প্রত্যন্ত গ্রামে বসে ভিডিও বানিয়ে মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে দুই ভাই ইসমাঈল হোসেন ও এনামুল হাসান। ইসমাইল ও এনামুল ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার কালিয়ানীকান্দা গ্রামের বাসিন্দা। ফেসবুক ও ইউটিউবে কনটেন্ট তৈরী করে মাসে ৮-১০ লক্ষ টাকা আয় করে যাচ্ছে।
তাদের দলে এখন কাজ করছেন আরও অন্তত ৮ থেকে ১০ জন। এখন নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক কাজ করে যাচ্ছেন তারা। পরবর্তীতে নতুন কিছু করার চিন্তা থেকে বড় ভাই ইসমাঈলকে যুক্ত করেন তিনি। হালের গরু বিক্রি করে ২০২১ সালে শুরু করেন কাজ। এরপর হালুয়াঘাট উপজেলার কালিয়ানিকান্দা গ্রামের মেঠোপথে আ লিক ভাষায় সাবলীল অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী হইচই ফেলে দেন ইসমাঈল।
ছোটভাই এনামুলের মাধ্যমেই শুরু। ৩ বছর আগে ফেসবুক লাইভে হাস্যরসাত্মক কমেন্ট করে ভাইরাল হয়েছিলেন এনামুল। মানুষের ব্যাপক সাড়া পেয়ে কৃষি শ্রমের পাশাপাশি কনটেন্ট তৈরিতেই এখন পুরো মনোযোগ ইসমাঈলের। ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজের পাশাপাশি বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক চ্যানেলে ভিডিও বিক্রি করে মাসে আয় করছেন লাখ লাখ টাকা। তাই এটিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন তারা।
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে অনলাইনের কল্যাণে ইসমাঈল এখন সেলিব্রেটি। তবে সুস্থ ধারার ভিডিও তৈরিতে বদ্ধ পরিকর তিনি। আর এসব বিষয় খেয়াল রাখেন তার কৃষক বাবা সুরুজ আলী। এনামুল-ইসমাঈলের দলে আছেন তাদের তিন ভগ্নিপতি কাবিল হোসেন, জুবাইদুল ইসলাম জুয়েল ও তাইজুল আসলাম। আরও আছেন প্রতিবেশী ফিরোজ আলম, রতন মিয়া, জিল্লুর রহমান, সুমন হাসান প্রমুখ।
এনামুল জানায়, মজার ছলে ব্যবহার করা ফেসবুকে আমার একটি কমেন্ট ভাইরাল হয়ে যায়। পরবর্তীতে আমি এটিকে কাজে লাগানোর চিন্তা করি। এরপর আমি প্রতিনিয়ত লাইভ করতাম। সেখান থেকে অনেক ফলোয়ার তৈরি হয়। আমার লাইভগুলো মানুষ দেখতো এবং প্রচুর শেয়ার করতো। এরপর আমি নতুন নতুন কনটেন্ট তৈরির চিন্তা করলাম। কিন্তু দেখলাম আমার মতো এমন বহু কনটেন্ট ক্রিয়েটর আছে। যখন আমি কনটেন্টে গেলাম তখন আমার ভিউ কমে গেল। পরে আমি সাভার থেকে গ্রামে চলে গিয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করে ভিডিও বানানোর পরিকল্পনা করি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের ময়মনসিংহের আ লিক ভাষাটা অনেকটাই ভিন্ন। আমরা নিজেরাই অনেক জায়গায় ব্যবহার করি না। কারণ এই ভাষার প্রচলনটা বাইরের জেলায় খুব কম। আমাদের আ লিকতা এতটা প্রসারিত না। আমার বড় ভাই ইসমাঈল তখন গ্রামেই থাকতেন। তিনি একটি ফান কথা এতো সিরিয়াসভাবে বলেন যে আমরাই হাসতাম তার কথা শুনে। এই ব্যাপারটাই আমি কাজে লাগাতে চাইলাম এবং তাকে রাজি করিয়ে ভিডিও বানানো শুরু করলাম। প্রথম ভিডিওই ব্যাপক ভাইরাল হল। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
ইসমাঈল হোসেন বলেন, আমি আগে গ্রামে কৃষিকাজ করতাম। এনামুল থাকতো ঢাকায়। বাড়িতে এসে বিভিন্ন ভিডিও বানাতো। প্রথমে আমি এটি ভালোভাবে নেইনি। তারপরও সে লুকিয়ে লুকিয়ে ভিডিও বানাতো। একদিন আমাকে অনুরোধ করে বলছে যে তাকে যেন একটি ভিডিও বানিয়ে দেই। পরে তার কথায় একটি ভিডিওতে অভিনয় করলাম। এরপর সেটি এতো পরিমাণে ভাইরাল হয় যে, এক মাসেই ৬৫ হাজার টাকা ওই ভিডিও থেকে আসে।
ইসমাইল বলেন, যখন টাকার কথা এনামুল আমাকে বলল তখন আমি বিশ্বাস করিনি। আমি বললাম সারাদিন কাজ করে পাই না ৫০০ টাকা সেখানে এক ভিডিও থেকেই আসছে ৭০-৮০ হাজার টাকা। তখন বিশ্বাস হচ্ছিল না। পরে যখন মাস শেষ হলো তখন ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে টাকার তোলার পর আমার বিশ্বাস হল যে এই কাজে টাকা উপার্জন হয়। এরপর থেকে একের পর এক ভিডিও বানিয়ে যাচ্ছি। এখন মাসে প্রায় ৮-১০ লক্ষ টাকা আয় হয়। মানুষও দেখে, পছন্দও করে।
ইউটিউবে ভিডিওর চিন্তা কীভাবে হলো এমন প্রশ্নের জবাবে ইসমাঈল হোসেন বলেন, আমি ছোট থেকে গ্রামে বড় হয়েছি। ক্ষেতে-খামারে কাজকর্ম করেছি। ওই সময় আমরা দুষ্টামি-ফাজলামিগুলো করলাম কিংবা চোখের সামনে যেগুলো ঘটতো সেগুলোই ভিডিওতে বাস্তব সম্মতভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি। আর এই সমস্ত ভিডিও দেখে মানুষ মজাও পায়।
আ লিক ভাষা সম্পর্কে ব্যবহারের ব্যাপারে তিনি বলেন, সবাই তো শুদ্ধ ভাষা বা ঢাকাইয়া ভাষায় ভিডিও বানায়। আমি চিন্তা করলাম যে ময়মনসিংহের যে আ লিক ভাষাটা আছে এই ভাষায় কথাবার্তা বলে মানুষের মনে যদি একবার জায়গা করে নিতে পারি তাহলে তারা আমাকে পছন্দ করবে। সেই সঙ্গে আমি অশ্লীলতামুক্ত ভিডিও বানিয়ে যাচ্ছি। যাতে পরিবারের সবাই ভিডিও দেখতে পারে। এতে মানুষ আমাকে বিরাট সাপোর্ট করে। আগে আমাকে কেউ চিনতো না। এখন সবাই আমাকে চেনে, মূল্যায়ন করে। আমারও খুবই ভালো লাগে।
জিল্লুর রহমান বলেন, আমার আগে থেকেই অভিনয়ের শখ ছিল। নাটক করবো, মানুষ দেখবে, চিনবে। সেই সুযোগটি তৈরি করে দিয়েছেন এনামুল ভাই। এখন আমার ভাগ্যই পরিবর্তন হয়ে গেছে।