শনিবার ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২ পৌষ ১৪৩১

শিরোনাম: কর্মোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব   নববর্ষের আনন্দ যেন বিষাদের কারণ না হয়: রাষ্ট্রপতি   নির্বাচনে ২১ সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন ইসির   দেশজুড়ে যে তিনদিন মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা!   মির্জা ফখরুলের জামিন শুনানি ৯ জানুয়ারি   প্রাথমিকের ছুটি বাড়ল ১৬ দিন (তালিকা)   নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিএনপির প্রচারণা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী হিসেবে তিনি হয়ে ওঠেন সবার ‘পান্না ভাবি’
লেলিন চৌধুরী
প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০২৩, ১০:১৩ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

১৯৭২ সালের সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। শিখরস্পর্শী গৌরব এবং অতলছোঁয়া বেদনার সম্মিলনে রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের সবুজ ক্যানভাসে তখন অভূতপূর্ব কালজয়ী সব ছবি অঙ্কিত হচ্ছে। তার মধ্যে একটি চিত্রকর্মের নাম দেওয়া যেতে পারে ‘দীপ্তিময় দুর্দম মা’। বাইশ বছরের গৌরবর্ণা দীর্ঘাঙ্গী এক নারী, পরনে কালোপেড়ে সাদা সুতির শাড়ি। 

ডান হাতে কোলে একটি ছেলেশিশু এবং বাঁ হাতে ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়েশিশুকে ধরে আছেন। তাঁর অবয়বে ফুটে উঠেছে একাত্তরের বাংলাদেশের সব দৃঢ়তা এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার গভীর প্রত্যয়। সেই নারীর নাম ‘সাইফুন্নাহার চৌধুরী’। কিন্তু সারা বাংলাদেশ তাঁকে জানল ‘পান্না কায়সার’ নামে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের সুযোগ্য জীবনসঙ্গিনী তিনি।

১৯৫০ সালের ২৫ মে জন্মগ্রহণ করেন সাইফুন্নাহার চৌধুরী। তাঁর ডাকনাম পান্না। ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। 

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদুল্লাহ কায়সারকে ধরে নিয়ে যায় কুখ্যাত আলবদর বাহিনী। তিনি আর ফিরে আসেননি। এর মধ্যে তাঁর দুই সন্তান শমী কায়সার আর অমিতাভ কায়সার জন্মগ্রহণ করেছে। দুই সন্তান নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পথচলার সঙ্গে পান্না কায়সারের জীবনসংগ্রামও শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে তিনি দেশের বৃহত্তম শিশু–কিশোর সংগঠন খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। মা হিসেবে পান্না কায়সার অনুভব করতেন, একটি বাসযোগ্য মানবিক বাংলাদেশ গড়তে হলে সবার আগে গড়ে তুলতে হবে এ দেশের শিশু–কিশোরদের। শিশু–কিশোরদের গড়ে তোলার ব্রতে আমৃত্যু অটল ছিলেন তিনি।

শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী হিসেবে তিনি হয়ে ওঠেন সবার ‘পান্না ভাবি’। একসময় তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

পান্না কায়সারের প্রধান পরিচয় হলো, তিনি লেখক। তাঁর লেখা প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৩। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে’, ‘মুক্তি’, ‘নীলিমায় নীল’, ‘অন্য কোনোখানে’, ‘রাসেলের যুদ্ধযাত্রা’, ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’, ‘দাঁড়িয়ে আছে গানের ওপারে’, ‘মানুষ’, ‘না পান্না না চুনি’, ‘অন্য রকম ভালোবাসা’, ‘সুখ’ প্রভৃতি। লেখালেখিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন কলেজশিক্ষক।

পান্না কায়সার একদিকে যেমন শিশুসংগঠক, সাংস্কৃতিক সংগঠক, লেখক, সংসদ সদস্য; অন্যদিকে সক্রিয় আন্দোলনকর্মীও বটে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম নেতা তিনি। অপসংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে দেশের সাংস্কৃতিক জগৎকে মুক্ত রাখার লড়াইয়ের অকুতোভয় বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব তিনি।

প্রতিকূল ঝোড়ো হাওয়ার আঘাতে বারবার জর্জরিত হতে হয়েছে তাঁকে। স্বামীর ঘাতকদের ক্ষমতার মসনদে দেখেও তিনি দমে যাননি, কর্মপ্রবাহকে থামিয়ে দেননি। মুক্তিযুদ্ধের পথ অনুসরণ করে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্যই তাঁর সাংস্কৃতিক বোধ দেশপ্রেমী ও মানবপ্রেমী রাজনৈতিক ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ জন্য তাঁর মৌলিক সংগঠন ছিল ‘খেলাঘর’।

আগেই বলেছি, পান্না কায়সারের চারদিকে ছিল পরিব্যাপ্ত কর্মপ্রবাহের বিশাল স্রোত-একদিকে শিশুসন্তানদের লালন-পালন; অন্যদিকে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজের জীবনধারাকে সচল রেখেছেন। তাঁর একক লড়াইয়ের বিশাল শক্তি তিনি সংগ্রহ করেছেন বুকের গভীরে সঞ্চিত শহীদুল্লা কায়সারের স্মৃতি থেকে। অথবা বলা যায় শহীদুল্লা কায়সার নামের অমর মানুষটি তাঁর বুকের ভেতর একটি পরশপাথর ছুঁইয়ে দিয়েছিলেন, যার নাম ছিল ‘মানুষের প্রতি ভালোবাসা’। যা তাঁকে জীবনব্যাপী উদ্দীপ্ত রেখেছে। এখানে বলা দরকার যে তাঁদের দাম্পত্যজীবন ছিল মাত্র দুই বছর দশ মাসের।

১৯৭৬ সালে খেলাঘরের সঙ্গে যুক্ততার সূত্রে বিপুলকর্মা এই মানুষের কাছ আসার সুযোগ হয় আমার। তাঁর সামর্থ্য ও দৃঢ়তা বহুবার বহুভাবে প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছে। আমাদের দেশে অনেকেই নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর কর্মসামর্থ্য বাড়িয়ে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের ব্যাপৃত রেখেছেন। আমার মনে হয়, তাঁদের জন্য একটি ‘কেস স্টাডি’ হতে পারে পান্না কায়সারের পুরো জীবন। বয়সে তরুণ এক নারী দুটি শিশুসন্তান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করেন। সন্তানদের গড়ে তোলেন, নিজে কলেজশিক্ষকতায় যোগ দেন। উপরন্তু সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত করেন এবং লেখালেখিও করেন। এই যে একজীবনে এত বিপুল কাজ তিনি কীভাবে করলেন, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়! একটি অসাধারণ জীবনের নাম হলো পান্না কায়সার।

তিয়াত্তর বছর পার করে চুয়াত্তরে পৌঁছে প্রয়াত হলেন আমাদের ‘পান্না ভাবি’। পান্না কায়সারের মতো মানুষের চলে যাওয়া সব সময়েই হাহাকার জাগানিয়া। আমরা এখন রিক্ত বোধ করছি। তিনি দূরবর্তীতম গ্যালাক্সির নক্ষত্রের মতো আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছেন। দূরবর্তী সেই নক্ষত্রের আলো যেমন প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে স্পর্শ করে যায়, তেমনি পান্না ভাবির কর্মপ্রভা প্রতিদিন আমাদের ছুঁয়ে যাবে। আর সে পরশের লুকানো কথা আমাদের কানে বলে যাবে, ‘মানুষকে ভালোবাসো, ভালোবাসো দেশকে।’

লেখক: খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Vorer-pata-23-12-23.gif
http://www.dailyvorerpata.com/ad/bb.jpg
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Screenshot_1.jpg
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]