সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিরোনাম: কর্মোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব   নববর্ষের আনন্দ যেন বিষাদের কারণ না হয়: রাষ্ট্রপতি   নির্বাচনে ২১ সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন ইসির   দেশজুড়ে যে তিনদিন মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা!   মির্জা ফখরুলের জামিন শুনানি ৯ জানুয়ারি   প্রাথমিকের ছুটি বাড়ল ১৬ দিন (তালিকা)   নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিএনপির প্রচারণা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
অন্যতম দ্বিপান্বিত ব্যক্তিত্ব কুতুবউদ্দিন
কাজী রফিকুর রহমান
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০২৩, ৮:০০ পিএম আপডেট: ১৮.০৫.২০২৩ ৮:১০ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

নেত্রকোণা জেলা তথা হাওড় বাংলার মানুষ গড়ার সূতিকাগার নামে প্রসিদ্ধ, কংশ নদীর পাশ ঘেঁষে মনোমুগ্ধকর অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যবাহী মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠানটি তার জন্মলগ্ন থেকেই ভাটি বাংলার অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, আইনজীবিসহ বিভিন্ন পেশাজীবি আর দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিতে ভরপুর। তাদের অনেকেই দেশের কাজে, জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করে যাচ্ছেন।

সুশিক্ষিত, চরিত্রবান, সাহসী, পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিগত চরিত্রকে কলুষমুক্ত রাখা- আর্তপীড়িতের সেবায় এগিয়ে যাওয়া এবং দেশ ও জাতির তরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতায় বলিয়ান হওয়ার শিক্ষা পরম যত্নের সাথেই দিয়েছেন উক্ত প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী।

প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ে উজ্জ্বলতা দিয়ে যাঁরা এই দ্বীপ শিখাকে করেছেন আলোময় । তাঁদেরই একজন, প্রজ্জ্বলন্ত হৃদয় দিয়ে- ছাত্রের আবেগে মহত্ত্বের পিপাসা জাগিয়ে দিতে পারা অন্যতম দ্বিপান্বিত ব্যক্তিত্ব মরহুম কুতুবউদ্দিন স্যার।

মোহনগঞ্জ থানার খুঁচিরগাঁও গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা মরহুম ছমির উদ্দিন, মাতা মরহুমা সুরুজেরনেছার ঘরকে আলোকিত করে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ মরহুম কুতুবউদ্দিন স্যার এসেছিলেন এই ধরায়।

মোহনগঞ্জ এ্যাটাড প্রাইমারি স্কুলে কুতুবউদ্দিন স্যারের শিক্ষাজীবন শুরু। খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি। ১৯৪৮ সালে মোহনগঞ্জ ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় হতে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন গুরুদয়াল কলেজ, কিশোরগঞ্জ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট (বিজ্ঞানে) পাশ করেন। ১৯৫২ সালে আনন্দমোহন কলেজ, ময়মনসিংহ হতে বিজ্ঞানে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন । ১৯৬১ সালে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা হতে দ্বিতীয় বিভাগে ব্যাচেলর অব এডুকেশন ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫৩ সালে বি. এস. সি. পাশ করার পর পরই তিনি নেত্রকোণার আঞ্জুমান উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে স্বল্প সময় শিক্ষকতার পর সে বছরই মোহনগঞ্জ থানার বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী মরহুম আব্দুল আজিজ খান সাহেবের অনুপ্রেরণায় শহরের চাকচিক্য ছেড়ে শিক্ষা প্রসারের মহান ব্রত নিয়ে চলে আসেন নিজ মাতৃভূমিতে। সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মোহনগঞ্জ ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ে।

অতঃপর এ স্কুলই হয়ে উঠে তাঁর জীবন, ধ্যান-জ্ঞান। তাঁর পিপাসা ভরা স্বপ্ন হঠাৎ করেই যেন স্বর্গ হতে সামনে এসে পড়েছিল। ঠিক করে নিলেন এখানেই বাঁধিব মোর তরী, অন্য কোনখানের দিন শেষ। এখান থেকে আর কোথাও যাওয়া নেই। কোনো কিছুর বিনিময়েই না। চাকুরীজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এখানেই।

যে সময়ে তিনি পড়াশুনা শেষ করেছিলেন ইচ্ছে করলে তিনি অন্য কোনো ভালো চাকুরি নিতে পারতেন। কিন্তু বই পড়ার অদম্য নেশা, পরবর্তী প্রজন্মকে আপন আলোয় বিকশিত করার পিপাসায় সম্পূর্ণ জীবনটাই চেয়ে নিলেন শিক্ষকতার জন্য।

শিক্ষকতার জীবনে একটি দুটি ক্লাসেও যদি কোন শিক্ষক নিজের প্রজ্জ্বলন্ত হৃদয়ের উত্তাপে ছাত্রের আবেগকে মহত্ত্বের পিপাসায় জ্বালিয়ে দিতে পারেন তবে তাঁর সমকক্ষ কে? একজন শিক্ষক ছাত্রের হৃদয়কে কতটা গভীরভাবে আক্রান্ত করতে পারেন তার উদাহরণ মুহাম্মদ কুতুবউদ্দিন স্যার। স্যারের স্বর ছিল স্নেহমাখা, সদা হাসিখুশি, ব্যবহার মধুর ও অন্তরঙ্গ। পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জীবনকে কতটা সুন্দর আর পরিতৃপ্ত করে তোলা যায়, সে চেষ্টাই তিনি করে গিয়েছেন সারাজীবন। উন্নত দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রদের সামগ্রিক বিকাশের জন্যে শিক্ষকদের কাছ থেকে যে পরিমাণ সময়, কর্তব্যনিষ্ঠা, জ্ঞান সাধনা ও আত্মোৎস্বর্গ প্রত্যাশা করে ঠিক তেমনটিই করে গিয়েছেন মরহুম কুতুবউদ্দিন স্যার।

ভালো ছাত্রদের আরো ভালো করার জন্যে বিশেষ যত্ন নিতেন। যেকোনো ধরণের সহযোগীতা দিয়ে তাকে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। ভালোবাসতেন নিজ সন্তানের মতোই। স্কুল সময়ের বাইরেও তিনি তাদের খোঁজখবর রাখতেন।

বই পড়া, পড়ানো- এর বাইরেও সবজি চাষ আর বাগান করার নেশা ছিলো তাঁর। স্কুল সময়ের বাইরেও বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাগানে কাজ করতেন। তাছাড়া নিজ বাসাতেও সবজি চাষ এবং বাগান করতেন। মজার বিষয় হচ্ছে স্যারের হাতের স্পর্শে যেকোন গাছের চারা রোপন করলেই তাতে খুব ভালো ফলন হতো।

সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে শিক্ষার গুণগত পরিবেশ, সহকর্মীদের সাথে সম্প্রীতি, অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ প্রসার সর্বোপরি তাঁর নানামুখি পদক্ষেপেই আশপাশের থানার মেধাবী শিক্ষার্থীরা উক্ত স্কুলে পড়াশুনা করতে আগ্রহী হয়। এক পর্যায়ে নেত্রকোণা মহকুমার মধ্যে মোহনগঞ্জ ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়টি একটি অন্যতম প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

১৯৭৭ সালে তৎকালীন প্রধানশিক্ষক মরহুম শামছুল হক স্যারের মৃত্যুর পর তিনি প্রধানশিক্ষক পদে স্থলাভিষিক্ত হন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে স্বচ্ছতার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়, “স্বচ্ছতাই দুর্নীতির প্রতিরোধ শক্তি” আর উন্নয়ন হচ্ছে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও কর্মদক্ষতার ফসল- সে বিষয়গুলো মাথায় রেখেই স্কুল ব্যবস্থাপনা, তত্ত্বাবধান, প্রেষণা, নেতৃত্ব, অনুপ্রেরণা, যোগাযোগ এ নির্দেশনাগুলো ঠিক রেখে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মূলমন্ত্র ও তাঁর ভালো করেই জানা ছিল। আর তা অত্যন্ত সূচারুভাবেই সফলতায় পরিণত করেছিলেন তিনি।

পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড তথা বিনোদন, হাতে কলমে শিক্ষা সবকিছুর সমন্বয় ঘটিয়ে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সবার মধ্যে এক মেলবন্ধন তৈরি করে স্কুলকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়।

মুহাম্মদ কুতুবউদ্দিন স্যারের নিরলস ত্যাগ, প্রচেষ্ঠা ও নৈপূণ্যতায় প্রতিষ্ঠানটি আপন আলোয় দীপ্তমান হয়ে ১৯৮১ সালে হয় সরকারিকরণ। নামকরণ হয় মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়। ২৪ বছরের শিক্ষকতা জীবন এবং প্রায় ৭ বছর প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি দেখিয়ে গেলেন শিক্ষকের কাছে ছাত্র কী? ছাত্র যে তাঁর আত্মার সন্তান। প্রতিষ্ঠানটিও ছিল তাঁর জীবন, অর্থময়তা, জন্ম এবং জন্মান্তর।

স্যারের শিক্ষকতা জীবনে উজ্জ্বল আলোর পথরেখায় বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর সহধর্মিনী রেজিয়া আক্তার খাতুন। পেশায় তিনি একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে ছেলে, মেয়ে ও নাতী-নাতনীদের নিয়ে সুখে জীবন অতিবাহিত করছেন।

মরহুম কুতুবউদ্দিন স্যারের দীর্ঘ শিক্ষকতার বর্ণাঢ্য জীবনের যবনিকা ঘটে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ০৯ অক্টোবর তাঁর জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে। তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে রেখে গেলেন তিন ছেলে ও চার মেয়ে। তাঁর বড় ছেলে মোঃ জিয়াউল হক (টিটু), সাবেক সাধারণ সম্পাদক, মোহনগঞ্জ সাধারণ পাঠাগার; বর্তমান জেলা রেজিষ্টার, নারায়নগঞ্জ ও নির্বাচিত সভাপতি, বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস এসোসিয়েশন। দ্বিতীয় ছেলে শরিফুল হক বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোনে পিএইচডি শেষ করেছেন, পেশায় তিনি একজন ভেটেরিনারি সার্জন। ছোট ছেলে মোঃ তৌহিদুল হক সায়েম বিআরডিভির ডেপুটি ডিরেক্টর, ঢাকায় কর্মরত। চার মেয়ের মধ্যে প্রথম ইমারেল ফাহমিদা জামি, বি.এ পাশ, গৃহিণী। দ্বিতীয় মেয়ে ফৌজিয়া তানভীর, প্রধানশিক্ষক, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নেত্রকোণা। তৃতীয় মেয়ে আকছা ফরহাদ, . সহকারী শিক্ষক (বিজ্ঞান), ভিকারুন্নেছা নুন স্কুল এন্ড কলেজ, ঢাকা এবং ছোট মেয়ে (সৌভাগ্যক্রমে আমার কলেজ জীবনের বান্ধবী) মাকসুদা তানভীর ছপু উচ্চ শিক্ষা শেষ করে আমেরিকাতেই একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে সফলতার সাথে শিক্ষকতা করছেন।

মরহুম কুতুবউদ্দিন স্যার মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় তথা ভাটিবাংলায় শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে অগণিত ছাত্রের জীবনে যে জ্ঞানের দ্বীপশিখা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে এর পরিমাপ করা যে বড়ই কঠিন। যে শিক্ষকের ছাত্রজগতই ছিল তাঁর ঘর, তাঁর বসতবাড়ী এখানে আলোকভরা নীল আকাশের নীচে তাঁর সকল শিক্ষার্থীদের পক্ষে আমার লেখা একটি কবিতার ক'টি চরণ দিয়েই আমার লেখা শেষ করছি-

যেখানে তুমি আছো মোদের মায়ার বাঁধন ছিড়ে, 
সুখে থাকো যেন বিধাতার প্রিয় বান্দা রুপে।
আর যেমনি করে করেছো মোদের জীবন পুষ্পায়ত, 
স্বচ্ছ, উজ্জ্বল, ফুটন্ত তোমার দান, 
রাখতে পারি যেন অবণীতে মোরা তোমার সম্মান

লেখক: প্রধান শিক্ষক, মোহনগঞ্জ আদর্শ হাই স্কুল



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Vorer-pata-23-12-23.gif
http://www.dailyvorerpata.com/ad/bb.jpg
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Screenshot_1.jpg
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]