আমার জীবনে আমার আম্মার ভূমিকা কতখানি? পুরোটাই; হয়তো তার থেকেও কিছুটা বেশি।
একমাত্র সন্তান হওয়ায় মা-বাবার খানিকটা প্রশ্রয় হয়তো পেয়েছি; কিন্তু কখনোই তা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে ছিলনা। আব্বা চেয়েছেন সবসময় কঠিন অনুশাসন, আম্মা আদর দিয়ে, মমতা দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। শৈশবে যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কোনো নেতিবাচক দিক যেন স্পর্শও না করে আমায় সেজন্য আব্বা সবসময় শৃংখল চলাফেরার ওপর জোর দিতেন। এটা করতে গিয়ে আমার দৈনন্দিন জীবন-যাপনে অনেক বিধি-নিষেধ আসতো। লেখাপড়ায় ভালো করার পাশাপাশি আমার তখন প্রবল ঝোঁক খেলাধুলার প্রতি। বিধিনিষেধ টপকে আমার পাঠক্রম বহির্ভূত এই কার্যক্রম ঠিকঠাক চলেছে আম্মার শতভাগ সমর্থনের জন্য। আমার জন্য কঠিন, কঠোর কাজগুলোকে কী অবলীলায় আম্মা শৈশব, কৈশোরে সহজ করে দিতেন! সব কঠিন অনুশাসন মেনে চলা গেছে, কারণ আম্মার সহযোগিতা ছিলো সীমাহীন। ছোটবেলা থেকে আমায় ফজরের নামাজের আগে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতে হতো-আব্বার কঠোর অনুশাসন ছিলো। প্রতিটি ভোর আম্মার জেগে কেটেছে; কারণ উনি আমার পড়ার টেবিলে বসে থাকতেন, ডিম সিদ্ধ-মাখন মাখা বিস্কুট দিতেন। কি পরম যত্নে খাওয়ানোর পাশপাশি উৎসাহ দিতেন বলে বোঝানো যাবেনা। ঘুম মাটি করে এই পড়তে বসাটা ভালোবাসার অভ্যাসে পরিণত করতে আম্মার প্রাণান্ত চেষ্টা একজন মা এর আত্মত্যাগের অনন্য উদাহরণ।
সারাজীবনে একবারই আম্মার হাতে মার খেয়েছি; তবে আমি যত না করেছি তার চেয়ে শতগুণ কান্না করেছেন আম্মা। কেন তিনি একমাত্র সন্তানকে মারলেন? নিজেই নিজেকে এই প্রশ্ন করেন আর কান্না করেন! আম্মাকে সামাল দিতে আমার দাদি তখন ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। আর কখনো মরেননি।
উচ্চমাধ্যমিকে ঢাকা কলেজে পড়াকালীন আম্মা নর্থ হোস্টেলে আসতেন আমায় দেখতে; এরপর কলকাতায় পড়াকালীন যেতেন সেইখানেও; শেখাতেন বিনয়ী হতে-মানবিক হতে,বলতেন, বলেন মানুষের পাশে থাকতে। পরোপকারী মনোভাব যেন আরও সুদৃঢ় থাকে এক্ষেত্রে আম্মাই সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
সমাজসেবায়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যখন মাঝেমধ্যেই অকারণ বিরোধিতা, ঈর্ষা আর শত্রুতার মধ্যে পড়ি; আম্মাকে বললেই তাঁর সাফ কথা- নিশ্চিন্ত মনে মানুষের সেবা করে যাও, “নিন্দুকেরা, দুর্মুখেরা, শত্রুরা কিছুই করতে পারবেনা”। আম্মার এই অভয় বাণী, দোয়াই যে আমার অনেক বড় শক্তি। আম্মার কথা, পথ চলতে গিয়ে বাঁধা আসবে, সেইজন্যে থেমে থাকলে চলবেনা, এগিয়ে যেতে হবে এবং গন্তব্যে পৌঁছতে হবে।
ছাত্রজীবন শেষে পেশাগত ব্যস্ততা, ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড পরিচালনা, প্রতিযোগিতার ইদুর দৌঁড়ে সময় দিতে গিয়ে আম্মার যে সেবা করা উচিত সেটা পারিনি; এই অক্ষমতা আমারই ব্যর্থতা। তবু আম্মার কোনো অভিযোগ, অনুযোগ নেই। বরং একমাত্র সন্তান কিভাবে কতটা ভালো থাকবে এটা এখনো আম্মার ধ্যান-জ্ঞান।
আব্বা পরলোকে গেছেন, সাড়ে তিন বছর হলো। এরপর আমার অসুস্থ মা আরও চুপচাপ হয়ে গেছেন। কিন্তু ঠিকই মানুষকে সহযোগিতা করার কথা বলেন আমাকে। বলেন, মানুষের পাশে থাকলে আল্লাহ্ ফেরাবেন না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে, এমপি মনোনয়ন প্রার্থী হয়ে কারো কারো চক্ষুশূল হয়েছি, আমার পিঠে ছুরি মারার চেষ্টাটা ছিল, আছেও। তবু পিছু হটিনি, পিছু হঠবোও না। মায়ের দোয়া সর্বত সঙ্গে আছে।
যে মা কথা বলা শিখিয়েছেন, বুঝে অথবা না বুঝে সেই মায়ের সাথে অনেক সময় উঁচু গলায় কথা বলেছি। ভুল করেছি, ঠিক হয়নি কখনোই-এই ভুল আর কখনো করবোনা। আগামী ১৪ মে রোববার মা দিবস। কাকতালীয়ভাবে সেইদিন আমার জীবনের ৫০ বছর পূর্তিও। চিৎকার করে বলি আম্মা আপনায় অনেক ভালোবাসি। আমার মা-কে শ্রদ্ধা, সকল মাকে সম্মান, শ্রদ্ধা।
(লেখাটি ঢাকা টাইমস সম্পাদক আরিফুর রহমান দোলনের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া)