রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেফতার দুই চিকিৎসকের মুক্তির দাবিতে দুই দিনের কর্মবিরতি পালন করছেন সারাদেশের গাইনি চিকিৎসকরা। এসময়ে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা ও অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। তাদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে একই পথে হেঁটেছেন অন্যান্য চিকিৎসকরা। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ রোগী কার্যত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে দেশের লাখ লাখ রোগী পড়েন চরম বিপদে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে অনেক রোগী জানতে পারেন, চিকিৎসকরা চেম্বার করছেন না। দুদিন ধরে চিকিৎসকদের লাগাতার কর্মসূচিকে অমানবিক বলছেন ভুক্তভোগীরা।
চিকিৎসকদের কর্মবিরতি পালনের দ্বিতীয় দিনে রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, অসুস্থ শিশু, মুমূর্ষু রোগী ও প্রসূতিদের নিয়ে অসহায় সময় পার করছেন স্বজনরা। চেম্বার বন্ধ থাকায় সারা দেশে অসংখ্য গর্ভবতী নারীসহ গাইনিকোলজিক্যাল সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এদিন সকালে ধানমন্ডির সেন্ট্রাল হসপিটাল, তেজগাঁওয়ের শমরিতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মহাখালীর মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, গ্রীন রোডের কমফোর্ট, গ্রীন রোডের গ্রীন লাইফ হাসপাতাল, স্কয়ার ও বিআরবি হাসপাতালে প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে। আন্দোলনে থাকা চিকিৎসকরা বলেন, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই তারা এই কর্মসূচি পালন করছেন।
ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর নবজাতক ও প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় দুই নারী চিকিৎসককে গ্রেফতার বেআইনি দাবি করে এই কর্মসূচি পালন করছেন দেশের পেশাজীবী ৩৬টি সংগঠনের চিকিৎসকরা।
দেশের গাইনি চিকিৎসকদের সংগঠন অবস্ট্রেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) শনিবার কর্মবিরতির কর্মসূচি ঘোষণা করে। তাদের পাশাপাশি মেডিসিন, সার্জারিসহ ৩৬টি সংগঠনের প্রায় ৫০ হাজার চিকিৎসক এই কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই বেসরকারি হাসপাতালে শুরু হয় অচলাবস্থা।
এদিকে ওজিএসবি চিকিৎসকদের এই কর্মসূচির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও। তারা বলছেন, প্রসূতি সেবা বন্ধ রাখা আর সাধারণ জ্বর উঠলে কিছু টেস্ট লিখে দেওয়া এক নয়। চিকিৎসকের মূল কাজ মানবতার সেবা। মানুষের জীবন রক্ষায় অবদান রাখা। কোনোভাবেই রোগীকে মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া তাদের কাজ হতে পারে না।
একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, কোনো চিকিৎসক সংগঠন হুট করে এ ধরনের কর্মসূচি দিতে পারে না। রোগীকে জিম্মি করে এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়ার আগে সরকারের কাছে দাবি জানানোর সুযোগ র্ছিল। সেই দাবির অংশ হিসাবে তারা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য উচ্চ পর্যায়ে স্মারকলিপি দিতে পারত। কিন্তু এর কোনোটিই না করে সরাসরি চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেওয়া দেশের রোগীদের সঙ্গে বেইমানির শামিল। ওজিএসবির ঘোষিত কর্মসূচির আগে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত দরকার ছিল বলে মন্তব্য করেন তারা।
জানা গেছে, সাধারণ মানের একটি ক্লিনিকেও প্রতিদিন গড়ে ছোট-বড় অন্তত ১০টি অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ের বড় হাসপাতালে ৩০ থেকে ৫০টি অপারেশন (ওটি) হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৪ হাজার ৭০০টি। এর প্রতিটি হাসপাতালে গড়ে ১৫টি করে অস্ত্রোপচার হলেও দিনে প্রায় অর্ধলক্ষের বেশি অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। একইভাবে নিবন্ধিত প্রায় ১৫ হাজার হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারেও কয়েক লাখ রোগী চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ নিয়ে থাকেন। পেশাজীবী চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে দেশের লাখ লাখ রোগীর জরুরি সেবা ঝুঁকিতে পড়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগী ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘চিকিৎসা আমাদের অধিকার। অন্যদের সমস্যার কারণে আমাদের কেন ভোগান্তিতে পড়তে হবে? আজ যদি কোনো রোগী মারা যায়, সে দায় চিকিৎসকদেরই নিতে হবে।’
তবে চিকিৎসকদের কর্মবিরতির দাবির সঙ্গে বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) একাত্মতা জানায়নি বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির মহাসচিব ডা. এহতেশামুল চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘ধর্মঘটের কারণে চিকিৎসা সংকট দেখা দিলে তার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠনের, বিএমএ কোনো দায় নেবে না। দেশের এ ক্রান্তিকালে (ডেঙ্গু পরিস্থিতি)) হাসপাতাল বা চেম্বার বন্ধ রাখা যাবে না।’
এ চিকিৎসক নেতা বলেন, ‘বিএমএ কোনোভাবেই এর সঙ্গে যুক্ত নয় এবং এ হঠকারী সিদ্ধান্ত সমর্থন করে না। ধর্মঘটের কারণে যদি কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে, তার দায়িত্ব সেসব সংগঠনের এবং সরকার দেশের প্রচলিত আইন তাদের ওপর প্রয়োগ করতে পারবে। আমরা দেখবো দুই দিন দেখবো তারা ধর্মঘট পালন করে কি না, তারপর ব্যবস্থা নেবো। আমরা ৬৪ জেলায় জানিয়ে দিয়েছি, বিএমএ এ ধর্মঘটের বা এ ধরনের কোনো কর্মসূচির সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃক্ত নয়।’
জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ফয়জুল হাকিম, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রওশন আরা, জনস্বাস্থ্য সংগঠক অনুপ কুন্ডু ও সামিউল আলম দুই দিন দেশের ক্লিনিক্যাল চিকিৎসকদের ৩৬টি সংগঠনের ডাকে ১৭ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টারে সব ধরনের চিকিৎসা, পরামর্শ ও অপারেশন বন্ধের সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এক বিবৃতিতে তারা বলেন, এর ফলে (কর্মবিরতি) ডেঙ্গুর বর্তমান বিপদজনক পরিস্থিতিতে আক্রান্ত রোগীদের সুচিকিৎসা হুমকিতে পড়বে।