শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) মফিজুর রহমানের বাসায় অভিযান চালিয়ে ভয়ংকর এলএসডি মাদকসহ তাঁর শ্যালক ইব্রাহিম কিবরিয়াকে গ্রেপ্তার করেছিল মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। এর আগে গুলশান থেকে জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদের ছেলে আযরাফ আহমেদ ওজিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে এলএসডি উদ্ধার করা হলেও প্রভাবশালীদের তদবিরের কারণে গাজা পাওয়া গেছে উল্লেখ করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে একদিনের সাজা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে ডিএনসি। অপর এক তরুণের নামে এলএসডির মামলা করা হয়েছে। সেখানে ইব্রাহিম ও ওজি কাউকে আসামি করা হয়নি।
উদ্ধারকৃত মাদক সময়ের আলোচিত এলএসডির চেয়ে বহুগুণ ক্ষতিকর। তিন দিন আগে চালানো এ অভিযান সম্পর্কে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। প্রভাবশালীদের চাপে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে। একপর্যায়ে বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে গাঁজা উদ্ধারের গল্প সাজাতে বাধ্য হয় নারকোটিক্স।
বিদেশ থেকে আসা একটি মাদকের চালানের সূত্র ধরে গত সোমবার তাদের গ্রেফতার করে নারকোটিক্সের গোয়েন্দা টিম। সূত্র জানায়, ঘটনার পর বিষয়টি গোপন রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। ফলে তিন দিন পরও এ বিষয়ে গণমাধ্যমের কেউ কিছুই জানতে পারেনি। নারকোটিক্স কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি। গত বুধবার সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে কয়েকজন কর্মকর্তা তড়িঘড়ি অফিস ত্যাগ করেন। জানতে চাইলে নারকোটিক্সের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) কাজী আল আমিন বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমি পরিষ্কার কিছু জানি না। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন।’ তবে মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের মুখ খুলতে নিষেধ করা হয়েছে। এ নিয়ে কথা বললে বিভাগীয় শাস্তির পাশাপাশি চাকরিও হারাতে হতে পারে।’
সূত্র জানায়, সপ্তাহখানেক আগে নেদারল্যান্ডসের রাজধানীর আমস্টারডাম থেকে ডাকযোগে একটি সন্দেহজনক পার্সেল আসে ঢাকায়। কিন্তু দীর্ঘ সময় পরও কেউ পার্সেল গ্রহণ করতে না আসায় সন্দেহ দেখা দেয়। বিষয়টি নারকোটিক্সকে জানায় ডাক বিভাগ। পরে পার্সেল খুলে ২৫টি এলএসডি পায় নারকোটিক্স।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাড্ডার জনৈক ফারদিনের নামে পাঠানো পার্সেলটির মালিক ধরতে গুলশান পোস্ট অফিসের আশপাশে অপেক্ষায় থাকে নারকোটিক্স টিম। একপর্যায়ে ১৫ মে পার্সেল নিতে আসেন আজরাফ আহমেদ ওরফে ওজি। আটকের পর তিনি নিজেকে ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদের ছেলে বলে পরিচয় দেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, তার বন্ধু ফারদিন পার্সেলটির মালিক। সে তাকে পার্সেল ডেলিভারি নিতে পোস্ট অফিসে পাঠায়। এর ভেতরে কী আছে, তা তিনি জানেন না। একপর্যায়ে কৌশলে ফারদিনকেও পোস্ট অফিসের সামনে ডেকে আনা হয়। নারকোটিক্সের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর ফারদিন তার সহযোগী হিসাবে ইব্রাহিম কিবরিয়া নামের এক যুবকের নাম বলেন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে থেকে ইব্রাহিমকেও আটক করে নারকোটিক্স।
নারকোটিক্সের গোয়েন্দা টিমের এক সদস্য বলেন, আসামিদের সঙ্গে নিয়ে মাদকের চালান উদ্ধারে অভিযানের উদ্যোগ নেওয়া হলে ইব্রাহিম জানান, তিনি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির এপিএস মফিজুর রহমানের শ্যালক। মফিজুর রহমানের বাসায়ই তিনি বসবাস করেন। স্পর্শকাতর বিবেচনায় বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়। সবকিছু শুনে নারকোটিক্সের উচ্চপর্যায় থেকে অভিযান অব্যাহত রাখতে বলা হয়। ফলে মফিজুর রহমানের সংসদ ভবন আবাসিক এলাকার ফ্ল্যাটেও (ফ্ল্যাট নং ডি-১৩০৩) তল্লাশি চালানো হয়। এ সময় সেখান থেকে থাই মাদক হিসাবে পরিচিত এমডিএমএ (মেথাইলিন ডক্সি মেথা এমফিটামিন) উদ্ধার করা হয়। তল্লাশি ও মাদক উদ্ধারের সময় মফিজুর রহমান বাসাতেই ছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অভিযান শেষে উচ্চপর্যায়ে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানানো হলে গ্রেফতার তিন আসামিকে সেগুনবাগিচায় নারকোটিক্সের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যেতে বলা হয়। রাতে সেখানেই আসামিদের রাখা হয়। কিন্তু পরদিন ১৬ মে ভোর থেকে অভিযান সংশ্লিষ্টরা চাপের মুখে পড়েন। আসামি ছাড়িয়ে নিতে ব্যাপক তদবির শুরু হয়। দফায় দফায় ফোন করেন কয়েকজন প্রভাবশালী। এতে নারকোটিক্সের পদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেই ভিন্ন আচরণ শুরু করেন। মামলাসহ আইনি প্রক্রিয়া নিতে সংশ্লিষ্টদের বিরত থাকতে বলা হয়।
এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর এপিএস মফিজুর রহমান নিজেও নারকোটিক্সের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হন। শ্যালককে ছাড়িয়ে নিতে দেনদরবার শুরু করেন তিনি। এ সময় ছেলেকে ছাড়াতে শাফিন আহমেদও উপস্থিত হন নারকোটিক্স কার্যালয়ে। একপর্যায়ে চতুর্মুখী তদবিরে তটস্থ নারকোটিক্স কর্মকর্তারা করণীয় ঠিক করতে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন। সেখানে গ্রেফতার ব্যক্তিদের স্বজনরাও ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, প্রথমদিকে মামলার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল নারকোটিক্স। কিন্তু হঠাৎ একটি গুরুত্বপ‚র্ণ ফোনে সবকিছু বদলে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে মফিজুর রহমানের শ্যালক ইব্রাহিম ও শাফিনের ছেলে ওজিকে ‘বাঁচিয়ে দেওয়ার’ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় নারকোটিক্স।
স‚ত্র জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী ওজি ও ইব্রাহিমকে নারকোটিক্সের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবা হকের মুখোমুখি করা হয়। সেখানে মাত্র ১০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার দেখিয়ে সাজা দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অপরদিকে কোনো তদবির না থাকায় ফারদিনের বিরুদ্ধে হয় নিয়মিত মামলা। এলএসডি চোরাচালানের অভিযোগে গত মঙ্গলবার পল্টন থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন নারকোটিক্সের পরিদর্শক মাসুদুর রহমান (মামলা নম্বর ৩৬)।
সূত্র জানায়, ঘটনার এমন নাটকীয় পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট অভিযান টিমের সদস্যরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানান। প্রভাবশালীদের আত্মীয়স্বজন হওয়ায় আইনের ফাঁক গলে এভাবে আসামিদের বের করে দেওয়ার প্রতিবাদ জানান কয়েকজন। পরে বাধ্য হয়ে নারকোটিক্স কার্যালয়ে উপস্থিত আসামি ইব্রাহিমের ভগ্নিপতি মোস্তাফিজুর রহমান এবং ওজির বাবা শাফিন আহমেদের কাছ থেকে সাদা কাগজে মুচলেকা নেওয়া হয়। এতে তারা লেখেন, সংশ্লিষ্টরা আর কখনো মাদকসেবন করবেন না। তাদেরকে মাদক পুনর্বাসনকেন্দ্রে পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঘটনার বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য শিক্ষামন্ত্রীর এপিএস মফিজুর রহমানের মোবাইল ফোনে গত বুধবার কল করা হলে প্রথমে তিনি পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেন। বলেন, ‘কই, না তো। এমন ঘটনা আমার জানা নেই।’ শ্যালক ইব্রাহিম খুব ভালো ছেলে বলে দাবি করে বলেন, সে তো বাসাতেই ছিল। মাদক নিয়ে গ্রেফতার হবে কেন?’ পরে তার হোয়্যাটসঅ্যাপে ইব্রাহিমের হাতকড়া পরা ছবি পাঠানো হলে উলটো সুর ধরেন। নিউজ না করতে অনুরোধ করেন। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার মফিজুর রহমানের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।