চাঁপাইনবাবগঞ্জে রোজা এবং ঈদের পরের দিন পৃথকভাবে সাত ব্যক্তি হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। এসব হত্যাকান্ড ঘটেছে সদর এবং শিবগঞ্জ উপজেলায়। এর মধ্যে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে তিনজন। অন্য চারজন হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে।
এছাড়া সন্ত্রাসের জনপাদ হিসেবে পরিচিত নয়ালাভাঙা ও মরদানা এলাকায় দিনে রাতে অহরহ ঘটছে ককটেল বিস্ফরেণের ঘটনা। ককটেল ফাটাতে পিছিয়ে নেই সদর উপজেলার সুন্দরপুর ও পৌর এলাকার কিছু দুর্বৃত্ত। কোন ঘটনা ঘটলেই ফোটানো হচ্ছে জীবনহানি ককটেল। এনিয়ে পুরো জেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়িয়েছে আতঙ্ক আর ক্ষোভ। এসব ঘটনায় কারা ককটেল ফাটাচ্ছে তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চাইনা সাধারন মানুষ। তবে জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা পুলিশ সুপার (এসপি) বলছে এসব হত্যান্ড বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার ব্যক্তিরা হলেন-সদর উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের কালিনগর বাবলাবোনা গ্রামের মো. মনিরুল ইসলাম (৪৫),শিবগঞ্জ উপজেলার নয়ালাভাঙা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি সদস্য) ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের বিএনপির সভাপতি মো.আলম হোসেন ওরফে আলম ঝাপড়া (৫২) এবং জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য ও শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেম (৪৯)।
জানাগেছে,গত ৯ এপ্রিল রাতে বাসায় ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন মো.মনিরুল ইসলাম। তাঁকে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পথরোধ করে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। গত সংসদ নির্বাচনের রেসে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে এমনটাই জানিয়েছিল তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
১৩ এপ্রিল দুপুর দেড়টার দিকে প্রকাশ্যে ককটেল ফাটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় শিবগঞ্জ উপজেলার নয়ালাভাঙা ইউনিয়ন পরিষদের ৯ং ওয়ার্ড সদস্য ও বিএনপি নেতা আলম হোসেন ওরফে (আলম ঝাপড়া) কে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চাল বিতরণ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে দুর্বৃত্তরা ককটেল ফাটিয়ে তাঁর গতিরোধ করে। পরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করে। স্থানীয়রা তাঁকে উদ্ধার করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় ইফতারি নিয়ে ফেরার পথে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা খাইরুল আলম জেমকে (৫০)। শহরের উদয়ন মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় তাঁকে রড দিয়ে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে জখম করে হত্যা করা হয়।
একই দিনে সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের সাঁওতাল পাড়া এলাকার ধানক্ষেত থেকে মিঠন (২৯) নামে এক যুবকের মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। তাঁর শরীররে বিভিন্ন অংশ কাটা দাগ ছিল। পুলিশের ধারনা তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মিঠন সদর উপজেলার বারোঘোরিয়া এলাকার নরেন্দ্রনাথের ছেলে।
২৩ এপ্রিল রাতে হত্যাকান্ডের শিকার হয় শিবগঞ্জ উপজেলার সাদিকুর রহমান (৪২) নামের এক ব্যক্তি। ভোরে সীমান্ত এলাকার একটি ধানক্ষেত থেকে তাঁর গলায় গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা।
এদিন বিকেলে ককটেল হামলায় নিহত হন সদর উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো.জিয়ারুল ইসলাম (৪০) । নিজ এলাকাতেই দু'পক্ষের ককটেলবাজিতে পিঠে ককটেল লেগে তিনি নিহত হন বলে দাবি করেন নিহতের স্বজনরা।
পরে রোববার রাতে সদর উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুর রেহাইচর এলাকায় ছুরিকাঘাতে ফাহাদ আলী (১৮) নামে এক কিশোর নিহত হয়। কিশোরগ্যাংয়ের আধিপত্যবিস্তার নিয়ে হত্যাকান্ডের শিকার হন কিশোর ফাহাদ আলী। এ ঘটনায় এজাহার নামীয় দুই আসামীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত চাকুও জব্দ করা হয়েছে।
গত রোববার সন্ধ্যায় জেলা হাসপাতালে কথা হয়-সুন্দরপুর এলাকার বাসিন্দা মোতাহার হোসেনের সঙ্গে। তিনি আ বলেন,মারামারিতে এখন কথা বা লাঠির লড়াই দেখা যায়না। শোনা যায় ককটেলের বিকট শব্দ। এতে গ্রামের শিশুসহ সাধারন মানুষ আতঙ্কে দিন পার করছে।
নয়ালাভাঙা এলাকার বাসিন্দা ও রানিহাটি বাজারের এক দোকান ব্যবসায়ী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন,সামান্য ঘটনাতেই এখন ককটেলের ব্যবহার বেড়েছে। এতে সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয় সাধারন মানুষ কে। তিনি বলেন-সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে ককটেল বহন করে। এতে অনেক সময় অসাবধানতাবসত নিজেদের ককটেলে নিজেরাও আহত হচ্ছে।
মরদানা-আইউব বাজোরের গৃহবধূ আসমা বেগম বলেন,পুরো রমজান মাসজুড়ে মাঝে মধ্যেই ককটেল বেস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে কেউ মারা না গেলেও সবার মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও সদর আসনের সংসদ সদস্য আবদুল ওদুদ বলেন,প্রকাশ্যে একাধীক হত্যার ঘটনা ঘটলেও প্রকৃত আসামীদের ধরতে পারছে না পুলিশ। চুনোপুঠি দিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে। তিনি প্রকৃত আসামীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
সোমবার সকালে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ সুপার (এসপি)এইচএম আব্দুর রকিব। তিনি সাংবাদিকদের বলেন,জেলায় যতগুলো হত্যাকান্ড ঘটেছে সবচেয়ে আলোচিত ছিল সাবেক কাউন্সিলর ও জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা খাইরুল আলম জেম হত্যাকান্ড। পুলিশ জেম হত্যাকান্ডকে গুরুত্ব দিয়ে ক্লু উদ্ধার ও জড়িতদের ধরতে অভিযান শুরু করে।এরপর মোট ১৪জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের আদালতে পাঠানা হয়। তবে অপরাধী যেই হোক সকল আসামীদের তদন্তের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি যোগ করেন যারা ককটেলবাজি করে তাদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।