বাজেট প্রণয়ন সরকারের একটি চলমান প্রক্রিয়া। বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের বিশেষায়িত জনবল প্রায় সারা বছরই কাজ করেন। তবে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই অর্থ বিভাগ সরকারের সকল মন্ত্রণালয় থেকে চলতি অর্থবছরের হালনাগাদ খরচসহ আগামী বছরের খরচের সম্ভাব্য চাহিদা সংগ্রহ করে নেয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় উন্নয়ন বাজেটের রূপরেখা প্রণয়ন করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের নিকট থেকে আগামী বছরের সম্ভাব্য বৈদেশিক ঋণ প্রাপ্তির হিসাব নিয়ে অর্থ বিভাগে প্রেরণ করে। বাজেট প্রণয়নকালে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের দীর্ঘমেয়াদী ভিশন, উন্নয়ন অগ্রাধিকার ও নীতি কৌশল আমলে নিয়ে সার্বিক দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। দেশের জিডিপির ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা এবং জনগণের জীবনমানের গুণগত উন্নয়নের জন্য শিক্ষা, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত সহ সকল কাজের সমন্বিত উন্নয়নের নিমিত্তে সুষম বরাদ্দ প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে বাজেট কমিটি কাজ করে। 'বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির' একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠান ছাড়াও সকল মন্ত্রণালয়ের সাথে অর্থ বিভাগের বাজেট উইংয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেট এমন এক সময় প্রণীত হচ্ছে যখন নানামুখী চ্যালেঞ্জ ও সংকটে বৈশ্বিক অর্থনীতি টালমাটাল। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মন্দার হাতছানি, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, চীনের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ধীরগতি, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে খাদ্যশস্য, সার ও জ্বালানি উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্থ হওয়া এবং অবরোধ ও পাল্টা অবরোধে সার্বিকভাবে বিশ্বের সকল দেশেই সমস্যাসংকুল। তাছাড়া এ বছরের ডিসেম্বরে বা আগামী বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে দেশের জাতীয় নির্বাচন। একদিকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা, অন্যদিকে নির্বাচন পূর্ব বাজেট হিসেবে জনতুষ্টির দিকে লক্ষ্য রেখে এবারের বাজেট প্রণীত হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।
গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে যে, আগামী অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) বাজেটের আকার হবে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকার। আগে বাজেট প্রণয়নের বিষয়টি অতি গোপনীয়তার সাথে সম্পন্ন হতো। বাজেট সংসদে পেশের পূর্বে এর খুঁটিনাটি জানা সম্ভব হতো না। কিন্তু বেশ ক'বছর যাবত বাজেট আলোচনার শুরুতেই এটি জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে।
রাজস্ব বাজেট অর্থাৎ বাজেটের শুল্ককর নির্ধারণ সংক্রান্ত কাজটি করে থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থ বিভাগ থেকে বেঁধে দেয়া মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাজেট প্রকাশের আগেই জানা গেলেও খাত ভিত্তিক শুল্ক কর নির্ধারণ এখনও গোপনীয় রাখা হয়। এটি গোপনীয় না থাকলে দেশে উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রয় ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী আসন্ন বাজেটে এডিপি বা উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ থাকছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি হবে ২ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৮ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রয়েছে ক্রমশঃ নিম্নগতি। টাকার মান প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে। জ্বালানীর অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট পূর্ণ ক্যাপাসিটিতে চলছে না। গৃহস্থালী ও শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত। এ পরিস্থিতিতে সকল দিক বিবেচনায় উচ্চাভিলাসী বাজেট প্রণয়ন না করে একটি বাস্তবমুখী সুষম বাজেট প্রণয়ন করাই হবে উত্তম। বাজেট ঘাটতি মিটানোর জন্য দেশি-বিদেশি উৎস হতে ২ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে দেশের ব্যাংক সমূহ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৮৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রাপ্তির সম্ভাবনা হিসেব করা হয়েছে। জিডিপির ৬ শতাংশ বাজেট ঘাটতি হিসাব করে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। মোট রাজস্ব আয় ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এনবিআর এর রাজস্ব আয়ের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা যা চলতি অর্থ বছরের লক্ষ্যমাত্রার (৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা) চেয়ে ৭২ হাজার কোটি টাকা বেশি।
বিগত বেশ কিছু বছর যাবত এনবিআর এর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে থাকে প্রকৃত সংগ্রহ। ২০২০-২১ সালে রাজস্ব আয় ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার ৬৯৯ দশমিক ২০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরের রাজস্ব আয় ৩ লাখ ১ হাজার ৬৩৩ দশমিক ৮৪ কোটি টাকা হয়েছে। করোনা মহামারীতে অর্থনৈতিক আংশিক স্থবিরতার কারণে ২০২০-২১ সালের রাজস্ব সংগ্রহ কম ছিল। সেজন্য পরবর্তী বছর প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরের সংগ্রহ ৩ লাখ ৩০ হাজার বা বড়জোর ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। এই প্রকৃত রাজস্বের তুলনায় পরবর্তী লক্ষ্যমাত্রা যদি ৩৫-৪০ শতাংশ বেশি ধরা হয় তাহলে তা কোনমতেই আদায় করা সম্ভব হবে না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি বড়জোর ১৫-১৬ শতাংশ আশা করা যায়।
বাজেটে রাজস্ব বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বিগত বেশ ক'বছর যাবৎ ৯ শতাংশের কাছাকাছি ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজস্ব প্রশাসনের বৈপ্লবিক সংস্কারই পারে এ অবস্থার পরিবর্তন করতে। সেজন্য জনবল বৃদ্ধি, উপজেলা পর্যন্ত অফিস স্থাপন ও কর আদায় ব্যবস্থার অটোমেশন অপরিহার্য। আইএমএফ সহ দেশের অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজ ও এনবিআরের কয়েকজন সাবেক চেয়ারম্যান বারবার এ বিষয়ে আলোকপাত করছেন। অবস্থা দৃষ্টে ধারণা করা যায় একমাত্র দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাই এই কাঙ্খিত সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০০১ ও ২০১১ সালে এনবিআর এর প্রশাসনিক সংস্কারের পর রাজস্ব সংগ্রহে উল্লম্ফন লক্ষ্য করা গেছে।
অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বৃদ্ধি ব্যতীত স্বনির্ভর বাস্তবমুখী বাজেট প্রণয়ন সম্ভব নয়। প্রতিবছর বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধির কারণে সরকারের ঋণগ্রহণও বাড়ছে যা দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি চাপের সৃষ্টি করছে। খেলাপি ঋণের আধিক্য ও নানা অনিয়মের কারণে দেশের তফসিলী ব্যাংক সমূহের ঋণ প্রদানের সামর্থ্য সীমিত। তাছাড়া উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ প্রাপ্তিতেও আছে ধীরগতি। এমতাবস্থায় সম্ভব হলে বাজেটের আকার কাট-ছাট করে ঘাটতি এবং ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ধরাই হবে যুক্তিযুক্ত। নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে রাখার মধ্যেই রয়েছে বাজেট প্রণয়নের কৃতিত্ব।
প্রতিবছর বাজেটে যা বরাদ্দ থাকে তার সবটা খরচ করা সম্ভব হয় না। এখনো আমাদের বাজেটের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতার জন্য এবং আরো নানা কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। সেজন্য বাজেট বরাদ্দ সুষ্ঠু খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নযোগ্য এবং আশানুরূপ ফল লাভের সম্ভাবনা থাকে সরকারের শেষ বর্ষে সেই ধরনের নতুন প্রকল্প নেয়া উচিত হবে। তবে চালু প্রকল্প সমাপ্তির জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে।
এবারের বাজেটে দ্রব্যমূল্য যাতে না বাড়ে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে শুল্ককর বৃদ্ধির ফলে যাতে জনদুর্ভোগ না বাড়ে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। চাল, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল প্রভৃতির আমদানি শুল্ক ও মূসক সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। অন্যদিকে বিলাস দ্রব্যসহ ধনীদের ব্যবহার্য দ্রব্যাদিতে শুল্ক কর বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আমাদের দেশের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সবটাই বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে ঘটেনা বরং এর পেছনে একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর অতি মুনাফাখুরি মনোবৃত্তিই দায়ী। চিনি, চাল, ভোজ্যতেল সহ বেশ কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ ও মূল্য নির্ধারণ গুটি কয়েক ব্যবসায়ী গ্রুপের তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে। এ বিষয়ে সরকারি মনিটরিং জোরদার করা দরকার।
২০২০ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়া নোবেল করোনাভাইরাস এর কারণে এবং পরবর্তীতে বিশ্বমন্দা ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শিল্প উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকেই কর্ম হারিয়ে নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়ে। সেজন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আরো নতুন জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন হবে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে গত বছরের তুলনায় বাজেট বৃদ্ধিরও চিন্তা করতে পারে। তাছাড়া বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মহীনদের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়ে তাদের কর্মসংস্থান করা যেতে পারে। তাছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি ক্রয়ে বিশেষ বরাদ্দ থাকতে পারে যাতে পূর্ণ ক্যাপাসিটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়। ফলস্বরূপ শিল্প কারখানা ১০০% পূর্ণ ক্যাপাসিটিতে চালু থাকলে বাড়তি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবে।
কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বর্ধিত বিনিয়োগের প্রয়োজন। শুধু সরকারি বিনিয়োগ নয়, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সরকার বাজেটে নতুন বিনিয়োগকারীসহ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে বেশ সুবিধা দিচ্ছে। উদ্যোক্তাদের সেগুলোর সদ্ব্যবহার করা উচিত। সরকারকেও লক্ষ্য রাখতে হবে বাজেটে প্রদত্ত সুবিধাসমূহ যেন উদ্যোক্তাদের নাগালের মধ্যে থাকে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যেন সেগুলো হারিয়ে না যায়। সরকারি বিনিয়োগপ্রকল্প গুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জরুরী যাতে বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করে কর্মসংস্থান, জাতীয় আয় ও রাজস্ব বাড়ানো যায়।
বাজেট ব্যবসাবান্ধব হবে এটি কোন দোষের বিষয় নয়, বরং উৎপাদন, কর্মসংস্থান, রপ্তানি ও ভোগ চাহিদা বৃদ্ধি কল্পে এটি উপযোগী। তবে কর অব্যাহতির পরিমাণ পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনতে হবে। তাছাড়া কোন শিল্প কত সময় শুল্ককর অব্যাহতির সুবিধা ভোগ করবে, বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
বাজেটে 'কালো টাকা' সাদা করা কিংবা পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ কর সুবিধা দেওয়া হয়। এটি একেবারে অনৈতিক। ইতোপূর্বে অপ্রদর্শিত আয় আয়কর রিটার্নে দেখিয়ে জরিমানা ছাড়া নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে ,তবে পাচারকৃত টাকা ফেরত আনার সুযোগ ইতোমধ্যে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এরূপ বিধান অবিলম্বে বাদ দেয়া উচিত।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত 'রাজস্ব সম্মেলনে' প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় কর হার না বাড়ানোর কথা বলেছেন। রাজস্ব সংগ্রহের স্বার্থে কোনো ধাপে বা কোনো কর শ্রেণীতে বর্তমানে বলবৎ কৃত কর কমানোও ঠিক হবে না। রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে করজাল সম্প্রসারণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। ভ্যাট আদায় জোরদারের জন্য সরকারি/ বেসরকারি সহায়তায় দ্রুত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইএফডি মেশিন স্থাপন করা জরুরি।
বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ কমানোর জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। গত কয়েক মাস রেমিটেন্স আসা বেড়েছে। রপ্তানিও বাড়তির দিকে। রপ্তানি আয় যাতে সময় মতো দেশে আসে সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরকে লক্ষ্য রাখতে হবে। একইভাবে এ উভয় প্রতিষ্ঠানকে আমদানি রপ্তানির 'ওভার ইনভয়েসিং' ও 'আন্ডার ইনভয়েসিং' এর মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এবারের বাজেটে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর শাস্তির বিধান করা যেতে পারে। একইভাবে ব্যাংকের ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধেও থাকতে পারে কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা।
দেশে কর জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধিকল্পে দেশের কর্মজীবী, শ্রমজীবী ও পেশাজীবীদের বেতন প্রদান ব্যাংকের মাধ্যমে হতে হবে এবং সকলের বেতনের তথ্য এনবিআরকে সরবরাহ করতে হবে যাতে এনবিআর সকলের করযোগ্য আয় নিরূপণ করতে পারে। দেশি শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের বেতন প্রদানে স্বচ্ছতার অভাবে তাদের কাছ থেকে সঠিক কর আদায় করা যাচ্ছে না। এবারের বাজেটে আইন করে শাস্তির বিধান রেখে দেশি শিল্প প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম বন্ধের প্রচেষ্টা নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া কর জরিপের মাধ্যমে জেলা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের করের আওতায় আনয়ন করা যেতে পারে।
রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে আদায়কারী কর্মচারীদের দুর্নীতি রাজস্ব বৃদ্ধির বড় অন্তরায় বলে অনেকে মনে করেন। দুর্নীতি রোধে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পে কর ফাঁকি রোধে উৎপাদন, কাঁচামাল ব্যবহার ও বিক্রয়ে স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং কার্যকর অডিট ব্যবস্থা চালু করতে হবে। অবিলম্বে প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি এনবিআর এর আধুনিকায়ন করতে হবে।
পূর্বের আলোচনার অনুবৃত্তিক্রমে উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অগ্রাধিকার বিবেচনায় যে বরাদ্দই প্রদান করা হোক, সুবিবেচনা, মিতব্যয়ীতা ও দক্ষতার সাথে তা খরচ করতে হবে। বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের নিচে সীমিত রাখলে ভালো হয়, তবে পর্যায়ক্রমে এটি আরো কমিয়ে আনতে হবে। অনুরূপভাবে বিভিন্ন খাতের (কৃষি, জ্বালানি, পানি- বিদ্যুৎ ইত্যাদি) ভর্তুকী পর্যায়ক্রমে কমিয়ে একসময় তুলে দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে, এ সময়ের মধ্যে কর জিডিপির অনুপাত ১৫ শতাংশে উন্নীত করে স্বনির্ভরতা অর্জনের দিকে এগুতে হবে।
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও এনবিআর এর সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত