ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ফেরিওয়ালা মিরাজুল হক। সড়কে ঘুরে হাতপাখা ও রুমাল বিক্রি করে সংসার চালান তিনি। বর্তমানে তার অভাবের ঘরে বইছে আনন্দের জোয়ার।
কারণ, এলাকায় সফল বাবা হিসেবে মিরাজুল প্রশংসায় ভাসছেন। তার বড় ছেলে জাহাঙ্গীর মোল্লা ৪১তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। অপরদিকে ছোট ছেলে আলমগীর মোল্লা জাতীয় দলের ফুটবলার। এতে যেন বাবার দীর্ঘ জীবনসংগ্রাম সার্থক হলো।
মিরাজুল হক জানান, তিনি ১৯৭৮ সাল থেকে কালীগঞ্জ উপজেলা শহরের বাসস্ট্যান্ডে যানবাহনে ফেরি করে হাতপাখা, রুমাল-গামছা বিক্রি করেন।
তার স্ত্রী জুলেখা বেগমও একই শহরের অগ্রণী ব্যাংকের পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কাজ করেন। দুজনের আয়ে কষ্টের সংসার। শহরের কলেজপাড়ার দুই কক্ষের টিনশেডের ঘরে থাকেন।
তিনি আরও জানান, টাকার অভাবে দুই মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করাতে পারেননি। বিয়ে দিয়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু দুই ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতেন।
এ স্বপ্ন অন্তরে বুনে চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। দুই ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। বড় ছেলে জাহাঙ্গীর সমাজকল্যাণ ও গবেষণা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। ছোট ছেলে আলমগীর বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র ও জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়।
সংগ্রামী এ বাবা বলেন, ‘আমার স্বপ্নের দুই ছেলে ঘরে আলো জ্বালিয়েছে। ভবিষ্যতে আর আমার ফেরি করে সংসার চালাতে হবে না।’
মা জুলেখা বেগম বলেন, ‘আমার এক ছেলে বিসিএস ক্যাডার ও অপর ছেলে জাতীয় দলের খেলোয়াড়। আল্লাহ আমার আচলে ভিক্ষা দিয়েছেন। আমাদের কষ্ট পরিপূর্ণ হয়েছে। আমি ব্যাংকের পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কাজ করে ছেলেদের মানুষ করেছি।’
এসব বিষয়ে কথা হয় বড় ছেলে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাবা ও মায়ের স্বল্প আয়ে আর টিউশনি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করেছি। বর্তমানে বড় সিমলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছি। মা-বাবার মনের আশা পূরণ করতে বিসিএস পরীক্ষা দেই।’
ছোট ছেলে আলমগীর বলেন, ‘আমরা চার ভাইবোন খুব কষ্টে মানুষ হয়েছি। স্বল্প শিক্ষিত করে দুই বোনকে মা-বাবা বিয়ে দিয়েছেন। বাবা রাস্তায়, ফুটপাতে ফেরি করে এবং মা ব্যাংকে পরিচ্ছন্নতার কাজ করে আমাদের লেখাপড়ার খরচ ও সংসার চালাতেন। আমি এখন জাতীয় দলের ফুটবলার। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। আমরা মা-বাবার ঋণ কোনো দিন শোধ করতে পারব না।’
প্রতিবেশী আব্দুল কাদের বলেন, ‘মিরাজুল খুবই গরিব মানুষ। কত কষ্ট করে আমাদের সামনে জীবন পার করেছেন। তারপরও দুই ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করেছেন। এতে আমরা খুব খুশি।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ইসরাত জাহান বলেন, ‘যারা ছোট পেশায় আছেন, নিজেরা প্রতিষ্ঠিত না হতে পারলেও কষ্ট করে সন্তানকে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, সেসব মানুষের কাছে ফেরিওয়ালা মিরাজুল হক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।’