ভৌগলিক দিক হতে নড়াইল জেলা বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় ছোট হলেও এর রয়েছে শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, ক্রীড়া ও মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহ্য ভরপুর। নড়াইল জেলা একটি নদী সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে সুপরিচিত। বর্তমানে চিত্রা, নবগঙ্গা, মধুমতি, কাজলা ও আঠারোবাকি নদী বিধৌত এলাকার মুসলিম ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে এই ভূখণ্ড গঠিত। এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিবর্গ।
ব্রিটিশ ভারতে সমসাময়িক সময়ে রাজনীতিবিদ মুন্সি ওয়ালিউর রহমান অত্যন্ত সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন৷ ব্রিটিশ-ভারতের অপর একজন ক্ষণজন্মা নড়াইল জেলার বিশিষ্ট প্রবীন রাজনীতিবিদ অবিভক্ত বাংলার এম.এল.এ এবং বৃহত্তর যশোর জেলা বোর্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট (বর্তমানে চেয়ারম্যান) মরহুম মুন্সী ওয়ালীউর রহমান।
মুন্সী ওয়ালীউর রহমান নড়াইল মহকুমার (বর্তমান জেলা) সদর উপজেলার মীর্জাপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৮৯১ সনের আগষ্ট মাসে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিলো মুন্সী মো. মোকাম্মেল এবং মাতার নাম মোছাম্মত মেহেরজান।তিনি শৈশবে নিজ গ্রামের এম,ই, বিদ্যালয় পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তীতে এলাকার অন্য একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে এনট্রান্স (বর্তমান এসএসসি)পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
পরে তিনি খুলনার দৌলতপুর কলেজে (বর্তমান বিএল কলেজ) ভর্তি হন। তিনি কৃতিত্বের সাথে উক্ত কলেজ হতে আই. এ পাশ করে কোলকাতায় গমন করেন। অতঃপর তিনি বাংলার বাঘ নামে খ্যাত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সান্নিধ্যে আসেন। ফজলুল হক সাহেব তাকে দক্ষিন খুলনাতে প্রাইমারী স্কুল পরিদর্শক পদে চাকরী প্রদান করেন। হক সাহেবের ঐকান্তিক ইচ্ছায় বারাসাত (বর্তমান ভারত) গভঃ হাইস্কুলে শিক্ষক পদে নিযোগ পান। ফজলুল হক সাহেব তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং তাকে আইন বিষয়ে অধ্যয়নের পরামর্শ প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি কোলকাতা হতে এল.এল.বি পাশ করেন এবং নিজ জেলায় অর্থাৎ নড়াইল শহরে ওকালতি শুরু করেন। সম্ভবত তিনি নড়াইল জেলার প্রথম মুসলিম যিনি আইন পেশায় সম্পৃক্ত হন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক সাহেবের সাহচার্যে এসে মুন্সী ওয়ালীউর রহমান ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯২১ সালে মুন্সী ওয়ালিউর রহমান নড়াইলের লোকাল বোর্ডের সর্বপ্রথম প্রথম মুসলমান হিসাবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
মুন্সী ওয়ালীউর রহমান পর পর দুবার বৃহত্তর যশোর জেলা বোর্ডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট(বর্তমান-চেয়ারম্যান) ছিলেন। তিনি ১৯৩৭ হতে ১৯৪৪ উক্ত দায়িত্বে বহাল ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সনে বৃহত্তর যশোর জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। বৃহত্তর যশোর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বড়ো ঘাট, ব্রীজ, কালভার্ট নির্মাণ করেন। তৎকালীন সময়ে খাবার পানির অভাব দূর করার লক্ষ্যে প্রচুর নলকুপ স্থাপনের সুব্যবস্থা করেন। তাঁর নিজ গ্রাম মির্জাপুর ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম গোবরাসহ বিভিন্ন গ্রামে সরকারী দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি নড়াইল শহরে শিক্ষার আলো জ্বালানোর জন্য সর্বপ্রথম একটি মকতব, যাহা নড়াইল গার্লস স্কুল বর্তমানে নড়াইল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের গোড়া পত্তন করেন। ঐ সময় নড়াইল কেন্দ্রীয় ঈদগাহ, নড়াইল শহর কবরস্থান সহ বহু সামাজিক জনহিতকর কাজে তিনি মনোনিবেশ করেন। ব্রিটিশ ভারতে তাঁর প্রচেষ্টায় নড়াইল সিঙ্গেশোলপুর-নওয়াপাড়া রাস্তা নির্মান করা হয়। তৎকালিন সময়ে কালাজ্বর ও ম্যালেরিয়া রোগে অনেক মানুষ বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতো। তিনি কালাজ্বর ও ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধের জন্য যশোর জেলা পরিষদ হতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি ব্রজমোহন ইংলিশ স্কুল (বর্তমান পশ্চিম বাংলা) নির্মাণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের জিবি সদস্য হিসেবে উক্ত কলেজের উন্নয়নেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি ১৯৪১ সনে যশোরের মহিতোষ রায় চৌধুরীর প্রস্তাব মতে মাইকেল মধুসুদন কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এবং পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালিন সময়ে মুন্সী ওয়ালীউর রহমান অবিভক্ত বাংলার এম.এল.এ এবং বৃহত্তর যশোর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যন ছিলেন। অবিভক্ত বাংলার সংসদীয় নির্বাচনে নড়াইল-মাগুরা আসনে নড়াইলের প্রভাবশালী জমিদার বাবু ধীরেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর “বার-এটল” এবং আলফাডাঙ্গার মোঃ আছাদুজ্জামান বাহাদুর এর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অবিভক্ত বাংলার এম.এল.এ নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৩৬ সন হতে ১৯৪৬ সন পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার এম.এল.এ ছিলেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল কর্তৃক গঠিত তৎকালীন কৃষক প্রজা পার্টিতে তিনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যোগদান করেন।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহন করেন এবং ১৯৪১ সালে কোলকাতার আলীপুর কারাগারে কারাবরণ করেন। ঋণ শালিশীর মাধ্যমে মহাজনদের হাত হতে গরীব কৃষকদের নিষ্কৃতি পাওয়ার লক্ষ্যে তিনি এম.এল.এ থাকাকালীন অবিভক্ত বাংলার তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক সাহেবকে ঋণ শালিশী বোর্ডের সদস্য হিসেবে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করতেন।
ব্রিটিশ ভারতে নড়াইলের কৃতি সন্তান ও প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মরহুম ওয়ালীউর রহমান ১৯৬০ সনের ২২ জুন তাঁর নিজ বাস ভবন নড়াইল শহরে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি কৃতি সন্তান সন্ততি রেখে গেছেন যারা সকলেই নিজস্ব পরিচয়ে সুপরিচিত। মুন্সী ওয়ালীউর রহমানের এক জামাতা মরহুম খন্দকার আব্দুল হাফিজ নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ সহচর্য ছিলেন। তিনি ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণেতা ছিলেন। অপর জামাতা মরহুম সৈয়দ বদরুল আলা সাহেবও যশোরের সংসদ সদস্য ছিলেন (ঝিকরগাছা- চৌগাছা)। তাঁরই সুযোগ্য এক পুত্র আশিকুর রহমান মিকু বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের উপ মহাসচিব ও বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। আশিকুর রহমান মিকু জাতীয় ক্রীড়া জগতের এক কিংবদন্তি ক্রীড়া সংগঠক। তাঁর খেলাধুলা জগতে অসামান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতি সরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় ক্রীড়া পদকে ভূষিত করেন (২০১৪)। উনার আরেক জামাতা মরহুম এম. এ শহীদুর রহমান। তিনি জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গায় দক্ষতা, বিচক্ষণতা এবং ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মুন্সী ওয়ালীউর রহমানের নাতি-নাতনিগণ দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় সু্প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শিল্প ও বানিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য, দৈনিক ভোরের পাতা, দ্য ডেইলি পিপলস্ টাইমের সম্পাদক, এফবিসিসিআই'র পরিচালক, ভোরের পাতা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ড.কাজী এরতেজা হাসান, সিআইপিও এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মুন্সি ওয়ালীউর রহমানের নাতনির জামাই।