‘রাঘব-বোয়ালরা’ চলে গেলেও রেখে গেছেন কিছু ‘ডালপালা’। যাওয়ার আগ মুহূর্তে বড় কর্তারা শিখিয়ে গেছেন কিভাবে ফাইল দিয়ে নিয়মকে ‘বন্দি’ করে অনিয়ম করতে হয়। কিছুদিন পরপরই শুরু হয় বিভিন্ন কর্মকর্তা নিয়ে আলোচনা। সবার মুখে একটাই কথা ‘শুধু টাকা’। এই নেশাতেই মাতোয়ারা এই দপ্তরের বেশ কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। সম্প্রতি সাবেক একজন প্রধান প্রকৌশলী সিন্ডিকেটের কারণেই ‘না-কি’ এই টাকার নেশায় সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটিতে সবাই ‘বন্দি’। উদ্দেশ্য একটাই কে কোন বড় প্রকল্পে দায়িত্বে পাবে; সেখান থেকেই ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজসে হবে টাকায় ‘মেনেজ’। এমনিই অভিযোগ উঠেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে ভান্ডার সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহমুদ কবীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে। তার নামে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ে সচিব বরাবর রেজাউল করীম নামে এক ব্যক্তি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ছাত্রদলের সাংগঠনিক মাহমুদ কবীর চৌধুরী। বিএনপি-জামাতপন্থী কর্মকর্তাকে শতকোটি টাকার প্রকল্প পরিচালক বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী। যা নিয়ে দেখে দিয়েছে বির্তকিত প্রতিক্রিয়া। গুণজন শোনা যাচ্ছে, কোটি ঘুষের বিনিময়ে প্রকল্প পরিচালক হতে যাচ্ছে মাহমুদ কবীর চৌধুরী। অধিদপ্তরে কর্মরত বিএনপি-জামাতপন্থী অন্যান্য নেতাদের সাথে নিয়ে বিএনপি জামাতপন্থী সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে গোপনে ঐক্যবন্ধ করে অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করছেন মাহমুদ।
উল্লেখ্য, যে ভবন নির্মাণের পর থেকে ঢাকাস্থ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ভবনটির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল ঢাকা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর উপর। দীর্ঘ দিনের নিয়ম উপেক্ষা করে সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান ভবনে এবং অধিদপ্তরে বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে সংগঠিত করার জন্য ভান্ডার সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এক সময়ের চুয়েট ছাত্রদলের নেতা মাহমুদ কবীর চৌধুরীর হাতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ভবন রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তুলে দেন। সেই থেকে ভবনের নিরাপত্তা সাবেক ছাত্রদল নেতাদের হাতে চলে যায়।
সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উদযাপিত সকল অনুষ্ঠান যেমন- ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ৭ মার্চ সহ অধিকাংশ জাতীয় অনুষ্ঠান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরেই অনুষ্ঠিত হয়, এবং সকল অনুষ্ঠানের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। ভবনের নিরাপত্তা গার্ড, পরিচ্ছন্ন কর্মী এবং ভবনের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার নিয়ন্ত্রণে থাকার সুবাদে তিনি সুকৌশলে ভবনে অনেক নাশকতা মূলক কার্য পরিচালনা করে আসছেন। তার নেতৃত্বে অধিদপ্তরে এবং ‘চুয়েটে’ সংগঠিত অসংখ্য নাশকতা মূলক ঘটনার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করা হল।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) লেখা পড়ার সময় চুয়েটের ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট এক আতঙ্কের নাম ছিল মাহমুদ কবীর চৌধুরী। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চুয়েট ক্যাম্পাসে অবস্থান কালে তৎকালীন চুয়েট ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী তার চরম নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। পায়ে গুলি করা, রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা, সিগারেটের আগুন দিয়ে শরীরে ছেকা দেয়া, শীতের রাতে পুকুরের পানিতে ‘চুবানো’ নির্যাতনের এহেন কোন ধরন নাই যা তিনি ছাত্রলীগ নেতাদের উপর ব্যবহার করেনি।
মাহমুদ কবীর চৌধুরী চুয়েটের ‘তারেক-হুদা’ হলের ছাত্র ছিলেন। হল এবং ক্যাম্পাসের সকল ছাত্ররা তার ভয়ে সব সময় আতংকগ্রস্থ থাকত। ঐ হলের ছাত্রলীগ কর্মী তারেককে মাঘ মাসের শীতের এক রাত্রিতে সে এবং তার বাহিনী রুম থেকে ধরে নিয়ে পুকুরের ঠান্ডা পানিতে ‘চুবায়’। তারপর পানি থেকে তুলে এনে সিগারেটের আগুন দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ‘ছ্যাকা’ দেয়। চুয়েটের দক্ষিণ ছাত্রাবাসের ছাত্রলীগ কর্মী শাহীন। মাহমুদ কবীর চৌধুরীর নির্দেশে এক রাতে তার বাহিনী শাহীনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাকে রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে একটি ঝোঁপের পাশে ফেলে রাখে। চুয়েটের ছাত্র থাকাবস্থায় ছাত্রলীগ/বামসংগঠনের এমন অসংখ্য নেতাকর্মী চুয়েট ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদ কবীর চৌধুরীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে।
তার অত্যাচার নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন বাম সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাহমুদ কবীর চৌধুরী এবং তার ‘টর্চার বাহিনীর’ বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করলে ১৯৯৪ সালের নভেম্বর মাসে সে চুয়েট ক্যাম্পাস থেকে অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় এবং অনেক দিন জেল খেটে জামিনে মুক্তি লাভ করে। এমন একজন বিএনপি পন্থী কর্মকর্তা কিভাবে আওয়ামীলীগের শাসনামলে কাদের ছত্রছায়ায় থেকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ভবন নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং ভবনে বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করে চাকুরী করে যাচ্ছেন তা সংশ্লিষ্ট সকলেরই প্রশ্ন।
সূত্র আরো জানায়, শহীদ শেখ রাসেল দিবস উদযাপনের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০২১ সালে ভবনের সামনে শেখ রাসেল চত্ত্বর প্রতিষ্ঠা করা হয়। পোর্চের নীচে রাসেল চত্ত্বরের মূল বেদীতে শেখ রাসেলের লাইটিং যুক্ত ১টি ছবি এবং তার দুই পাশে শেখ রাসেলের আরও দুইটি বড় ছবি স্থাপন করা হয়। মূল বেদীর দুই পাশে ভবনের বাগান পরিবেষ্টিত (কিছু অংশবাদ দিয়ে) করে বাগানের পূর্ব এবং পশ্চিত পার্শ্বে প্রায় দেড়শত ফুট জায়গাজুড়ে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ছবি দিয়ে রাসেল চত্ত্বর সুসজ্জিত ছিল। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে স্থাপিত সমুজিত রাসেল চত্ত্বরটি ২০২২ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় এক বছরের অধিককাল অক্ষত অবস্থায় ছিল। ‘১০ ডিসেম্বর ২০২২ খ্রিঃ তারিখ টার্গেট করে বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা যখন সরকার উৎক্ষাতের হুংকার দেয়া শুরু করে তখন থেকেই ভবনে বিএনপি পন্থীদের আনাগোনা বেড়ে যায়।
জনশ্রুতি আছে, ঐ সময়ে ভবনে আগত বিএনপি নেতারা তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীকে ভবনের সামনে থেকে রাসেল চত্ত্বরসহ ভবনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় নেতাদের ছবি অপসারনের জন্য অনুরোধ করেন। তারই এক পর্যায়ে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী ভবন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সাবেক ছাত্রদল নেতা মাহমুদ কবীর চৌধুরীর মাধ্যমে মূল বেদীতে শেখ রাসেলের একটি ছবি রেখে শেখ রাসেলের অন্য দুইটি ছবিসহ বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত সকল ছবি ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম সপ্তাহের কোন এক রাতের আধারে ভবন থেকে অপসারন করে ফেলে। ভবনের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বে থাকা মাহমুদ কবীর চৌধুরী কোন অবস্থাতেই এর দায়ভার এড়াতে পারে না।
বিষয়টির প্রতিবাদে ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমানের সাথে ভবনের আওমীলীগপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চরম বাক বিতণ্ডা হয়। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত পূর্বক দোষীদের সনাক্ত করে শাস্তি প্রদানের জন্য প্রধান প্রকৌশলীকে অনুরোধ করা হলে তিনি ঐদিনই তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী) মো. সরোয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত টীম গঠন করে। যেহেতু ভবন পরিচালনা, রক্ষনাবেক্ষন ও সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব মাহমুদ কবীর চৌধুরীর উপর ন্যাস্ত, তাই তার নির্দেশনা ছাড়া এই ধরণের নাশকতামূলক কাজ কোন কর্মচারী করতে পারে না। ভবনের নীচে ফাঁকা গোল চত্ত্বরে ‘বঙ্গবন্ধু কর্ণার’ স্থাপন করা হয়েছে। উক্ত বঙ্গবন্ধু কর্ণারে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের যে ‘থ্রী-ডি’ ভিডিও স্থাপন করা হয়েছে সেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়ে বিকৃতভাবে ভাষণটি রেকর্ডিং হয়েছে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন উক্তি বিকৃতভাবে ভবনের দেয়ালে বা পোষ্টারে/ব্যনারে লেখা হয়। এ বিষয়ে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা কর্মচারীদের পক্ষ থেকে বার বার সাবেক প্রধান প্রকৌশলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও তিনি এসব ভূল সংশোধন করেননি।
একনাগারে দীর্ঘ ১৪ বছরের অধিককাল যাবত দল ক্ষমতায় থাকলেও অধিদপ্তরের আওয়ামীপন্থী প্রকৌশলীরা কোনঠাসা অবস্থায় পড়ে আছেন। পক্ষান্তরে বড় বড় প্রকল্প এবং গুরুত্বপূর্ণ সকল পদ বিএনপিপন্থী প্রকৌশলীদের দখলে। অধিদপ্তরের বিএনপি-জামাতপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যখন মাহমুদ কবির চৌধুরী ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে তখন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী কর্তৃক এ ধরনের একজন বিএনপিপন্থী প্রকৌশলীকে আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করায় জনমনে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক কর্মকর্তা ভোরের পাতাকে বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিপন্থী একজন প্রকৌশলীর হাতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এত বড় প্রকল্পের দায়িত্ব তুলে দেয়া বৃহত্তর কোন নাশকতামূলক পরিকল্পনার অংশ কিনা তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখার উচিত। তিনি ছাত্র জীবনে ছাত্রদলের রাজনীতি এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সাথে জড়িত ছিলেন। তাকে এতো বড় প্রকল্পের দায়িত্ব না দিলেই ভালো হবে। এটা শুধু আমার কথা পুরো ভবন জুড়েই একই কথা।’
এই বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ভান্ডার সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহমুদ কবীর চৌধুরীর ভোরের পাতাকে বলেন, ‘আমি ঢাকার বাহিরে আছি। ব্যস্ত আছি। এ বিষয়ে পরে কথা হবে’।
এই বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সরোয়ার হোসেন এ ভোরের পাতাকে বলেন, তিনি ছাত্র জীবনে কি ছিলেন সেটা আমার জানার বিষয় না। সম্প্রতিকালে যে গটনা হয়েছিলো সেখানে আমি একাই তদন্ত কমিটিতে ছিলাম না আরো অনেকেই ছিলো। তাছাড়া তদন্ত করে তার কোন দোষ পাইনি।