সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিরোনাম: কর্মোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব   নববর্ষের আনন্দ যেন বিষাদের কারণ না হয়: রাষ্ট্রপতি   নির্বাচনে ২১ সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন ইসির   দেশজুড়ে যে তিনদিন মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা!   মির্জা ফখরুলের জামিন শুনানি ৯ জানুয়ারি   প্রাথমিকের ছুটি বাড়ল ১৬ দিন (তালিকা)   নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিএনপির প্রচারণা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের পঞ্চাশ বছর: প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া:
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০২৩, ৫:১১ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই ১৯৪৪ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে মিত্রশক্তিভুক্ত ৪৪টি দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডসে এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইবিআরডি) প্রতিষ্ঠা করে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর (১৯৪৫) জাপানের পুনর্গঠনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়। আইবিআরডির কাজ ও ম্যান্ডেট আরো বিস্তৃত করে ১৯৪৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকের যাত্রা হয় 

এবং ক্রমান্বয়ে এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ আরো কয়েকটি সংস্থা মিলিত হয়। কালক্রমে বিশ্বব্যাংকের মুখ্য উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দাঁড়ায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্য বিমোচনে অনুন্নত, উন্নয়নশীল ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে ঋণসহায়তা প্রদান। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের সদস্য দেশের সংখ্যা ১৮৭। 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি সদ্য প্রবর্তিত মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সব বিষয়ে দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন।

কয়েক মাসের মধ্যেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, জাপান, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করতে থাকে। ১০ মে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সদস্য এবং ৩ জুলাই বিশ্বব্যাংকের সদস্যভুক্ত হয়। ১৯৭২ সালে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রাপ্তির মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারত্ব গড়ে ওঠে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, অগ্রগতি ও দারিদ্র্য বিমোচন তথা কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এবং অবকাঠামো খাতে বিশ্বব্যাংক ঋণসহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবেলায় এবং আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাতের সংস্কারে কারিগরি সহায়তাসহ বিশ্বব্যাংক পর্যাপ্ত ঋণসহায়তা দিচ্ছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুত ঋণের পরিমাণ ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ৪৩৬টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩২০টি প্রকল্প শেষ হয়েছে, ৩১টি প্রকল্প বাদ দেয়া হয়েছে এবং ৬৬ প্রকল্প চলমান রয়েছে মর্মে বিশ্বব্যাংকের তথ্যে জানা যায়। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বেশ ক’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (দুই লেন) নির্মাণ, ২৬টি জেলায় মোট ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার পল্লী সড়ক নির্মাণসহ সড়ক সেক্টরে বেশকিছু প্রকল্প, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে অন্যান্য উন্নয়ন-সহযোগীদের সমন্বয়ে সমন্বিত প্রকল্পগুলো উল্লেখযোগ্য। 

গত জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। ১ মে, ২০২৩-এ বড় রকমের সমাপনী অনুষ্ঠান পালিত হয়, যেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। তার এবং বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে আরো পাঁচটি প্রকল্পে ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। 

২০০৯ সালে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাইকা (জাপান) যৌথভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মত হয়। পরে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও ঋণসহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে। ২০১১ সালের জুন মাসের মধ্যে চারটি সংস্থার সঙ্গে মোট ২ হাজার ৩৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু প্রকল্পের কাজ চলমান অবস্থায় সেতুর সুপারভিশন কনসালট্যান্ট নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে কাজ স্থগিত করে দেয়। বাংলাদেশ সরকার দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। উভয় পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন চলা অবস্থায় বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জয়েলিক ২০১২ সালের ২৮ জুন একক সিদ্ধান্তে ঋণচুক্তি বাতিল করে। 

বিশ্বব্যাংককে পদ্মা সেতু প্রকল্পে পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উদ্যোগ নেন। সরকার বিশ্বব্যাংকের কয়েকটি অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি হয়। প্রকল্পে জড়িত সেতু বিভাগের সচিবসহ কতিপয় কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন। বিশ্বব্যাংক নিয়োজিত তিন সদস্যবিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ প্যানেল ও ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি ইউনিটের কতিপয় কর্মকর্তা প্রভাব বিস্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে সেতু বিভাগের সচিবসহ সরকারের চারজন কর্মকর্তা ও একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের (এসএনসি লাভালিন) সঙ্গে জড়িত তিনজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে। এমনকি এ নিবন্ধের লেখক সচিবসহ তিনজন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে জেলে নেয়া হয়। কিন্তু যোগাযোগমন্ত্রী ও একজন উপদেষ্টাকে অভিযুক্ত না করায় বিশ্বব্যাংক অসন্তুষ্ট হয়। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ পুনরায় শুরু না করায় ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন-সহযোগীদের ঋণ প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশনের অধিকতর তদন্তে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কথিত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সব আসামিকে আদালত কর্তৃক খালাস দেয়া হয়। দীর্ঘদিন মামলা চলার পর কানাডার টরন্টোয় সুপিরিয়র কোর্ট ৬ জানুয়ারি ২০১৭ প্রদত্ত রায়ে দুর্নীতি কিংবা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলা খারিজ করে দেন। 

বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে ২০২২ সালের জুন মাসে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়। এ সেতু একদিকে যেমন দেশের অবকাঠামো ও আঞ্চলিক উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করে, অন্যদিকে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব ও দেশের ভাবমূর্তি বিশ্ববাসীর কাছে উজ্জ্বল হয়েছে। 

পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অংশ না নিলেও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের তেমন অবনতি হয়নি। পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থায়নের কথা ছিল পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকটি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক এর চেয়ে বেশি অর্থায়নে এগিয়ে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়সহ সিনিয়র কর্মকর্তারা অনুধাবন করতে পেরেছেন যে পদ্মা সেতু প্রকল্পের মতো একটি মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন থেকে সরে এসে বিশ্বব্যাংক ভুল করেছে। বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক সম্পর্কের ৫০ বছর পালনের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে বিশ্বব্যাংক এর আগের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে বলে অনেকে মনে করেন। 

বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি ইউনিট প্রসঙ্গ

বিশ্বব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা কিংবা ঋণগ্রহীতা দেশের প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি বা অনিয়মের তদন্তের জন্য ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি ইউনিট কাজ করে। বলতে দ্বিধা নেই, বিশ্বব্যাংকের শুদ্ধাচার বা সততা (ইন্টেগ্রিটি) বিভাগের তদন্ত পদ্ধতি দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ। এরা নিজেরা অডিট বা তদন্ত করে কোনো দুর্নীতি বা অনিয়ম বের করতে পারে না। বিশ্বব্যাংকে নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি বা ঋণগ্রহণকারী দেশের প্রকল্পে নিয়োজিত ব্যক্তি, ঠিকাদার বা পরামর্শকের মধ্যে থেকে কেউ গোপনে ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ হিসেবে অভিযোগ দায়ের করে। এ ধরনের অভিযোগ সবসময় বস্তুনিষ্ঠ হয় না। প্রকল্প বা ব্যাংকের কাজে জড়িত কোনো ব্যক্তির স্বার্থহানির সম্ভাবনা দেখা দিলে গোপনে অভিযোগ করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ ধরনের গোপন বা বেনামি অভিযোগ করা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। গোপনীয়তার স্বার্থে ইন্টেগ্রিটির অফিসাররা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা বা সরকারি অফিসারদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন না। এমনকি ইন্টেগ্রিটি অফিসাররা কোনো অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করার আগে বিশ্বব্যাংকের মূল কর্ম ইউনিটের কর্মকর্তাদেরও মতামত গ্রহণ করেন না। কাজেই গোপনীয়ভাবে চিঠি কিংবা ই-মেইলে অভিযোগকারীরা যা বলেন তার সত্য-মিথ্যা বিচারের কোনো পথ নেই। 


দ্বিতীয়ত, এ ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে ইন্টেগ্রিটি ইউনিট ‘টিপস্টার’দের আদালতে হাজির করে না। কাজেই সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে আদালতের কাছে নালিশ গ্রহণযোগ্য হয় না। সেজন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইন্টেগ্রিটি ইউনিট আদালতের শরণাপন্ন না হয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে জানায় যাতে সরকার দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

তৃতীয়ত, ইন্টেগ্রিটি ইউনিট এবং বিশ্বব্যাংকের কর্ম ইউনিটের কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও অসহযোগিতা রয়েছে। ইন্টেগ্রিটি ইউনিটের কর্মকর্তারা নিজেদের স্বাধীন মনে করেন। এ সমন্বয়হীনতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাস সার্বিকভাবে বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন কার্যক্রম ও দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম উভয়কে দুর্বল ও অকার্যকর করে তোলে। বেশ ক’জন বিশেষজ্ঞ (যেমন মার্কিন আইন বিশেষজ্ঞ থর্নবার্গ ও পল ভোলকার) এর আগে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুর্বলতাগুলো তুলে ধরেন।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে ইন্টেগ্রিটি ইউনিটের যে কর্মকর্তারা সরাসরি গোপন ই-মেইলে চিঠি চালাচালি করেছেন তাদের অনভিজ্ঞতা ও অযোগ্যতার কারণেই বেনামি ও অজ্ঞাত ‘‌টিপস্টার’দের ফাঁদে পা দিয়েছে।

সর্বোপরি, সততা ইউনিট দুর্নীতি প্রমাণের জন্য এবং সুপারভিশন কনসালট্যান্সি কাজের জন্য আবেদনকারী এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের (আরসিএমপি) মাধ্যমে আদালতে মামলা দায়ের করে, যা বিশ্বব্যাংকের ইতিহাসে নজিরবিহীন। বিশ্বব্যাংক আদালতে হাজিরা ও সাক্ষী দেয়া থেকে দায়মুক্তি পেলেও অভিযোগকারীদের (টিপস্টারদের) সততা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। পুলিশের টেলিফোনে আড়ি পাতার আশ্রয় নেয়াসহ বাংলাদেশে প্রকাশিত অনেক সংবাদপত্রের কাটিং হাজির করা সত্ত্বেও টিপস্টারদের আসল পরিচয় ও নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ করেতে পারেনি। বেনামি ই-মেইলগুলো জনসম্মুখে আনার পর টিপস্টাররা আত্মগোপন করেন। ‘গুজব’, ‘শোনা কথা’ ও অনির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে আনীত অভিযোগ আমলে নিয়ে মামলা করায় কানাডার সুপিরিয়র কোর্ট মামলাটি খারিজ করে দেন।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণ করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের সততা ইউনিট যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এবং বিশ্বব্যাংকের একজন গভর্নর আবুল মাল আব্দুল মুহিত এ বিভাগকে ‘অপদার্থ’ আখ্যায়িত করে সেটি বন্ধ করে দেয়ার দাবি তুলেছিলেন। অর্থমন্ত্রী ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে পরিকল্পনা কমিশনে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‌আজকে পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক সততা বিভাগ বলে যেটি বিদ্যমান রয়েছে তা অবশ্যই রাবিশ।...এ রকম একটি অপদার্থ ইউনিট বিশ্বব্যাংকে থাকার কোনো অধিকার নেই।’

বিশ্বব্যাংকের সততা ইউনিট বাংলাদেশ ছাড়াও এর আগে ভারতসহ আরো ক’টি দেশের বিরুদ্ধে এরূপ অভিযোগ উত্থাপন করেছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণও বাতিল হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকার তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পায়নি। শুধু ‘‌হুইসেল ব্লোয়ার’ বা টিপস্টারদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সততা ইউনিটের কর্মকর্তারা আড়ালে থেকে যে তদন্ত করেন তা অধিকাংশ সময় বস্তুনিষ্ঠ হয় না। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বব্যাংকের তদন্তপ্রক্রিয়া পরিবর্তনের কথা বলেছেন। 

উপসংহার: বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যোগদানকালে আইএমএফ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং দেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার মতো নেতৃত্বের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের অব্যাহত সহযোগিতা কামনা করেন। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে জিডিপি বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, ডিজিটালাইজেশন ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টকে পদ্মা সেতুর একটি বৃহদাকার ফ্রেমে বাঁধাই ফটো উপহার দেন। অনেকে এটিকে প্রধানমন্ত্রীর ‘মধুর প্রতিশোধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গাও সাক্ষাৎ করেন। তিনি ২ জুন ২০২৩ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের এক বিশ্বস্ত ও সক্রিয় অংশীদার। দু-একটি ঘটনায় উভয় পক্ষের সাময়িক টানাপড়েন হলেও সার্বিকভাবে এ সম্পর্ক পারস্পরিক স্বার্থ ও শ্রদ্ধাবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও সবসময় বাংলাদেশ হালনাগাদ রয়েছে।

ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সময়মতো ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে অগ্রাধিকার প্রকল্পে সঠিক সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে এবং পারস্পরিক সম্পর্ক কাজে লাগাবে—এ আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Vorer-pata-23-12-23.gif
http://www.dailyvorerpata.com/ad/bb.jpg
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Screenshot_1.jpg
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]