল ইসলামের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট বালুয়াকান্দি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন প্রধানসহ আরো দুজনকে হত্যা করে এমপি মৃণালের প্রার্থী রেফায়েত উল্লাহ খান তোতা। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য এমপি তার ঘনিষ্ঠ নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের আসামি নূর হোসেন গ্রুপকে ভাড়া করেন বলেও অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। নূর হোসেন যে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তা সিআইডির তদন্তেও প্রকাশ পেয়েছে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ ওরফে বাঘা মহিউদ্দিনের বাসা থেকে যুবলীগ নেতা নেতা আবু সিদ্দিককে নৃশংসভাবে হত্যা করে জিয়া, কামাল, জামাল ও ফরিদ গংরা। একই গ্রুপ ২৪/০১/২০২২ইং তারিখে মুন্সিগঞ্জ শহর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সিফাতকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে। মূলত এই সন্ত্রাসী গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে মৃণাল কান্তি দাসের বিরুদ্ধে। মৃণাল কান্তি সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডে এইসকল বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসী, খুনী গ্রুপটিকে পাশে রাখেন।
মুন্সিগঞ্জের উত্তর ইসলামপুরের চাঞ্চল্যকর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা হত্যা(ট্রিপল মার্ডারের) মূল পরিকল্পনায় এমপি মৃণাল কান্তি দাসের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত গালিবের নাম সিআইডির তদন্তে উঠে এলেও নানা চাপে তা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। উল্টো গালিব সহ আসামীদের মৃণাল কান্তির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে দেখা যায়।
২০১৬ সালের ১১ জুন পবিত্র রমজান মাসে তারাবির নামাজ আদায়রত অবস্থায় ছাত্রলীগের এক কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে বাবুল নামের সন্ত্রাসী। কিন্তু এখনো এই সন্ত্রাসী ও মাদকসেবী বাবুল সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
গত বছর ১৩ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম পৌর কাউন্সিলর লিটনের একমাত্র পুত্র ঝলক হত্যার মূল আসামি বিএনপি-জামায়াতের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ঝিল্লু এমপি মৃণাল কান্তির সরাসরি আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পালিত। এই হত্যাকাণ্ডের পর এমপির বিরুদ্ধে জুতা মিছিলও করেছিল স্থানীয়রা। মৃণাল কান্তির সঙ্গে সখ্যের কারণে বিএনপির ক্যাডার ঝিল্লু মিরকাদিমে মাদক ব্যবসা, জমি দখল থেকে শুরু করে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করছেন না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মৃণাল কান্তি দাস বলেন, ‘আপনাকে যারা এসব মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন তারাই সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষক। ১৭ বছর থেকে রাজনীতি করি, কোনো দিন কোনো দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিই নাই। ঝলক হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি সন্ত্রাসী ঝিল্লু তাদেরই মিত্র যারা আপনাকে তথ্য দিয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাবু মুন্সিকে আমি চিনি। আমার কাছে সে আসে। যতদূর জানি তার বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র মামলা রয়েছে, যা আদালতে বিচারাধীন। তবে আমি কোনো সন্ত্রাসীকে লালনপালন করি না, সততা নিয়ে রাজনীতি করি। যারা আপনাকে তথ্য দিয়েছে, তারাই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে মোটাতাজা হয়েছে।’
তবে মৃনাল কান্তি দাসের স্বাধীনতা বিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সন্ত্রাসীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।